১৯৩০-এর দশক। ভারতের মুসলমানরা আলাদা বাসভূমির জন্য ব্রিটিশের কাছে দেনদরবার করছে। তাদের দল হলো মুসলিম লীগ। ১৯৩৩ সালে খুলনার এস এম মজিদের নেতৃত্বে কলকাতায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র সমিতি তৈরি হলো। ১৯৩৫ সালে বামপন্থীরা গঠন করেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্রলীগ।
ওই বছর ডিসেম্বরে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের প্রধান নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ কলকাতায় এসে এম এ এইচ ইস্পাহানির বাসায় ছাত্র সমিতির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ কে ফজলুল হকও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
এ সভায় ছাত্র সমিতির নাম বদলে অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ বা নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ রাখা হয়। দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হন যথাক্রমে ইস্পাহানি ও মাহমুদ নূরুল হুদা। তাঁদের কাজ ছিল মুসলিম লীগের পক্ষে প্রচারণা চালানো।
১৯৪৪ সালে শামসুল হুদা চৌধুরী (সভাপতি) ও শাহ আজিজুর রহমানের (সাধারণ সম্পাদক) নেতৃত্বে বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের নতুন কমিটি হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত ভেঙে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান জন্ম নেয়। বঙ্গ প্রদেশ ভাগ হয়। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অংশ হয়। পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানে একীভূত হয়। পূর্ববঙ্গে তখন খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের সরকার। শামসুল হুদা-শাহ আজিজের ছাত্রলীগ তখন ক্ষমতাসীন সরকারের অনুগত ছাত্রসংগঠন। সরকারি ছাত্রসংগঠন হলে যা হয় আরকি। এটা হয়ে গেল সরকারের ধামাধরা। মুসলিম লীগ আর মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের নামে জিন্দাবাদ দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো কাজ নেই।
শুধু আওয়ামী লীগ নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলও তাদের ‘সহযোগী’ ছাত্রসংগঠনকে পুরোপুরি অঙ্গসংগঠন বানিয়ে ছেড়েছে। ফলে ছাত্ররাজনীতি গেছে অস্তাচলে। সাধারণ মানুষ ছাত্রনেতাদের দেখে এখন আর শ্রদ্ধা জানায় না, ভয় পায়, এড়িয়ে চলে। ছাত্ররাজনীতি এখন ইতিহাস। পুরোনোরা তার জাবর কেটে দিন গুজরান করেন।
১৯৪৭ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির নির্বাচনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমকে হটিয়ে মাওলানা আকরম খাঁ ও নাজিমুদ্দিন জয় পেয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপের তরুণেরা স্বাভাবিকভাবেই ছিলেন নাজিমুদ্দিনবিরোধী। তাঁরা ঢাকার মোগলটুলিতে মুসলিম লীগ ওয়ার্কার্স ক্যাম্পকে আশ্রয় করে সংগঠিত হতে থাকেন। তাঁদের নেতা টাঙ্গাইলের শামসুল হক। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, সরকারি ছাত্রলীগের বাইরে একটি স্বাধীন ছাত্রসংগঠন বানাবেন। এ উদ্দেশ্যে তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের মিলনায়তনে একটি ছাত্র-কর্মিসভা ডাকেন।
সভা হয় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি। ঘটনাচক্রে ওই দিন ফেনী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক নাজমুল করিম সেখানে উপস্থিত হলে তাঁকে সভাপতি করে সভার কাজ শুরু হয়। ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তৈরি হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। সভার উদ্যোক্তারা সরকারি ছাত্রলীগের ওপর ক্ষুব্ধ থাকলেও তাঁরা ছিলেন প্রচণ্ড রকম পাকিস্তানপ্রেমিক। প্রদেশের নাম পূর্ববঙ্গ হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা দলের নামের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান নামটি জুড়ে দেন।
নইমুদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক করে ১৪ সদস্যের একটি অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটি বানানো হয়। সেই কমিটিতে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিনিধিদের যুক্ত করা হয়েছিল। ফরিদপুর থেকে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এটা ছিল একটা যৌথ প্রয়াস। এখন যে ছাত্রলীগকে আমরা দেখি, তার সত্যিকার লিগ্যাসি শুরু হয় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি। এই দিনকেই ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হিসেবে উদ্যাপন করে।
ছাত্রলীগের জন্মকে সরকারি পেটোয়া সংগঠনের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তাদের অঙ্গীকার ছিল, তারা সরকার বা সরকারি দলের লেজুড় হবে না। ১৯৪৮ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে ‘পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আবেদন’ শিরোনামে একটি লিফলেট প্রকাশ করা হয়। সাংগঠনিক কমিটির ১৮ জনের নামে প্রকাশিত এই লিফলেটে বলা হয়, ছাত্রলীগে কোনো অছাত্র থাকতে পারবে না এবং ছাত্রলীগ দলীয় রাজনীতিতে অংশ নেবে না।
ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে ৭৫ বছর। এ বছর পালিত হলো সংগঠনটির প্লাটিনাম জুবিলি। একটি ছাত্রসংগঠনের এত দিন টিকে থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। এর মধ্যে হয়েছে অনেক উত্থান-পতন। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ হয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। তবে সংগঠনটি জন্মলগ্নের অঙ্গীকার থেকে সরে এসেছে। এটি আর স্বাধীন ছাত্রসংগঠন নয়।
ছাত্রলীগের জন্মের প্রায় দেড় বছর পর জন্ম নেওয়া আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন এটি। আওয়ামী লীগ এখন সরকারে। সে হিসেবে ছাত্রলীগ এখন সরকারি ছাত্রসংগঠন, যেমনটি ছিল শামসুল হুদা চৌধুরী আর শাহ আজিজের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগ। অর্থাৎ ৭৫ বছর আগের লিগ্যাসি রয়ে গেছে এখনো।
সরকারে থাকা না-থাকা নিয়ে একটি দলের চরিত্র বোঝা যায়। জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামী লীগ মাঝে দুই বছর প্রদেশে ও নয় মাস কেন্দ্রে সরকার পরিচালনা করলেও এটি ছিল মূলত বিরোধী দল। তখন লড়াই ছিল পাকিস্তানবাদের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে। তখন ছাত্রসমাজ ছিল লড়াকু। ছাত্রলীগ একপর্যায়ে হয়ে ওঠে দেশের বৃহত্তম ছাত্রসংগঠন। এটি ছিল আওয়ামী লীগের প্রধান অবলম্বন। ১৯৬০-এর দশকের ছাত্রলীগ নেতারা স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে দেশব্যাপী গণজোয়ার তৈরি করেছিলেন। তাঁরা ছিলেন ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম অনুঘটক। তাঁদের হাতে তৈরি হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি।
১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সরকার গঠিত হলে ছাত্রলীগের চালচিত্র পাল্টে যেতে থাকে। ছাত্রলীগে তখন আরেকটি ‘বিদ্রোহ’ সংঘটিত হয়, যেমনটি দেখা গিয়েছিল ১৯৪৮ সালে। সরকারসমর্থক অংশটিকেই ছাত্রলীগের মূলধারা হিসেবে স্বীকৃতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সঙ্গে জোট বাঁধে মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন। এটা ইতিহাসের সত্য যে তখন থেকেই সরকারি ছাত্রলীগ জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। সেই সঙ্গে ডোবে ছাত্র ইউনিয়নও।
তরুণেরা সহজাতভাবেই ‘অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্ট’ বা প্রথাবিরোধী। সে জন্যই ১৯৬০-এর দশকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন (এনএসএফ) কখনোই সাধারণ ছাত্রদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাদের মূল কাজ ছিল আইয়ুব-মোনেম সরকারের পক্ষে গুন্ডামি করা, বিরোধী ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের পেটানো, ছাত্রাবাসের ডাইনিং হলে মাগনা খাওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিকাদারি করা ইত্যাদি। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়।
একবার সরকারের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে দুর্নাম কুড়ালে সেখান থেকে উঠে দাঁড়ানো কঠিন। ১৯৭২ সালের পর আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ছাত্রলীগ ডাকসু নির্বাচনে কখনোই জয় পায়নি। এরশাদ-জমানায় শুধু একবার জাসদ-ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জোট বেঁধে তাদের একজন ডাকসুর সহসভাপতি হতে পেরেছিলেন। এটা দেখেই ছাত্রমনস্তত্ত্ব বোঝা যায়। তাঁরা ‘দালাল’ পছন্দ করেন না।
পাকিস্তান আমলে স্বাধীনভাবে চলার প্রতিশ্রুতি দিলেও ছাত্রলীগ ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। তা সত্ত্বেও নেতৃত্ব নির্ধারিত হতো কাউন্সিলরদের ভোটে। ১৯৭২ সালের পরে এই প্রথা অবলুপ্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের সভাপতি এখন আনুষ্ঠানিকভাবেই ছাত্রলীগের ‘অভিভাবক’। তিনিই ঠিক করে দেন ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব।
তাঁর ক্ষমতার বলে বলীয়ান হয়ে এবং তাঁর আলোয় আলোকিত হয়েই ছাত্রলীগ নেতারা দীপ্তি ছড়ান। ছাত্রলীগ এখন ছাত্রদের আওয়ামী লীগ। দল ক্ষমতায় থাকায় দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারলে অঢেল অর্থবিত্ত ও প্রতিপত্তি হাতের নাগালে চলে আসে। এ জন্য ছাত্রলীগের বিভিন্ন কমিটিতে ঢোকার জন্য অনেক আহাজারি, তদবির, উৎকোচ ও বিনিয়োগ। লোভনীয় পদ বাগানোর জন্য চলছে তুমুল প্রতিযোগিতা, রেষারেষি ও মারামারি।
কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কমিটির পদবঞ্চিতরা শাটল ট্রেন বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঢাকা কলেজে কমিটি করার দাবিতে ছাত্রলীগ কর্মীরা নিউমার্কেট থেকে সায়েন্স ল্যাবের মোড় পর্যন্ত ‘অবরোধ’ দিয়ে তুলকালাম করেছিলেন। কমিটিতে ঢুকতে পারার অর্থ হচ্ছে হাতে স্বর্গ পাওয়া। সবাই নেতা হতে চান। অবস্থা এমন হয়েছে যে নেতার ভারে মঞ্চ ভেঙে পড়ে।
‘স্মার্ট’ শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চ ভেঙে পড়তে দেখলাম সম্প্রতি। এসব নানা কারণে ছাত্রলীগ তার প্রাসঙ্গিকতা পুরোপুরি হারিয়েছে। এটি আর ছাত্রদের স্বার্থ রক্ষাকারী সংগঠন নয়।
শুধু আওয়ামী লীগ নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলও তাদের ‘সহযোগী’ ছাত্রসংগঠনকে পুরোপুরি অঙ্গসংগঠন বানিয়ে ছেড়েছে। ফলে ছাত্ররাজনীতি গেছে অস্তাচলে। সাধারণ মানুষ ছাত্রনেতাদের দেখে এখন আর শ্রদ্ধা জানায় না, ভয় পায়, এড়িয়ে চলে। ছাত্ররাজনীতি এখন ইতিহাস। পুরোনোরা তার জাবর কেটে দিন গুজরান করেন।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক