‘কান্না হাসির পোঁটলা বেঁধে, বর্ষভরা পুঁজি,
বৃদ্ধ বছর উধাও হ’ল ভূতের মুলুক খুঁজি।
নূতন বছর এগিয়ে এসে হাত পাতে ঐ দ্বারে,
বল্ দেখি মন মনের মতন কি দিবি তুই তারে?
আর কি দিব?—মুখের হাসি, ভরসাভরা প্রাণ,
সুখের মাঝে দুখের মাঝে আনন্দময় গান।’
আমাদের শৈশব-কৈশোর ছিল ছড়া-কবিতা আওড়ানোর দিন। মা-বাবা কিংবা বড়রা মুখে মুখে আমাদের ছড়া-কবিতা শেখাতেন। কবি সুকুমার রায়ের এই কবিতার কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। কবিতাটার নামও হলো ‘মনের মতন’। নতুন বছর সবার মনের মতন হবে, সেটিই তো সবার চাওয়া। আরেকটি বছর ‘বৃদ্ধ’ হতে চলল। একটা দিন পর আগমন ঘটবে নতুন বছরের।
কালবদলের হাওয়ায় কৃষিভিত্তিক ঋতু-পার্বণের দেশে এখন খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারের ‘আধিপত্য’। পয়লা বৈশাখের পাশাপাশি খ্রিষ্টীয় নববর্ষের আগমনও এখানে উৎসব হিসেবে জোরেশোরে হাজির। কিন্তু উৎসব বলতে যা আমরা বুঝে থাকি, তার হালহকিকত নিয়ে কিছু কথা থেকেই যায়।
বাংলা পঞ্জিকার নানা মৌসুমে এখনো গ্রামগঞ্জে নৌকাবাইচ, ঘোড়দৌড়, লাঠিখেলার রেওয়াজ একেবারে হারিয়ে যায়নি। আনাচে-কানাচে কোনো পীরের ওরস, পূজা-পার্বণের মেলা, নানা জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে ঘিরে এখনো আমরা উৎসব দেখি। গ্রামবাংলার সেই উৎসব নগরে বরাবরই গরহাজির। তারপরও একসময় মাঠ ছিল, পুকুর ছিল, ছিল তরুণদের ক্লাব বা সংগঠন। ঈদের দিন নগরবাসীর আনন্দমিছিল, ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.), একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসের কত কত আয়োজন। একেক মহল্লার একেক রং, একেক গন্ধ, একেক ঢং।
এখন সেই মাঠ, পুকুর, ক্লাবঘর কিছুই নেই। কিশোর-তরুণদের বেহুদা ঘোরাঘুরি ও ছোটাছুটিও ঢুকে গেছে স্ক্রিনে। নগরের উৎসব সংকুচিত হতে হতে এখন একচিলতে ছাদের মধ্যে এসে ঠেকেছে। সেখানে নেই অবারিত ছোটাছুটির স্বাধীনতা। তবে সেই ছাদেও যে উদ্যাপনের স্বাধীনতা দানা বেঁধে মজবুত হয়ে উঠেছে, তা ভালো করে টের পাওয়া যায় িখ্রষ্টীয় নববর্ষের আগমনমুহূর্তে, মানে থার্টি ফার্স্ট নাইটে।
একটা সময় পশ্চিমা সংস্কৃতি বলে আমাদের পরিবার ও সমাজে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদ্যাপনকে নিরুৎসাহিত করা হলেও সেই বাস্তবতা এখন আর নেই। বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয় ঢুকে যাওয়ায় দেশি-বিদেশি সব সংস্কৃতি, উৎসব-উদ্যাপন মিলেমিশে একাকার।
আর আধুনিক নগরসমাজের বাসিন্দারা এখন আরও বেশি যান্ত্রিক, পুঁজি ও করপোরেট দাসত্বের ঘানি টেনে আরও বেশি ক্লান্ত, নির্বিকার, নির্লিপ্ত। সেখানে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নাগরিক অধিকার ও বাক্স্বাধীনতায় নানা বাধাও। ফলে ভেতর-বাইরে তৈরি হওয়া নানা হাঁসফাঁস থেকে মুক্তি পাওয়ার এক তীব্র ঘোষণাই যেন আমরা দেখি ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর ছাদগুলোতে থার্টি ফার্স্ট নাইটে।
থার্টি ফার্স্ট নাইট উদ্যাপন বরাবরই নগরকেন্দ্রিক। পশ্চিমা বড় শহরগুলোতে এই রাতের আমেজ বেশি ধরা দেয়। নগর কর্তৃপক্ষ নিজেরাই সেখানে নববর্ষ বরণের নানা আয়োজন করে। আতশবাজি ফোটানো হয়, এর জন্য নির্দিষ্ট জায়গা ও এলাকাও থাকে। এরপরও কি উৎসবকে নিয়মের মধ্যে আটকে রাখা যায়?
নগরের উৎসব সংকুচিত হতে হতে এখন একচিলতে ছাদের মধ্যে এসে ঠেকেছে। সেখানে নেই অবারিত ছোটাছুটির স্বাধীনতা। তবে সেই ছাদেও যে উদ্যাপনের স্বাধীনতা দানা বেঁধে মজবুত হয়ে উঠেছে, তা ভালো করে টের পাওয়া যায় খ্রিষ্টীয় নববর্ষের আগমনমুহূর্তে, মানে থার্টি ফার্স্ট নাইটে
দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের আইনি সহায়তা দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থার একটি প্রতিবেদন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে ছুটির দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম বিপজ্জনক দিন এটি।
বড়দিন থেকে থার্টি ফার্স্ট নাইট পর্যন্ত এ কয় দিনে গুরুতর জখম বেড়ে যায় ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত, মৃত্যুর ক্ষেত্রে সেই হার দেখা গেছে ৩৮ শতাংশ। মাতাল হয়ে গাড়ি চালানোর কারণে এ কয় দিনে দুর্ঘটনায় মারা যায় দু-তিন শ লোক।
বড় শহরগুলোতে আতশবাজি উৎসব নিয়ে পরিবেশবিদেরা সব সময় শঙ্কিত থাকেন। ২০২১ সালের ইতালির রোমে বিপুল আতশবাজি উৎসবে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। আতশবাজির শব্দে রাস্তায় শত শত পাখি মরে পড়ে ছিল।
এই ঘটনাকে ‘গণহত্যার’ সঙ্গে তুলনা করেছিল প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থা। থার্টি ফার্স্ট নাইটে পাখিদের মৃত্যু নিয়ে এ রকম আরও উদাহরণ আছে।
আর ভারতের বড় শহরগুলোতে নানা উৎসবে আতশবাজি ফোটানো নিয়ে কী ভয়াবহ কাণ্ড ও দুর্ঘটনা ঘটে যায়, তা তো আমাদের জানাই আছে। যে কারণে সেখানে পরিবেশবান্ধব আতশবাজির চল বাড়ছে। এমনকি কতক্ষণ আতশবাজি ফোটানো যাবে, সেই সময়ও বেঁধে দেওয়া হচ্ছে।
পুলিশের নানা বিধিনিষেধের মধ্যেও এ রাতে ঢাকার আকাশ আলোকিত হয়ে যায় আতশবাজি আর ফানুসে। গত বছর এক বন্ধুর আমন্ত্রণে ছিলাম এক ছাদ উদ্যাপনে। গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে যেভাবে বাজি ও আতশবাজি ফোটানো হলো, তা দেখে শঙ্কিত হয়ে ছাদের এক কোনায় ঝিম মেরে বসেছিলাম। আর কাছেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাখিগুলোর জন্য মায়া হচ্ছিল বড্ড। এই ঢাকা শহরে পাখিদের বসবাস বলতে গেলে তো এ কয়েকটি জায়গাতেই।
দুই বছর আগে আতশবাজির শব্দে অসুস্থ হয়ে এক শিশুর মৃত্যুর কথা নিশ্চয়ই আমরা অনেকে ভুলিনি।
গত কয়েক বছরে ফানুসের আগুনে পুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ছাই হয়ে গেছে, এমন অনেক ঘটনা আছে। ঢাকার মতো ঘনবসতি ও বহুতল কংক্রিটের জঙ্গলের এ শহরে ফানুসের আগুন কী ভয়াবহ, সেটি আমরা কখন বুঝব? গত বছর তো বৈদ্যুতিক তারে ফানুস এসে পড়ার কারণে মেট্রোরেলই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল দুই ঘণ্টা।
পুলিশ নিষেধাজ্ঞা দেয়, আতশবাজি ও পটকা ফোটানো এবং ফানুস ওড়ানো যাবে না। কিন্তু নগরবাসীর উৎসব-উদ্যাপনের জন্য কোনো পথ কি খোলা রেখেছেন তাঁরা? নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও এত আতশবাজি ও ফানুস বিকিকিনি কীভাবে হয়, সেটিও দেখার বিষয়। আর আতশবাজি বা ফানুস ছাড়া আরও নানাভাবেই উৎসব উদ্যাপন করা যায়, সেটিও কেন আমরা ভাবব না। আমরা আর কত বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণের রেকর্ডের কালিমা বয়ে বেড়াব।
এ রাতের ‘বেপরোয়া’ উদ্যাপনকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এ শহর আরও বিপর্যস্ত হবে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। একটি শিশু বা একটি পাখিও শঙ্কিত হবে না, এমনই হোক আমাদের উদ্যাপন।
● রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী