যে সফরের উদ্দেশ্য ছিল পারস্পরিক জানাচেনা ও বোঝাপড়া এবং অবশ্যই ধন্যবাদজ্ঞাপন, মিয়ানমারের ঘটনাপ্রবাহ তাকে অন্য এক মাত্রা দিয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সাম্প্রতিক ভারত সফর সেদিক থেকে উল্লেখযোগ্য।
শুধু তা–ই নয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাঁর এই প্রথম ভারত সফরে হাছান মাহমুদ আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে চিনি ও পেঁয়াজের আমদানি নিশ্চিত করার বিষয়টিতেও গুরুত্ব দিয়েছেন। আশ্বাস অনুযায়ী সবকিছু ঠিকমতো চললে চলতি সপ্তাহেই সে সিদ্ধান্ত সুনিশ্চিত হওয়ার কথা।
তিন দিনের ভারত সফরের শেষ দিনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ কেন্দ্রীয় শিল্প, বাণিজ্য, খাদ্য ও উপভোক্তাবিষয়ক মন্ত্রী পীযূষ গয়ালের সঙ্গে দেখা করেন। সেই সাক্ষাৎকারে রমজান মাসে চিনি ও পেঁয়াজের বিশেষ সরবরাহের অনুমতি দেওয়ার এই অনুরোধ তিনি জানিয়েছিলেন। দুই দেশের কূটনৈতিক মহলের খবর অনুযায়ী, চলতি সপ্তাহেই এক বিশেষ বৈঠকে বিষয়টি আলোচিত হবে।
বাংলাদেশের তরফ থেকে রমজান মাসে ১ লাখ টন চিনি ও ৫০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ রপ্তানির অনুরোধ জানানো হয়েছিল। দুই পণ্যের রপ্তানির ওপরেই আপাতত নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রী–ঘনিষ্ঠ মহলে এই সফর অত্যন্ত ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, চিনি ও পেঁয়াজ রপ্তানির বিষয়ে তাঁদের অনুরোধ ভারত বিশেষভাবে বিবেচনা করার আশ্বাস দিয়েছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারি সূত্র অনুযায়ী বাংলাদেশের অনুরোধ বিবেচনায় চলতি সপ্তাহে ভারত সরকারের আন্তমন্ত্রিসভা পরামর্শদাতা কমিটির (আইএমসি) গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক বসছে। শিল্প-বাণিজ্যমন্ত্রী ছাড়াও ওই কমিটির সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানেই রমজান মাস উপলক্ষে ওই দুই আবশ্যিক পণ্য রপ্তানি করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।
হাছান মাহমুদের এই সফরের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল পারস্পরিক জানা–পরিচয়। এর আগে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে তিনি একাধিকবার ভারতে এসেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে এটাই তাঁর প্রথম সফর। স্বাভাবিক কারণেই দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পরিচয় হওয়া জরুরি ছিল।
মিয়ানমারের এই সংঘাত চীন কীভাবে দেখছে, তার সম্ভাব্য ভূমিকা কী হতে পারে, সেই চিন্তাও ভারত ও বাংলাদেশের রয়েছে। এ সংঘাত ওই দেশে চীনের প্রভাব ও আধিপত্য আরও বাড়াবে কি না, বাড়ালে বাংলাদেশ ও ভারতের ওপর তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, সে বিষয় দুই দেশের বিবেচনাধীন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফর ছিল সেদিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।
পারস্পরিক জানাচেনা পর্ব ছাড়াও এই সফরের অন্য গুরুত্ব ছিল। এবারের নির্বাচনকে ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলে অভিনব আলোড়ন উঠেছিল। ভোট ঘিরে নানা ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই অনিশ্চিত আবহে ভারত দৃঢ়ভাবে ‘গণতন্ত্রের’ স্বার্থে দাঁড়িয়েছিল। সফর চলাকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বারবার সেই কারণে ভারতকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
এমন কথাও তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত আন্তর্জাতিক সব বাধা উপেক্ষা ও অগ্রাহ্য করে যে দৃঢ়তার সঙ্গে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল, গণতন্ত্রের স্বার্থে এই নির্বাচনেও সেভাবে সঙ্গ দিয়েছে। ফলে সেই অর্থে হাছান মাহমুদের এই সফর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘থ্যাংকস গিভিং ভিজিট’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
কিন্তু মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ এই সফরে অন্য এক মাত্রা জুড়ে দিয়েছে।
সফর চূড়ান্ত হওয়ার সময় থেকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে বিরোধীদের সংঘাত বেড়ে যায়। সেই সংঘাতের অভিঘাত এসে পড়েছে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের ওপর। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের পরিস্থিতি যেমন ঘোরালো হয়েছে, তেমনই সমস্যা সৃষ্টি করেছে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোয়।
মিয়ানমারের রাজনীতির সরাসরি প্রতিক্রিয়া পড়েছে মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয়। সৃষ্টি করেছে রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাও। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারত—দুই দেশের সমস্যার চরিত্র একই ধরনের। এ সমস্যার মোকাবিলা তাই একভাবে করা যায় কি না, সে চিন্তা দুই দেশের নীতিনির্ধারকদের ব্যস্ত রেখেছে।
হাছান মাহমুদের সফর শুরুর ঠিক আগেই তাই ঢাকা পৌঁছান ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। চটজলদি সেই সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে তিনি দেশে ফেরেন। হাছান মাহমুদের সফরও শুরু হয় দোভালের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে। ভারত ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক মহল জানিয়েছে, দুই দেশ একযোগে এ পরিস্থিতির মোকাবিলা কীভাবে করতে পারে, তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা চলছে।
বাংলাদেশের চোখে এত দিন ধরে রোহিঙ্গা প্রশ্নে ভারতের ভূমিকা ছিল ‘কিছুটা ছাড়া ছাড়া’। ভারতের ‘নিজস্ব স্বার্থ ও বাধ্যবাধকতা’ বিষয়ে বাংলাদেশও অবহিত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ভারতকে সজাগ ও সচকিত করে তুলেছে। দৃষ্টিভঙ্গির সেই ‘পরিবর্তন’ বাংলাদেশ লক্ষ করছে। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশই মনে করছে, সমস্যার চরিত্র এখন এক।
মিয়ানমারের এই সংঘাত চীন কীভাবে দেখছে, তার সম্ভাব্য ভূমিকা কী হতে পারে, সেই চিন্তাও ভারত ও বাংলাদেশের রয়েছে। এ সংঘাত ওই দেশে চীনের প্রভাব ও আধিপত্য আরও বাড়াবে কি না, বাড়ালে বাংলাদেশ ও ভারতের ওপর তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, সে বিষয় দুই দেশের বিবেচনাধীন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফর ছিল সেদিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।
দুই দেশের কূটনৈতিক সূত্র অনুযায়ী, এই সফরে বহমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয়ের ওপরও আলোকপাত করা হয়। নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সেই জানাশোনাও ছিল জরুরি। সবদিক থেকে এ সফরকে তাই ‘অত্যন্ত ইতিবাচক ও সদর্থক’ বলে মনে করা হচ্ছে।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি