মেট্রোরেল, এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়ে, উড়ালসড়ক, ইউলুপ—এমন আরও অনেক কিছুই হয়েছে এই ঢাকায়। গত ১০ বছরে অনেক মেগা প্রকল্পের দুর্ভোগ বইতে হলো। মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে আংশিক চালু হয়েছে। এসবের কিছু সুবিধাও মিলছে এখন। কিন্তু মূল সড়কের ব্যবস্থাপনা ও সড়কের নকশা নিয়ে উদ্বেগ যেন আরও বাড়ছে।
মোদ্দাকথা হলো, সড়ক ব্যবস্থাপনার উন্নতি দূরের কথা, বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে। যাঁরা পাবলিক বাসে যাতায়াত করেন, তাঁরা এ কথার সঙ্গে একমত হবেন। অনেক জায়গায় পাবলিক বাস থেকে নামলে রীতিমতো আতঙ্কিত হতে হয়; মনে হয়, যাঁরা সড়কের নকশা করেন, তাঁরা কীভাবে এমন জায়গায় যাত্রী ওঠানামার ব্যবস্থা রাখনে বা যাঁরা আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগ করেন, তাঁরাই-বা কীভাবে তা হতে দেন।
রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডে বাস থেকে নামার অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এই লেখার অবতারণা। সেখানে উড়ালসড়ক হওয়ার পর বিমানবন্দর বা গাজীপুরগামী বাস থেকে নামা আতঙ্কেও বিষয় হয়ে উঠেছে। ঠিক কুড়িল উড়ালসড়কে ওঠার র্যাম্পের মুখে যাত্রীদের নামতে হয়। এরপর ১৫ ফুটের মতো রাস্তা পেরিয়ে ফুটপাত এবং তারপর পদচারী-সেতু। বাস থেকে নামার পর নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে; কারণ আপনার সামনে ও পেছনে যেসব গাড়ি ছুটে চলবে, সেগুলোর গতি ৮০ কিলোমিটারের কম নয়। ফুরসত পেলে এক দৌড়ে সেই ১৫ ফুট রাস্তা (উড়ালসড়কের ওঠার মুখ) পেরোতে হবে।
এখন ধরা যাক, কেউ সেখান থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় যাবেন। সেটা আরেক সংগ্রাম। উড়ালসড়ক পেরিয়ে রাস্তার অপর পাশে নেমে কিছুদূর হাঁটার পর দেয়ালের ভাঙা অংশ গলে আপনাকে রেললাইনে উঠতে হবে। সেখানে আবার গড়ে উঠেছে অস্থায়ী বাজার। সেই বাজার ও উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে আপনাকে উঠতে হবে মূল সড়কে, যেখানে মিশেছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কুড়িল নামার পথ এবং সেখান দিয়েই গাড়িগুলোকে ৩০০ ফিট সড়কে উঠতে হয়। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে ভূলতা, গাউছিয়াগামী বিআরটিসি বাস ও রিকশা।
সেই রিকশাযোগে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৩০০ ফিট সড়কসংলগ্ন ফটকের কাছাকাছি যাওয়া যায়। কিন্তু যেতে যেতে নিঃসন্দেহে আপনার বুক দুরুদুরু করবে। প্রথমত, সেই সড়কে আলো ও নিরাপত্তার বড় অভাব; দ্বিতীয়ত, কিছুদূর সঠিক লেনে চলার পর রিকশাগুলো উল্টো লেনে চলা শুরু করবে। তখন উল্টো দিক থেকে শাঁই শাঁই করে গাড়ি, বাস ও বাইক ছুটে আসবে। তখন আপনার নিজেকে ধাবমান গাড়ির হেডলাইটের সামনে পড়া খরগোশশাবকের মতো হবে হবে; মনে হবে, কোনোরকমে হাত দুটো দিয়ে চোখমুখ ঢাকতে পারলেই রক্ষা। রিকশা আপনাকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ফটকের ৫০ গজ আগে নামিয়ে দেবে। তখন মনে হতে পারে, যাক, আয়ু বোধ হয় আরও কিছুটা পাওয়া গেল।
ঢাকার সড়কে চলাচলের সময় এমন অভিজ্ঞতা আমজনতামাত্রই হয়। এখন নতুন করে ভীতির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সন্তানকে বিদ্যালয় থেকে আনা-নেওয়া করা। রিকশায় আসা-যাওয়ার সময় গত দেড় বছরে অন্তত পাঁচবার পেছন থেকে অন্য কোনো রিকশা বা অটোরিকশা আমাদের রিকশাকে ধাক্কা দিয়েছে এবং তাতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কিন্তু ২০০৮ সালের আরেক ভীতিকর অভিজ্ঞতার কারণে নিজের সুরক্ষা সার্কিট আপনা-আপনি অনেক শক্তিশালী হয়ে যাওয়ায় এসব দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা। সেবার বঙ্গভবনের পাশ দিয়ে রিকশায় যাওয়ার সময় হঠাৎ রিকশা থেকে পাঁচ ফুট ওপরে উঠে গেলাম, এরপর পপাত ধরণিতল। পেছন থেকে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ধাক্কা দিয়েছিল, কিন্তু আমার কী হলো, তা দেখার চিন্তাও করেনি সেই অটোরিকশার চালক। ভাগ্য ভালো, পেছন থেকে অন্য কোনো গাড়ি সেদিন আমাকে মাড়িয়ে যায়নি।
এ-ই হচ্ছে অবস্থা। জিডিপির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, কাজের খোঁজে সারা দেশের মানুষ ঢাকায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে; শহরে বড় বড় অবকাঠামো হচ্ছে, মানুষ সেখানে কাজ পাচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর মধ্যে যেন মানুষের জীবন সবচেয়ে ঠুনকো হয়ে গেছে। যেভাবে আমরা ছুটে বেড়াচ্ছি, তাতে মনে হয়, ছোটাটাই জীবনের মোক্ষ। সেই সঙ্গে সড়কের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর দায়িত্বজ্ঞানহীনতা তো আছেই। এটাও ঠিক, শরীরের সব রক্ত যেমন মুখে জমা হলে তাকে স্বাস্থ্যের লক্ষণ বলা যায় না, তেমনি সারা দেশের মানুষের এক ঢাকা নগরে আসাও স্বাস্থ্যকর বিষয় নয়। সে জন্য অনেক ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশও নিরুপায় হয়ে যায়।
সমস্যা হলো, আমরা এখন উন্নয়নের এমন পর্যায়ে আছি, যে পর্যায়ে মানুষের আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনই মূল বিষয়। ফলে, শহরের সড়কের কী হলো, মানুষ স্বস্তিতে হাঁটতে পারছে কি না, নিরাপদে রাস্তা পেরোতে পারছে কি না, শহরের নদীর পাড় মানুষের অবসর কাটানোর মতো নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কি না—এসব বিষয় একেবারে গুরুত্বহীন। এখানে আনমনে কিছুক্ষণ হাঁটার উপায় নেই, সেই চেষ্টা করলে নির্ঘাত দুর্ঘটনার শিকার হতে হবে। অথচ মানুষের বিকাশের জন্য কিছুটা নিরালা-নিরিবিলি পরিবেশ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। একসময় সিম্পল লিভিং হাইথিঙ্কিং নীতির বেশ জনপ্রিয়তা ছিল, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একটি অংশ এই নীতি মানতেন।
কিন্তু বাস্তবতা এখন ঠিক তার বিপরীত—হাইলিভিং ও সিম্পল থিঙ্কিং যারা করে, তারাই এখন সমাজের কর্ণধার—সবখানেই।
প্রবৃদ্ধির গতি আছে বলেই শহরে এই বিশৃঙ্খলা, তা একদিক থেকে ঠিক। কিন্তু এই বাস্তবতা বেশি দিন থাকবে না। শহরের অন্তহীন ট্রাফিক জ্যাম ও অব্যবস্থাপনার কারণে মানুষের জীবনীশক্তি ও আয়ু কমে যাচ্ছে। আমরা কয়েক বছরের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাব। তখন বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করতে হবে। নতুন বাস্তবতা মোকাবিলায় আরও সৃজনশীলতা ও বিশ্লেষণী সক্ষমতা প্রয়োজন। কিন্তু শহরের এ পরিস্থিতিতে তা কীভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব, সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক