সেদিন গভীর রাতের ঘটনাটি শুরুতে বলে নিই। কারওয়ান বাজারের সবজির ট্রাকের জ্যাম ঠেলে কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউতে ওঠার কসরত করছিল আমাকে বহন করা সিএনজিচালিত অটোরিকশাটি। শরীর-মনে সারা দিনের কাজের ধকল। এখন ভালোয় ভালোয় ঘরে পরিবারের কাছে পৌঁছাতে পারলেই হয়।
মালবাহী ভ্যানের ক্রিং ক্রিং, সিএনজি অটোরিকশার পোঁ পোঁ, প্রাইভেট গাড়ির ভোঁ ভোঁ, কাভার্ড ভ্যানের ক্রিক ক্রিক—কত রকমের যে আওয়াজ! রাতে যেখানে নীরবতা কাম্য, সেখানে উল্টোপাল্টা সব কারবার।
হঠাৎ পেছন থেকে একটা ট্রাক নাকি বাস বিকট হর্ন বাজাল। একেবারে কেঁপে ওঠা বলতে যা বোঝায়, আমার শরীর ঠিক তেমনভাবে প্রতিক্রিয়া জানাল। মনে হলো, শরীরের ভেতরে শিরা-উপশিরা যা যা আছে, বুঝি এবার ফেটে গেল!
রাতে সারা দেশ থেকে আসা সবজির ট্রাক কারওয়ান বাজারে ঢোকে। রাত ১২টার পরে এই বাজার ও সংলগ্ন এলাকায় জ্যাম নিত্যদিনের চিত্র। কোনো ধরনের শৃঙ্খলা না থাকায় এই জ্যাম যেন ছুটতেই চায় না। বসে বসে নিজের বিধিলিপিকে দোষ দেওয়া ছাড়া কোনো পথ থাকে না। আমার মনের অবস্থাও সেদিন ও রকমই ছিল। ঠিক এমন সময় ওই চিড়িক দেওয়া হর্ন; সামনে এগোনোর পথ নেই, চালক তা জানেন, রীতিমতো দেখতে পাচ্ছেন, তারপরও এই অপ্রয়োজনীয়, অকারণ হর্ন তিনি বাজালেন। একবার নয়, একাধিকবার!
আজকাল রাজধানীতে মধ্যরাতেও শান্তি নেই। প্রচুর যান্ত্রিক যানবাহন রাতে চলাচল করছে এবং রীতিমতো জ্যাম লেগে যাচ্ছে। হানিফ উড়ালসড়কে রাত দুইটার সময়ও জ্যাম লেগে যায়। অনেকের হয়তো বিশ্বাস হবে না, কিন্তু এটাই সত্য। আর গাড়ির বাড়বাড়ন্ত উপস্থিতির মানেই হর্নের অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
আজকাল দুনিয়ায় যেখানে হর্ন না দিয়ে গাড়ি চালানোর রেওয়াজ চলছে, সেখানে আমরা অপ্রয়োজনে হর্ন দিয়েই চলেছি। ভালোর চর্চা আমরা কি শুরু করতে পারব না? এই শব্দ বিস্ফোরণ যে পাশের মানুষের কতটা ক্ষতি করছে, তা বোঝার, উপলব্ধি করার কোনো ইচ্ছা যেন আমাদের নেই। আজকাল পথেঘাটে কোনো বাস বা কারচালককে অপ্রয়োজনে হর্ন দেওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে উল্টো তাঁরা আরও দুই–একবার বেশি হর্ন বাজিয়ে জবাব দেন, এই হলো অবস্থা। কে যায় কার সঙ্গে তর্ক করতে!
শুধু বধিরতা নয়, সারা দিন উচ্চ শব্দের ভেতরে থাকা হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। যাঁদের হৃদ্রোগ রয়েছে, যাঁরা মাথাব্যথার রোগী, তাঁরাও গুরুতর ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। এসব মানুষের সংবেদনশীলতার জায়গাগুলো যেন আমরা একটু উপলব্ধি করার চেষ্টা করি।
২.
সড়ক পরিবহন বিধিমালা, ২০২২-এর বিধি-৮১ অনুযায়ী, অ্যাম্বুলেন্স, অগ্নিনির্বাপণ বা উদ্ধারকাজে ব্যবহৃত মোটরযান অথবা রাষ্ট্রীয় জরুরি কাজে ব্যবহৃত মোটরযান ছাড়া অন্য যেকোনো মোটরযানে বহুমুখী হর্ন অথবা তীব্র, কর্কশ, আকস্মিক, বিকট বা ভীতিকর শব্দের হর্ন কিংবা যন্ত্র সংযোজন বা ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
কিন্তু এই বিধিমালার তোয়াক্কা করছে কে! যেকোনো ক্ষেত্রে আইন বা বিধির কমতি নেই আমাদের। কিন্তু একে মান্যতা দেওয়া, বাস্তবায়ন করানোর ক্ষেত্রে আমাদের পারদর্শিতা সফলভাবে একপ্রকার ব্যর্থ! আর এই বিধিমালা নিয়েও কথা বলতে হবে। রাষ্ট্রীয় জরুরি কাজে ব্যবহৃত গাড়ি কেন ভীতিকর হর্ন ব্যবহারের সুযোগ পাবে? কোনো প্রয়োজন আছে কি?
তা ছাড়া এই বিধিমালার আগেই উচ্চ আদালত রাজধানীতে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছেন। ট্রাফিক পুলিশ সে সময়ে কিছু তৎপরতাও দেখিয়েছিল মনে পড়ে।
কিন্তু এই ‘শব্দ যন্ত্রণা’র ব্যবহার কি থেমেছে? রীতিমতো ব্যবহৃত হচ্ছে। গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রির দোকানগুলোতে হরদম এই নিষিদ্ধ হর্ন বিক্রি হচ্ছে। সেখানে যন্ত্রগুলো উড়ে আসেনি। বাইরের কোনো দেশ থেকে আমদানি হয়েই এসেছে। কে দেখবে, কে ব্যবস্থা নেবে, জানি না। আগে ট্রাফিক পুলিশ মামলা দিয়ে, জরিমানা করে দায় সারত। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুলিশ এখনো পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাচ্ছে না। কত দিন এমন চলবে, সেটা একটা প্রশ্ন। কিন্তু বেশি দিন এমন অবস্থা চলতে পারে না।
৩.
হাইড্রোলিক হর্ন হচ্ছে উচ্চমাত্রার শব্দ সৃষ্টিকারী বিশেষ হর্ন। আমেরিকান স্পিচ অ্যান্ড হিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন (আশা) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, মানুষের জন্য শ্রবণযোগ্য শব্দের সহনীয় মাত্রা সর্বোচ্চ ৪০ ডেসিবল। কিন্তু হাইড্রোলিক হর্ন শব্দ ছড়ায় ১২০ ডেসিবল পর্যন্ত। এর স্থিতি ৯ সেকেন্ডের বেশি হলে ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। দেশের শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা অনুসারে, রাজধানীর মিশ্র (আবাসিক ও বাণিজ্যিক) এলাকায় দূষণের সর্বোচ্চ মাত্রা ৬০ ডেসিবল।
চিকিৎসকেরা বলছেন, যাঁরা অতিরিক্ত শব্দ এলাকার মধ্যে বসবাস করেন, তাঁদের কানের নার্ভ ও রিসেপ্টর সেলগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে মানুষ ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি হারাতে থাকে। মানুষ সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ ডেসিবল শব্দে কথা বলে। ৭০ ডেসিবল পর্যন্ত মানুষের কান গ্রহণ করতে পারে। ৮০–এর ওপরে গেলেই ক্ষতি শুরু হয়। প্রতিদিন ২ ঘণ্টা করে ৮৫ ডেসিবেল শব্দ যদি কোনো ব্যক্তির কানে প্রবেশ করে, তাহলে ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি নষ্ট হবে। ১২০ ডেসিবল শব্দ সঙ্গে সঙ্গে কান নষ্ট করে দিতে পারে।
জানি না, সেদিন সেই ট্রাকচালক মহাশয়ের হর্ন কত ডেসিবলের ছিল। আমি নিজেও কানের সমস্যায় ভোগা মানুষ। তাই আমি হয়তো সহ্য করতে পারিনি। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে কতসংখ্যক মানুষের শ্রবণশক্তি নষ্ট হচ্ছে, কতসংখ্যক মানুষ প্রতিদিন একটু একটু করে বধিরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য বা গবেষণা আছে কি?
শুধু বধিরতা নয়, সারা দিন উচ্চ শব্দের ভেতরে থাকা হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। যাঁদের হৃদ্রোগ রয়েছে, যাঁরা মাথাব্যথার রোগী, তাঁরাও গুরুতর ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। এসব মানুষের সংবেদনশীলতার জায়গাগুলো যেন আমরা একটু উপলব্ধি করার চেষ্টা করি।
৪.
এখন দেশে আমরা নতুন একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যা খুবই ইতিবাচক।
এমন পরিস্থিতিতে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সক্রিয়ভাবে কাজ করার জন্য এই সরকারের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা মহোদয়কে অনুরোধ জানাব। কারণ, এমন অত্যাচার বেশি দিন চলতে পারে না। দেখুন, একটু সচেতনতাই পারে শব্দদূষণ অনেকখানি কমিয়ে আনতে। কিন্তু সচেতনতা তো এমনি এমনি আসবে না। বিধির যথাযথ প্রয়োগ মানুষকে সচেতন করতে পারে। আর হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধে কেবল ট্রাফিক পুলিশ নয়, বিআরটিএর বিশেষ পদক্ষেপ দরকার, যেহেতু পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করে তারাই। শিগগিরই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক