উত্তর-পূর্ব ভারতের ছোট রাজ্য ত্রিপুরা। ভোটার ২৮ লাখের সামান্য বেশি। পশ্চিমবঙ্গে ভোটার প্রায় সাড়ে ৭ কোটি আর ভারতে প্রায় ১০০ কোটি। তা সত্ত্বেও ত্রিপুরা নির্বাচন নিয়ে প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যসহ গোটা ভারতে। এমন কিছু ঘটনা নির্বাচনের আগে ত্রিপুরায় ঘটেছে, যা রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। নানা কারণে ত্রিপুরা নির্বাচনের ফল জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে। সেই কারণেই ত্রিপুরা নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ।
যেমন ধরা যাক, এ সময়ে ভারতে ত্রিপুরাই একমাত্র রাজ্য, যেখানে সরাসরি লড়াই হচ্ছে দুই আদর্শের—বামপন্থী এবং দক্ষিণপন্থী। দক্ষিণ ভারতের কেরালায় বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকলেও সেখানে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট, বিজেপি নয়। অর্থাৎ, একমাত্র ত্রিপুরায় দুই আদর্শভিত্তিক জোটের সরাসরি সংঘাত হচ্ছে। ত্রিপুরায় বামফ্রন্ট জিতলে, এই প্রথম কোনো রাজ্যে দক্ষিণপন্থীদের হারাবে বামপন্থীরা। এটা ভারতে বাম-সমাজতান্ত্রিক-মধ্যপন্থীসহ গোটা ধর্মনিরপেক্ষ জোটের মনোবল বাড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ কারণে নির্বাচনটি গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর কংগ্রেস-বামপন্থীদের জোট কোথাওই বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে জোট ব্যর্থ হয়েছে। কংগ্রেসকে নিয়ে যারাই জোট করেছে, তারাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিপদে পড়েছে। কারণ, কংগ্রেসের একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে। তা হলো, বিভিন্ন রাজ্যে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও অ-কংগ্রেসি দলের সঙ্গে জোট হলেই কংগ্রেস বিরাট সংখ্যক আসন চেয়ে বসে। রাজ্যস্তরে তারা নিজেদের প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন দল মনে করে, এখনো।
ত্রিপুরায় দেখা গেল, কংগ্রেসের জোট সঙ্গী বামফ্রন্ট তাদের যে কয়টি আসন দিল, সেই কয়টিতেই (৬০ এর মধ্যে ১৩) লড়ল কংগ্রেস। বামফ্রন্টের সঙ্গে বিশেষ বিবাদের রাস্তায় গেল না। এটা কংগ্রেস কেন করল?
এর একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে। কংগ্রেস গোটা ভারতে ছোট, মাঝারি বা বড় দলকে একটা ইঙ্গিত দিল। আগামী লোকসভা নির্বাচনে তারা আঞ্চলিক দলের সঙ্গে আসন নিয়ে বিবাদে আগ্রহী নয়। এই অবস্থায় ত্রিপুরায় বাম-কংগ্রেস জোট জয়ী হলে, সেটা বিরোধী রাজনীতির জন্য সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক ঘটনা হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, ২০২৩ সালে ভারতে নয়টি রাজ্যে এবং সম্ভবত জম্মু-কাশ্মীরে নির্বাচন হবে। এক বছর পরে লোকসভা নির্বাচন হবে। এই সময়ে কংগ্রেসের নমনীয়তা গুরুত্বপূর্ণ।
এর পরে যদি ত্রিপুরায় বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস জয়ী হয়, তবে বিরোধীদের পালে যে হাওয়া লাগবে, তা অনস্বীকার্য। কিন্তু তার আগে ত্রিপুরায় নির্বাচন জিততে হবে বাম-কংগ্রেস জোটকে। সেই কাজ সহজ নয়। বস্তুত, এক কথায় কার্যত অসম্ভব। নির্বাচনে যে সাংগঠনিক শক্তি বিজেপি দেখিয়েছে এবং যে পরিমাণে অর্থ ব্যয় করেছে, তার পরে বিজেপিবিরোধী জোটের ত্রিপুরায় জেতা প্রায় অসম্ভব।
তৃতীয়ত, বিরোধী জোটের মুখ হিসেবে ত্রিপুরায় উঠে এসেছেন সিপিআইএমের রাজ্য সম্পাদক জিতেন্দ্র চৌধুরী। তিনি একজন উপজাতীয় নেতা। অউপজাতি, বিশেষত বাঙালিদের ভোট এবং কিছু আসনে উপজাতি সমাজের ভোট পেয়ে তিনি এবং তাঁর দল যদি জেতে, তবে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজনীতিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ মুখ হিসেবে উঠে আসবেন। ‘আপার’ আসামের রাজনৈতিক নেতা এবং আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিজেপির হিমন্ত বিশ্বশর্মা উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে উঠে এসেছেন। কিন্তু তিনি উত্তর-পূর্ব ভারতের দুই প্রধান সমাজের মানুষ নন। এই দুই সমাজ হলো খ্রিষ্টান সম্প্রদায় এবং আদিবাসী ও উপজাতীয় সমাজ। বিশ্বশর্মা একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ। বিষয়টি স্পর্শকাতর বলে বিশেষ কেউ আলোচনা করেন না, কিন্তু জিতেন্দ্র চৌধুরীর জয়ের সঙ্গে এটা একটা নতুন ‘ন্যারেটিভ’ হিসেবে উঠে আসতে পারে। তবে তাঁকে জিততে হবে।
চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ত্রিপুরার উপজাতীয় দল তিপ্রা মথার অবিশ্বাস্য উত্থান। মাত্র দুই বছরের মধ্যে ত্রিপুরার পার্বত্য অঞ্চলে দলটির এমন উন্নতি হয়েছে যে এখন অনেক পত্রপত্রিকায় লেখা হচ্ছে যে ত্রিপুরার ভবিষ্যৎ মুখ্যমন্ত্রী রাজবাড়ির সন্তান প্রদ্যোৎ দেববর্মণ। সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ কারণ ৬০ আসনের মধ্যে ত্রিপুরায় বিশটি (এক-তৃতীয়াংশ) আসন তফসিলি উপজাতির জন্য সংরক্ষিত। বাকি আসনে অউপজাতিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারা উপজাতীয় দলকে ভোট দেবেন না বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। তা সত্ত্বেও, উপজাতি দলের উত্থান উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য আদিবাসী এবং উপজাতীয় জোটকে উৎসাহিত করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
পঞ্চমত, তিপ্রা মথার উত্থান এটা স্পষ্ট করেছে যে ভারতে ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব আইন উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ মেনে নেননি। ত্রিপুরায় সব দলই স্বীকার করছে, সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ) উপজাতি সম্প্রদায়ের জমি হারানোর ভয় বাড়িয়েছে। কারণ, এই আইনে লেখা আছে মুসলমান সম্প্রদায় ছাড়া অন্য সব সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন। আদিবাসী এবং উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব কম, ফলে ফাঁকা জমি বেশি। আদিবাসী এবং উপজাতি সমাজের ভয়, সিএএ বাস্তবায়িত হলে তাদের জমিতে এসে বসবেন অউপজাতির মানুষেরা। যদিও সেটা সম্ভব নয়, কারণ আদিবাসী জমি অউপজাতিরা আইনমাফিক কিনতে পারেন না। কিন্তু, উপজাতি সমাজের বক্তব্য, উপজাতিদের পাশের জমি যদি অউপজাতিরা কেনেন তবে উপজাতিদের ওপরে চাপ বাড়বে। এই ভয় থেকেই তিপ্রা মথার জন্ম ও জনপ্রিয়তা।
উল্লেখ্য, প্রধান বিরোধী দল বামফ্রন্ট, কংগ্রেস এবং তিপ্রা মথা ত্রিপুরায় নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করেছে। বিজেপি হেরে গেলে নাগরিকত্ব আইন বিরোধিতার ‘ট্রেন্ড’ উত্তর-পূর্ব ভারতের বাকি ছয় রাজ্যে বাড়বে। এটা বিজেপির জন্য ভালো খবর নয়।
এই প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। তিপ্রা মথার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে দুই প্রধান সংগঠন, বিজেপি এবং বামফ্রন্ট, লিখিতভাবে জানিয়েছে, ক্ষমতায় এলে নানা ক্ষেত্রে রাজ্যের আদিবাসীদের তারা আরও বেশি ক্ষমতা দেবে। বিজেপি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে লিখেছে, ‘১২৫-তম প্রস্তাবিত সংবিধান সংশোধনী বিলের কাঠামোর মধ্যে টিটিএএডিসিকে (ত্রিপুরার স্বশাসিত আদিবাসী পরিষদ) বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে। অতিরিক্ত আইনি, কার্যনির্বাহী, প্রশাসনিক এবং আর্থিক ক্ষমতা প্রদানের জন্য পরিষদ পুনর্গঠিত হবে।’ অর্থাৎ, কার্যত তিপ্রা মথার ‘বৃহত্তর’ ক্ষমতায়নের দাবিকেই মেনে নিয়েছে বিজেপি।
অন্যদিকে, বামফ্রন্টের এক আদিবাসী প্রার্থী রাধাচরণ দেববর্মা বলেছেন, স্বশাসিত আদিবাসী পরিষদকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, তা পুরোনো হয়ে গিয়েছে। প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার করে আদিবাসীদের হাতে আরও ক্ষমতা না দিলে ভবিষ্যতে ত্রিপুরায় সমস্যা বাড়বে। সেই লক্ষ্যে তারা যে কাজ করবেন, এমনটাই নির্বাচনী পোস্টারে লিখেছে বামফ্রন্ট।
বামফ্রন্ট লিখছে, ‘১২৫তম সংবিধান সংশোধনী বিল মোতাবেক উপজাতিদের জমি, ভাষা, অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও উপজাতিদের জনজীবনের জন্য সর্বোচ্চ ক্ষমতার দাবি নিয়ে জোরদার লড়াই করা হবে।’ ১২৫তম সংবিধান সংশোধনী বিলে আদিবাসী গ্রাম এবং পুরসভার ‘বৃহত্তর’ ক্ষমতায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। তিপ্রা মথার উত্থান না হলে আদিবাসীদের আরও ক্ষমতা দেওয়ার ইচ্ছা মূলস্রোতের রাজনৈতিক দল প্রকাশ করত কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
এর পরে যদি ত্রিপুরায় বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস জয়ী হয়, তবে বিরোধীদের পালে যে হাওয়া লাগবে, তা অনস্বীকার্য। কিন্তু তার আগে ত্রিপুরায় নির্বাচন জিততে হবে বাম-কংগ্রেস জোটকে। সেই কাজ সহজ নয়। বস্তুত, এক কথায় কার্যত অসম্ভব। নির্বাচনে যে সাংগঠনিক শক্তি বিজেপি দেখিয়েছে এবং যে পরিমাণে অর্থ ব্যয় করেছে, তার পরে বিজেপিবিরোধী জোটের ত্রিপুরায় জেতা প্রায় অসম্ভব।
বাম-কংগ্রেস জোট যদি সেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে, তবে তা ভারতে নির্বাচনী মৌসুম শুরু হওয়ার আগে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বলে বিবেচিত হবে। এসব কারণেই গুরুত্বপূর্ণ ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচন।
● শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা