কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: বাংলাদেশ দলের অর্জনের পেছনের গল্পটা সহজ ছিল না

জাতীয় পতাকা হাতে সাফল্যজয়ী বাংলাদেশ দলছবি: লেখক

সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে প্রায় তিন হাজার আসনের কিং আবদুল আজিজ আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে যখন প্রথম আন্তর্জাতিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অলিম্পিয়াডের পুরস্কার ঘোষণা করা হচ্ছে, তখন ২৫টি দেশের প্রায় এক শ প্রতিযোগী দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছে পুরস্কারের প্রত্যাশায়। বলতে গেলে প্রতিযোগীদের প্রায় সবাই মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের চারজন প্রতিযোগী, যাদের তিনজন কেবল একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে।

প্রতিযোগিতার দুটি ভাগ। প্রথম ভাগের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জ্ঞান লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা হয়। এটিকে বলা হয় ‘সায়েন্টিফিক রাউন্ড’। আলাদা দিনে অনুষ্ঠিত হয় ‘প্র্যাকটিক্যাল রাউন্ড’ নামে দ্বিতীয় ভাগের প্রতিযোগিতা। এই দুই ভাগের নম্বর যোগ করে চূড়ান্ত র‍্যাঙ্কিং তৈরি করা হয়।

এবারের আসরের প্র্যাকটিক্যাল রাউন্ডে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় আগুনের কারণে পুড়ে যাওয়া অঞ্চল, সেখানকার বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, জনসংখ্যার ঘনত্ব—ইত্যাদি ডেটা দেওয়া হয়েছিল। প্রতিযোগীদের বলা হয়েছিল, ভবিষ্যতে কোন কোন স্থানে আগুন লাগতে পারে, তার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য। আয়োজকেরা নিজেরাই একটা ভালো রকমের সমাধান তৈরি করে রেখেছিল। প্রতিযোগীদের সমাধান আয়োজকদের করা সমাধান থেকে ভালো হলেই কেবল নম্বর পাওয়া যাবে, অন্যথায় শূন্য নম্বর।

ফলাফল ঘোষণায় দেখা গেল, বাংলাদেশের দল দুটি রৌপ্যপদক ও দুটি ব্রোঞ্জপদক অর্জন করল। আমাদের পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিযোগীরা দেশের পতাকা হাতে মঞ্চে গিয়ে একের পর এক পদক নিয়ে আসে আর দলনেতা হিসেবে আবেগাপ্লুত আমি আশপাশে আরবি ভাষায় বলা ফিসফিস থেকে একটি শব্দই শুধু বুঝতে পারি, ‘বাংলাদেশ’।

নিউজিল্যান্ডের দলনেতা তখনই আসন ছেড়ে আমার কাছে এসে জানতে চাইলেন, আমরা কী করি? কীভাবে প্রস্তুতি নিই? আমেরিকার দলনেতা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থেকে অভিনন্দন জানালেন। মাত্র দুটি দেশের সব সদস্য কোনো না কোনো পদক পেয়েছে। একটি হাঙ্গেরি, অপরটি বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ দলের এই অর্জনের পেছনের গল্পটা খুব সহজ ছিল না, আছে ব্যর্থতার গল্পও। এবার প্রথমবারের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অলিম্পিয়াড ঘটনাক্রমে দুই জায়গা থেকে আয়োজন হয়ে যায়। প্রথমটি বুলগেরিয়ায়, পরেরটি সৌদি আরবে। বেশ কিছু বছর ধরে বাংলাদেশ গণিত, রোবট, ফিজিক্স, ইনফরমেটিকসসহ বিভিন্ন অলিম্পিয়াডে ভালো ফল করায় আয়োজক দেশগুলো বাংলাদেশকে সমীহের চোখেই দেখে।

বুলগেরিয়ার আয়োজক কমিটি নিজ থেকেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু আয়োজনের জন্য যে সময় পাওয়া যায়, সেটি খুবই কম। তারপরও আমরা এই আয়োজনে যুক্ত হওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি। অনলাইন প্রতিযোগিতা থেকে নির্বাচিত ৫০ জন নিয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় মূল প্রতিযোগিতা। সেখান থেকে বাছাই করা হয় প্রথম ১০ জন। তাদের প্রশিক্ষণ, ক্যাম্প, মেন্টরিং শেষে নির্বাচিত হয় বাংলাদেশ দলের মূল চারজন প্রতিযোগী।

অন্য দেশগুলো যে সময়ে নিজেদের প্রস্তুত করতে ব্যস্ত, তখন আমাদের নামতে হয় ভিসা পাওয়ার যুদ্ধে। সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ভিসা–জটিলতা কাটিয়ে অবশেষে বুলগেরিয়ায় যাওয়ার একটা ব্যবস্থা হলো। এর মধ্যে আমাদের দলকে অনলাইন-অফলাইনে প্রশিক্ষণ দিতে থাকল দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা, নামকরা তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী-প্রকৌশলীরা। তাঁদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা।

বুলগেরিয়ায় গিয়ে দেখা গেল, মূল প্রতিযোগিতার আগে অনলাইনে বাংলাদেশ দলের জমা দেওয়া কিছু সমাধান নিয়ে মোটামুটি গবেষণা করে বসে আছে সিঙ্গাপুরসহ আরও কয়েকটি দেশ। সেসব দেখে বুঝতে পারি, আমাদের দলের অবস্থা বিশ্বের অন্যান্য দলের তুলনায় খারাপ বলা যাবে না। কিন্তু মূল প্রতিযোগিতায় নির্দেশনাগত অসামঞ্জস্য ও অব্যবস্থাপনায় আমাদের দল কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেতে ব্যর্থ হয়। দলের সবার মনোবল ভেঙে পড়ে। তবে সেখানে পদক না পেলেও এটুকু বুঝতে পারি যে আমাদের দলের অবস্থা বিশ্বের অন্য দেশগুলোর তুলনায় খারাপ নয়।

ঠিক এক মাস পরই আমরা যাত্রা করি সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে। সেখানে পৌঁছে প্রতিযোগিতার আগের রাতেও চলে অনুশীলন। বুঝতে পারি, এবার সফল হওয়ার জন্য দলের সদস্যরা চেষ্টার ত্রুটি রাখতে চায় না। তাদের সেই অদম্য মানসিকতা, পরিশ্রম ও মেধার বদলে বাংলাদেশ প্রথম আয়োজন থেকেই চার-চারটি পদক নিয়ে আসে।

তবে শুধু শহরকেন্দ্রিক প্রশিক্ষণ বা প্রতিযোগিতা আয়োজন করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। ভবিষ্যতে কী করে আমরা পুরো বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্যোগ নিতে পারি, সেটি নিয়ে সব পর্যায় থেকে কাজ করতে হবে। অন্য দেশের দলনেতাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি, অল্প করে হলেও প্রশিক্ষণ শুরু করতে হবে ছোটবেলা থেকেই। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহ রাখা খুব জরুরি। এতে করে শিক্ষার্থীরা অনলাইন টিউটরিয়াল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনলাইনেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণের সুযোগ পাবে।

স্কুলের লাইব্রেরিতে সংশ্লিষ্ট বইপুস্তক রাখা, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রোগ্রামিং প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি করা, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা, স্থানীয় পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কর্মশালা পরিচালনা করা—ইত্যাদি উপায়ে সবাই ভূমিকা রাখতে পারেন।

সবাইকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিখতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু যে শিক্ষার্থীর প্রোগ্রামিংয়ে আগ্রহ আছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় আগ্রহ আছে, সেটিতে যেন সে বৈশ্বিক পর্যায়ের দক্ষতা অর্জন করতে পারে, সে সুযোগটুকু সৃষ্টি করে দেওয়া আমাদের সবার দায়িত্ব। সুযোগ পেলে আমাদের শিক্ষার্থীরা কী করতে পারে, সে প্রমাণ তারা রিয়াদের কিং আবদুল আজিজ সম্মেলনকেন্দ্রে ইতিমধ্যে দিয়ে এসেছে।

  • ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক

ই-মেইল: [email protected]