একটি ভৌগোলিক এলাকা হিসেবে আমাদের জনপদ বারবার বাইরের শক্তির দ্বারা আক্রান্ত ও দখল হয়েছে। আমরাও বারবার দখলমুক্ত হয়েছি। শেষবার আমাদের জনপদ পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে মুক্ত হয় ১৯৭১ সালে। এরপর থেকে বাংলাভাষীরাই বাঙালিদের শাসক। এই পরিবর্তনটুকুর জন্য আমাদের জনপদকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। স্বাধীনতার জন্য এত মূল্য খুব কম জনগোষ্ঠীকেই দিতে হয়।
আমরা বুক ফুলিয়ে বলি, একাত্তরে আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। ইতিমধ্যে পাঁচ দশক পেরিয়ে গেছে। দেশে শত বছরমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা হচ্ছে। আমাদের নজর এখন পরবর্তী শতকের দিকে।
একাত্তরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৬৬ দিনের যুদ্ধের অনেক গল্প বা ইতিহাস এখনো অজানা। আমরা যেটুকু ছুঁতে পেরেছি, তাকে বলা যায় ‘টিপ অব দ্য আইসবার্গ’। যত দিন যাচ্ছে, ততই নতুন নতুন তথ্য আমাদের হাতে আসছে।
আমরা একাত্তরের বহুমাত্রিকতার নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করছি। কবি মাশুক চৌধুরীকে উদ্ধৃত করে বলা যায়:
শতাব্দী পেরিয়ে যাচ্ছে
মুক্তিযুদ্ধের এই গল্পটা আজো বলা হয়নি
গল্পটা এক শ বছর পরে হলেও
একদিন বাকমুক্ত হবে।
২.
ডিসেম্বর হলো আমাদের বিজয়ের মাস। আমরা ৯ মাসে অনেক স্বজন হারিয়েছি। আবার এ মাসেই আমরা হানাদারমুক্ত হয়েছি। ডিসেম্বর এলেই আমরা স্মৃতিকাতর হই। ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যাই ৫১ বছর আগে, যখন এই জনপদ হয়ে উঠেছিল অশান্ত ও অগ্নিগর্ভ। চারদিকে বারুদের গন্ধ আর ছড়ানো–ছিটানো অসংখ্য মৃতদেহ। তার মধ্য দিয়ে জেগে উঠেছিল এক নবীন রাষ্ট্র। বদলে গিয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্র।
যত দিন যায়, আমাদের মধ্যে নতুন নতুন প্রশ্ন জাগে। আমরা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। কেউ কেউ ইতিহাস বিকৃত করছেন বলে কথা উঠেছে। ইতিহাস কি লেখা হয়ে গেছে? এটি কি এক দিনে লেখা হয়ে যায়? এটি একটি নিরন্তর অনুসন্ধান। ডিসেম্বরে আমরা স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু কীভাবে হলাম? একাত্তরকে দেখার একাধিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। ডিসেম্বরের যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বের পটভূমি নিয়েও আছে অনেক আলোচনা ও বাহাস। মনে অনেক প্রশ্ন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের সৈন্যরা যদি আচমকা আঘাত না করত, ভারত যদি সীমান্ত খুলে না দিত, তরুণেরা যদি লড়াই না করত, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর আর পুলিশের বাঙালি সদস্যরা যদি বিদ্রোহ না করত, তাহলে কী হতো?
ডিসেম্বরের পটভূমি একাত্তরের মার্চে তৈরি হয়নি। তৈরি হয়েছে অনেক আগে থেকেই। নানান সময়ে তার বাঁকবদল হয়েছে। ডিসেম্বরে আমরা তার একটা চূড়ান্ত পরিণতি দেখি। শুধু ডিসেম্বরে এ দেশে যাঁদের রক্ত ঝরেছে, তার একটা বড় অংশ হলো ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বুকের রক্ত। একাত্তরে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে সমীকরণ তৈরা হয়েছে এবং ডিসেম্বরে যার পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে, তা দুই দেশের মধ্যে তৈরি করেছে এক অমোঘ বন্ধন। একই সঙ্গে তৈরি হয়েছে নানান জটিলতা। এটি না বুঝলে একাত্তরকে বোঝা যাবে না।
পাশাপাশি আরেকটা দিকও ভাবি। ২৫ মার্চের আক্রমণ ছিল অনিবার্য। ভারতের সীমান্ত খুলে দেওয়া কোনো ম্যাজিক নয়। তরুণেরা না বুঝে যুদ্ধ করেনি। ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বাঙালি সৈনিকেরা সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেনি। তবে ২৫ মার্চের আক্রমণ আর ভারতের সীমান্ত খুলে দেওয়ার শর্ত দুটির কোনো একটি অনুপস্থিত থাকলে তরুণেরা কী করত? রাজনীতিবিদেরা কী করতেন?
একটি রক্ষণশীল সমাজে বিরাজমান ধ্যানধারণাকে প্রশ্ন করা যায় না। প্রশ্নহীন সমাজ বদ্ধ জলাশয়ের মতো। সেখানে তরঙ্গ নেই। মানুষের চিত্তের ক্ষুধা এমনই যে সে প্রশ্ন করবেই। সব প্রশ্নের জবাব মেলে না কিংবা জবাব পছন্দসই হয় না। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধে ভারত জড়িয়ে পড়েছিল। এটি নিরেট সত্য। এর সঙ্গে মিশে আছে কিছু স্পর্শকাতর বিষয়।
একাত্তর নিয়ে পাকিস্তানের বয়ান হলো পাকিস্তানের দুই অংশে কিছু ভুল–বোঝাবুঝি হয়েছে। এর সুযোগ নিয়ে ভারত ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তান ভেঙে দিয়েছে। ফলে তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ। ভারতের অনেক রাজনীতিবিদ ও সমরনায়ক মনে করেন, ১৯৭১ সালে ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধে পাকিস্তান হেরেছে। ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তাঁদের ভাষ্য হলো পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা, আমলাতন্ত্র ও পুঁজির শোষণে নির্যাতিত হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান। ফলে জন্ম নিয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে, প্রতিরোধ করেছে? রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশ। ভারত এ লড়াইয়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে।
এই তিন ভাষ্যের কোনটি ঠিক? নাকি তিনটি উপাদানেই তৈরি হয়েছে একাত্তরের আখ্যান? এখানেই প্রশ্ন জাগে, ভারত ফ্যাক্টর কতটা বড়, কতটা গভীর ও কতটা নির্ণায়ক ছিল। একাত্তরে আরও একটি বিষয় ছিল। তখন দুনিয়াজুড়ে চলছে শীতল লড়াই। দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজ নিজ প্রভাববলয় তৈরি ও বিস্তারে ছিল মরিয়া। তারা বাংলাদেশকে নিয়ে একটা ‘প্রক্সি ওয়ার’ বা ছায়াযুদ্ধে নেমেছিল। এর ফলে ভারত আর পাকিস্তানে যুদ্ধ বেধে যায়। এই যুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষ নেয় ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন, পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।
৩.
বাঙালি একদিন হঠাৎ জেগে উঠল, যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল, প্রবাসে সরকার গঠিত হলো, ১১টি সেক্টরে যোদ্ধারা লড়ে গেলেন। ৯ মাসের যুদ্ধে দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। বিষয়টি কি এতই সরল? এটা অস্বীকার করার জো নেই, মুজিব–ভুট্টো–ইয়াহিয়া ছিলেন একাত্তরের প্রধান চরিত্র কিংবা অনুঘটক। তাঁরা কোনো সমঝোতায় আসতে পারেননি। সমঝোতা কেন হলো না? তাঁরা তিনজন কখনোই একসঙ্গে বসে আলোচনা করেননি। আলোচনা হয়েছে দ্বিপক্ষীয়। একান্ত বৈঠকে তাঁরা একজন আরেকজনকে কী বলেছেন, তা তাঁরা নিজেরা না জানালে আমরা কেউ জানতে পারব কি? আমরা আন্দাজে শুধু ঢিল ছুড়তে পারব।
‘বিটুইন দ্য লাইনস’ বলে একটা কথা আছে। এর অর্থ হলো যা দেখেছি বা পড়েছি, তার বাইরেও অনেক কিছু আছে। অনেক কথার গূঢ় অর্থ থাকে। আবার অনেক কথা থেকে যায় ঊহ্য বা অপ্রকাশিত। একজন নেতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বা সংবাদ সম্মেলনে বা বিবৃতিতে যা বলেন, সেটাই সব নয়। একটা জটিল পরিস্থিতিতে তিনি জনসমক্ষে অনেক কিছুই প্রকাশ করেন না। অবস্থান ও শক্তি বুঝে তুরুপের তাস তিনি নিজের হাতে রেখে দিতে চান। প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করতে চান। এটা রাজনীতিরই একটা কৌশল। বাঙালির নেতা শেখ মুজিবের অনেক কথাই আমাদের জানার সুযোগ নেই। তিনি অনেক কিছু বলেননি বা সহকর্মীদেরও বলে যাননি। এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চার একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
ডিসেম্বরের পটভূমি একাত্তরের মার্চে তৈরি হয়নি। তৈরি হয়েছে অনেক আগে থেকেই। নানান সময়ে তার বাঁকবদল হয়েছে। ডিসেম্বরে আমরা তার একটা চূড়ান্ত পরিণতি দেখি। শুধু ডিসেম্বরে এ দেশে যাঁদের রক্ত ঝরেছে, তার একটা বড় অংশ হলো ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বুকের রক্ত। একাত্তরে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে সমীকরণ তৈরা হয়েছে এবং ডিসেম্বরে যার পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে, তা দুই দেশের মধ্যে তৈরি করেছে এক অমোঘ বন্ধন। একই সঙ্গে তৈরি হয়েছে নানান জটিলতা। এটি না বুঝলে একাত্তরকে বোঝা যাবে না।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক