তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধটা বাধেনি ঠিকই, কিন্তু যুদ্ধের পরিস্থিতি তো সর্বত্রই বিদ্যমান। বাণিজ্যযুদ্ধ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বেধেছে আমেরিকা ও তার মিত্রদেশগুলোর। ভুক্তভোগী হচ্ছে ইউক্রেনের মানুষ।
কেবল ইউক্রেনের কেন, বিশ্বের সব মানুষই নিদারুণ কষ্টে পড়েছে। জ্বালানিসংকট, খাদ্য উৎপাদন হ্রাস, মুদ্রাস্ফীতি, মাদক, পর্নোগ্রাফি—সবকিছু আঘাত করছে মানুষকে। লাভ হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
আর অত্যাশ্চর্য সব রাজনৈতিক ঘটনা তো ঘটেই চলেছে। ইউরোপে নাৎসি ও ফ্যাসিবাদীদের তাণ্ডব মানব-ইতিহাসের এক চরম দুঃখ ও লজ্জার বিষয়। সেই জাতীয়তাবাদীরা জাতিদম্ভ নিয়ে আবার ফিরে এসেছে।
জার্মানিতে নাৎসিদের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে; আর ইতালিতে তো মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী সমর্থকেরা রাষ্ট্রক্ষমতাতেই বসে পড়েছে। ভোট অবশ্য পেয়েছে শতকরা ২২ জনের, তবু নির্বাচিত তো হয়েছে!
রীতিমতো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। তাদের দলের নাম ‘ব্রাদার্স অব ইতালি’; ভাইদের দল, বোনেরা নেই; ঝোঁকটা স্পষ্টতই পুরুষতান্ত্রিকতা তথা পিতৃতান্ত্রিকতার দিকেই। মুসোলিনিকেই এরা আদর্শিক পিতা হিসেবে মানে। তবে দলের প্রধান যিনি, তিনি পুরুষ নন, একজন নারী এবং ওই নারীই প্রধানমন্ত্রীর আসনে সমাসীন হয়েছেন। তাঁর বয়স বেশি নয়, ৪৫ বছর। তরুণ ভাইদের কাছেই তাঁর প্রধান আহ্বান, আহ্বান ‘ঈশ্বর, দেশ ও পরিবার’-এর নামে। ওই নারীর বাবা সম্পদশালীই ছিলেন।
তবে একসময় পরিবার ছেড়ে উধাও হয়ে যান এবং ভবিষ্যতের এই প্রধানমন্ত্রী প্রতিপালিত হন মাতৃস্নেহে; তবু পিতৃতান্ত্রিকতার কাছে আত্মসমর্পণ করতে তাঁর কোনো অসুবিধা হয়নি। ইতালির রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনিই প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। তবে আসল কথা এ-ই যে তাঁর বাইরের চেহারাটি যা-ই হোক না কেন, অন্তরে তিনি একজন কর্তৃত্ববাদী ও পিতৃতন্ত্রে বিশ্বাসী ব্যক্তি এবং তাঁর দলের প্রধান শক্তিই হচ্ছে দেশে জাতীয় স্বার্থের নামে বহিরাগতদের প্রবেশ ঠেকানো তো বটেই, আগে যারা ঢুকে পড়েছে, পারলে তাদেরও বিতাড়িত করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইতালিতে মুসোলিনিপন্থীরা আবার রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তগত করবে—এটা এর আগে কি ভাবা গেছে?
টালমাটাল ঘটনা ঘটেছে গ্রেট ব্রিটেনের রাজনৈতিক ইতিহাসেও। তিন মাসে সেখানে তিনজন প্রধানমন্ত্রী দৃশ্যমান হয়েছেন। বরিস জনসন বিদায় নেন নানা অভিযোগের বোঝা মাথায় নিয়ে। এলেন এক নারী; বয়স তাঁর অল্পই, কিন্তু টিকলেন মাত্র ৪৫ দিন। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করার ব্যর্থতার মুখে বিদায় হলেন আত্মসম্মান রক্ষা করে। এবার তাঁর চেয়েও কম বয়সের এমন একজন এসেছেন, জাতিদাম্ভিক ইংরেজদের রাষ্ট্রশাসনের ইতিহাসে যাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা এত দিন পর্যন্ত ছিল একেবারেই অকল্পনীয়। ইনি ইংরেজ নন, ভারতীয় বংশোদ্ভূত।
টাকা চলে যায় সুইস ব্যাংকে, নিরাপদে থাকবে বলে। শোনা গেল, এক বছরে সেখানে বাংলাদেশিদের জমা তিন হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। অথচ সরকারের দিক থেকে কোনো চেষ্টা নেই কারা টাকা পাচার করছে তাদের তালিকা প্রস্তুতে। [প্রথম আলো, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২] হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ যে বলেছেন, ‘অর্থ পাচারকারীদের জন্য গুলি করার বিধান থাকা উচিত।’ সেটা অনেক মানুষেরই মনের কথা বৈকি, কিন্তু তেমন বিধান আসবে কি? এলেও যথাযথ কার্যকর হবে—এমন সম্ভাবনা নগণ্য।
মহামতি উইনস্টন চার্চিল যাঁকে অর্ধনগ্ন ফকির বলতেন, সেই গান্ধীর দেশেই চার্চিলের উত্তরাধিকারী নতুন এই প্রধানমন্ত্রীর পূর্বপুরুষদের জন্ম। সেখান থেকেই এসে বসতি গেড়েছিলেন ইংল্যান্ডে। নামটাও ইংরেজদের জন্য একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। ঋষি সুনাক। ধর্মে মোটেই খ্রিষ্টান নন, খাঁটি হিন্দু। এর আগেও তিনি মন্ত্রী ছিলেন এবং ভীষণ প্রকারের দক্ষিণপন্থী বরিস জনসনের মন্ত্রিসভায়।
কিন্তু তাই বলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, এমনটা কোন ইংরেজ কবে ভেবেছিল? তবে এটাই তো বাস্তবতা, নইলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন কেন? আর তিনি যে ‘অযোগ্য’, তা–ও নিশ্চয়ই নয়। অযোগ্য হলে তাঁকে বেছে নেওয়া কেন? অবশ্যই যোগ্য। প্রথমত, তিনিও উগ্র রকমের রক্ষণশীল এবং তাঁর নামের প্রথমে ‘ঋষি’ থাকলেও তিনি মোটেই সাধুসন্ত নন [যেমন নন ভারতের বর্তমান শাসকদের কেউ কেউ, যাঁরা ‘যোগী’ হিসেবে নাম নিয়েছেন]।
ঋষি সুনাক অত্যন্ত বাস্তববাদী এবং নাকি খুবই ধনী। এত ধনী কোনো ব্যক্তি এর আগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হননি। এই ঋষি অত্যন্ত শ্রেণিসচেতন; শ্রমিকশ্রেণির কোনো মানুষের [গাত্রবর্ণ যা–ই হোক] সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কোনো প্রমাণ নেই। পরিপূর্ণরূপে বিশুদ্ধই তিনি, পুরোপুরি রক্ষণশীল। ওদিকে আবার পড়াশোনার জন্য গিয়েছিলেন আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই তাঁর ‘আধুনিকতা’ মোটেই প্রশ্নসাপেক্ষ নয়।
অন্যদিকে, তাঁর দেশের (অর্থাৎ যুক্তরাজ্যের) পুঁজিবাদী অর্থনীতির এখন এমনই লেজেগোবরে দশা যে তাঁর মতো একজন ভিনদেশিকেই সম্ভাব্য উদ্ধারকারী হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। বয়স যাঁর মাত্র ৪২।
কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী তিনি। (ডুবন্তের আবার বয়স–বিচার!) বিশ্ব পুঁজিবাদের এখন এতটাই বিপদ যে বাঁচার জন্য সে মরিয়া হয়ে উঠেছে এবং মানুষের সভ্যতার শরীরে নানা ধরনের মরণকামড় বসাচ্ছে। উদারনীতির জন্য এখন আর কোনো পরিসর খোলা নেই। উদারনীতিকেরা মানে মানে পাততাড়ি গোটাচ্ছেন। ওই যে বিদায় নেওয়া ৪৫ দিনের নারী প্রধানমন্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি লিবারেল পার্টিতেই ছিলেন। পরে কনজারভেটিভ হয়েছেন; সেটা যদি না হতেন, তাহলে অত দূর উঠতে পারতেন না, যত দূর উঠেছিলেন।
ব্রিটিশ লেবার পার্টিতে বামপন্থী যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এখন ঠেলাধাক্কার মধ্যে রয়েছেন। আর ইসরায়েলে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন সেই নেতানিয়াহু, যাঁর বিরুদ্ধে দেশের আদালতে দুর্নীতির মামলা এখনো চলমান। নিজে তিনি পর্যাপ্ত পরিমাণেই দক্ষিণপন্থী, কিন্তু তাতেও কুলায়নি। তাঁকে হাত বাড়িয়ে দিতে হয়েছে তাঁর তুলনাতেও যাঁরা কট্টরপন্থী, তাঁদের দিকে। সুইডেন তো এতকাল তার উদারনীতির জন্যই বিশ্বখ্যাত ছিল, কিন্তু সেখানেও দক্ষিণপন্থীরা ক্ষমতায় বসে গেছে।
ঘটনা একই। পুঁজির হাতে মেহনতিদের লাঞ্ছনা; মুনাফালিপ্সার কাছে মনুষ্যত্বের পরাজয়। সর্বত্র ওই একই ব্যাপার। বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদীর যে উন্নয়ন ঘটেছে, তাতে মেহনতিদের দশা তো হয়েছে তেলাপোকার মতোই।
বিশ্বে শীর্ষ ধনীদের একজন হচ্ছেন ইলন মাস্ক। তিনি টুইটার প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেন। নিয়েই ঠিক করেন প্রতিষ্ঠানের আরও উন্নতি ঘটাবেন। তার জন্য প্রথম চোটেই অর্ধেক কর্মচারীকে ছাঁটাইয়ের নোটিশ দিয়ে দেন। অন্যদের বলেন, কর্মঘণ্টা বাড়াতে হবে। সবকিছুই অবশ্য উন্নয়নের স্বার্থে।
আর উন্নয়নের অর্থ হচ্ছে মালিকের মুনাফার স্বার্থ নিশ্চিত করা। অর্থনৈতিক সংকটে সহিংসতা বাড়ছে। নির্বাচনে হেরে গিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, তাঁর বিজয় চুরি হয়ে গেছে; বিপুলসংখ্যক রিপাবলিকান তাঁর সেই বয়ানে আস্থা রেখেছে, তাদের নিজেদের স্বার্থে। তারা আইনসভাগৃহে আক্রমণ চালিয়েছে। আক্রমণকারীরা স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিকে খুঁজছিল। সেবার অবশ্য তাঁর দৈহিক কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এবার মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে এক ঘাতক পেলোসির বাসগৃহে হানা দিয়েছিল, হাতের কাছে পেলে হয়তো তাঁকে হত্যাই করত। তাঁকে না পেয়ে তাঁর স্বামীকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েছে।
থাইল্যান্ডকে সবাই জানে শান্তিপ্রিয় দেশ বলে। সেখানে ঘটেছে অভূতপূর্ব ঘটনা। মফস্সল শহরের এক ডে কেয়ার সেন্টারে বন্দুক ও ছুরি নিয়ে হানা দিয়েছে এক লোক, শিশুসহ হত্যা করেছে ৩৮ জনকে। তারপর অন্য এক শহরে গিয়ে প্রথমে হত্যা করেছে নিজের স্ত্রী ও সন্তানকে, তারপর নিজেকে। লোকটি পুলিশের চাকরি করত। মাদক সেবনের দায়ে চাকরিচ্যুত হয়েছিল। থাইল্যান্ড তাহলে কত দূরে এখন খোদ আমেরিকা থেকে?
বাংলাদেশেও মানুষের ওই একই দশা। মেহনতিরা শ্রম করে, সুবিধাভোগীরা শ্রমের ফসল হাতিয়ে নেয়, কিছুটা ভোগবিলাসে খরচ করে বাকিটা পাচার করে দেয়। বিদেশে তারা বাড়িঘর কেনে।
টাকা চলে যায় সুইস ব্যাংকে, নিরাপদে থাকবে বলে। শোনা গেল, এক বছরে সেখানে বাংলাদেশিদের জমা তিন হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। অথচ সরকারের দিক থেকে কোনো চেষ্টা নেই কারা টাকা পাচার করছে তাদের তালিকা প্রস্তুতে। [প্রথম আলো, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২] হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ যে বলেছেন, ‘অর্থ পাচারকারীদের জন্য গুলি করার বিধান থাকা উচিত।’ সেটা অনেক মানুষেরই মনের কথা বৈকি, কিন্তু তেমন বিধান আসবে কি? এলেও যথাযথ কার্যকর হবে—এমন সম্ভাবনা নগণ্য।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়