বাংলাদেশ যখন একটি নতুন বছরে প্রবেশ করছে এবং চলমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতাগুলোকে গভীরভাবে মূল্যায়ন করার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই মূল্যায়ন শুধু আর্থিক নীতি নির্ধারণে নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো ও কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্যও অপরিহার্য।
বর্তমান অর্থনৈতিক পটভূমিতে এমন অনেক জটিল সমস্যা বিদ্যমান, যা সমন্বিত ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সমাধান করা প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, বিনিয়োগের স্থবিরতা এবং শ্রমবাজারে অস্থিরতা—এই সব কটিই একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাধান দাবি করে।
আসন্ন জাতীয় বাজেটের প্রস্তুতির সময় অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো নির্ধারণ করার পাশাপাশি একটি ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচির গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে রাজস্ব নীতি, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, শিল্পনীতি এবং বাণিজ্যব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। বাংলাদেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালা, যেখানে শুধু মূল্যস্ফীতি বা বাণিজ্য ভারসাম্যের মতো স্বল্পমেয়াদি সমস্যা নয়, বরং বৃহত্তর কাঠামোগত অসামঞ্জস্যকেও সমাধান করা হবে।
এই পটভূমিতে একটি কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব এবং দেশকে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে।
বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণ হলো অব্যাহত মূল্যস্ফীতি, যা এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক বিগত দুই বছরে বারবার সুদের হার বাড়ালেও মূল্যস্ফীতির ওপর তার খুব একটা প্রভাব পড়েনি। এর ফলে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যর্থ হয়েছে, যেখানে প্রতিবেশী দেশগুলো মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
পূর্ববর্তী সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিল, তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও এ বিষয়ে এখনো কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখাতে পারেনি।
এ ব্যর্থতার মূল কারণ হলো মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি এবং অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। নীতিনির্ধারকদের এখন বুঝতে হবে যে একটি সমন্বিত কৌশল ছাড়া এই পদক্ষেপগুলো বিচ্ছিন্ন এবং অকার্যকর থেকে যায়। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীকে সামাজিক সুরক্ষার মাধ্যমে সহায়তা প্রদান অগ্রাধিকারের শীর্ষে থাকা উচিত।
অর্থনৈতিক ইস্যুগুলোতে সমন্বয়ের অভাব নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। এটি এখনই এমন একটি সময়, যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় কার্যকর ও ব্যাপক হস্তক্ষেপ দেখাতে হবে।
বাংলাদেশের রপ্তানি এবং প্রবাসী আয় কিছুটা আশার সঞ্চার করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই খাতগুলোর ইতিবাচক প্রবণতা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে কিছুটা উন্নতি সাধন করেছে, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। তবে এ সাফল্য ধরে রাখা এবং দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব নিশ্চিত করার জন্য একটি সুসংহত এবং সমন্বিত নীতি গ্রহণ করতে হবে।
রপ্তানি খাত, বিশেষত তৈরি পোশাকশিল্প, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। কিন্তু শ্রম–অসন্তোষ, কারখানার অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন এবং শ্রমনিরাপত্তাসংক্রান্ত সমস্যাগুলো এই খাতের সুষ্ঠু কার্যক্রমের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সমস্যার কার্যকর সমাধান করা না হলে, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি এবং এর মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এর জন্য প্রয়োজন শ্রমিক অধিকার সুরক্ষা, সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা এবং শিল্প সম্পর্ক ব্যবস্থাপনায় কার্যকর সংস্কার।
রেমিট্যান্স প্রবাহ সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বৈধ চ্যানেলের ব্যবহার বাড়াতে এবং প্রবাসী আয়কে উৎসাহিত করতে ডিজিটাল ব্যাংকিং, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সেবা এবং উন্নত নীতিমালা বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। প্রবাসীদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ এবং প্রবাসীকল্যাণ তহবিলের উন্নয়নের মাধ্যমে এই প্রবাহকে আরও বাড়ানো সম্ভব।
অন্যদিকে বেসরকারি বিনিয়োগের স্থবিরতা দেশের শিল্প ও কর্মসংস্থান খাতে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। উচ্চ সুদের হার, অস্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের অভাব বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বড় বাধা। বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে বিনিয়োগ নীতি সংস্কার, কর প্রশাসন সহজীকরণ এবং আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন।
বৈদেশিক মুদ্রার বাজারও একটি উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংক আরও বাজারনির্ভর মুদ্রা বিনিময় নীতির দিকে এগোনোর সংকেত দিচ্ছে, তবে এটি সঠিক সময় এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন করা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আমদানি খরচ এবং মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বেড়ে না যায়।
এ পরিবর্তন একটি সুসংগঠিত কৌশলের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়া উচিত, যাতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং ভোক্তারা যথাযথভাবে প্রস্তুত হতে পারে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এখন পর্যন্ত শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার অভাব এই চ্যালেঞ্জগুলো সমাধানে খুব বেশি সহায়ক হয়নি।
অর্থনৈতিক ইস্যুগুলোতে সমন্বয়ের অভাব নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। এটি এখনই এমন একটি সময়, যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় কার্যকর ও ব্যাপক হস্তক্ষেপ দেখাতে হবে।
১ ডিসেম্বর জমা দেওয়া শ্বেতপত্র কমিটির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে মেগা প্রকল্পসহ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয় বিদ্যমান দুর্নীতি, অবৈধ অর্থ পাচার, ক্রোনি পুঁজিতন্ত্রের ব্যাপক প্রসার এবং বিভিন্ন অবৈধ সুবিধা গ্রহণের বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই প্রতিবেদন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল, যা এই দুর্নীতির প্রক্রিয়াগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে। প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার দুর্নীতি ও অনিয়মের মূল কারণগুলো সমাধানের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং বিচারিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার, যা সরকারের কর্মকাণ্ডের অগ্রাধিকারে প্রতিফলিত হওয়া উচিত।
৫ আগস্টের গণ-আন্দোলন জাতীয় পুনর্গঠন এবং সংস্কারের ক্ষেত্রে একটি ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার আশার সঞ্চার করেছিল। তবে বাস্তবতা ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। সংস্কারের পরিসর, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদকাল এবং পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের মেয়াদকাল নিয়ে রাজনৈতিক দল ও নতুন রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মতবিরোধ অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারের ওপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মনোযোগ বিচ্যুত করতে পারে। একটি সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ এসব সংকট মোকাবিলার প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করতে পারে, বিশেষত মূল্যস্ফীতি, যা সাধারণ নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এই পটভূমিতে নীতিনির্ধারকদের এমন পদক্ষেপ নিতে হবে, যা জনগণকে অর্থনৈতিক স্বস্তি প্রদান করবে এবং একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের জন্য একটি পথ নির্ধারণ করবে। পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত প্রচেষ্টা, সামাজিক সুরক্ষার বিস্তৃত জাল তৈরি করা এবং কৃষি, জ্বালানি এবং পরিবহন অবকাঠামোতে বিনিয়োগের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির সরবরাহের দিকের কারণগুলো মোকাবিলা করা।
একই সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্য হওয়া উচিত গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং বিচারিক খাতে সুদূরপ্রসারী সংস্কারের শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করা। অর্থনৈতিক সংস্কারের দিকগুলোয় যেমন রাজস্ব ব্যবস্থাপনার সংস্কার, করব্যবস্থার সংস্কার, ব্যাংকিং খাতের পুনর্গঠন এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগনীতির আধুনিকায়ন নিয়ে অংশীজনদের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। তবে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং বিচারিক সংস্কারের দিকগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দল ও নতুন রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মতবিরোধ স্পষ্ট।
এই মতপার্থক্যগুলো যেন অর্থনৈতিক সংস্কারের গতিকে দুর্বল না করে তা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। এই মতবিরোধগুলো যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে তা বিদ্যমান সুগভীর অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো মোকাবিলার প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক সংস্কারের ওপর যথাযথ মনোযোগ প্রদান করা এবং একই সঙ্গে অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার নিয়ে সংলাপ ও ঐকমত্য তৈরিতে মনোযোগী হওয়া। এসব দীর্ঘ অগ্রাধিকারের তালিকা সমাধানে প্রয়োজন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে সুস্পষ্ট নেতৃত্ব, কার্যকর যোগাযোগ এবং ধাপে ধাপে অগ্রগতির প্রতি প্রতিশ্রুতি।
● সেলিম রায়হান অর্থনীতির অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নির্বাহী পরিচালক, সানেম