৪৩তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্যে ২৬৭ জনকে বাদ দেওয়ার খবরে বেশ কিছু প্রশ্ন আমাকে পোড়াচ্ছে। যেসব প্রার্থী এক বছর ধরে সরকারি চাকরিতে যোগদানের বিভোর ছিলেন, অনেকেই ভালো চাকরির অফার পেয়েও কেবল বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ায় সেগুলো প্রত্যাখ্যান করেছেন, অনেকে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পর আগের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, এই খবর সেই সব অভাগা প্রার্থীর জন্য বেশ উদ্বেগজনক ও হতাশারও বটে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ৪৩তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্তদের গত বছরের ১৫ অক্টোবর পুলিশের বিশেষ শাখা এবং জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে প্রার্থীর প্রাক্-চরিত্র যাচাই-বাছাই করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সেই ধাপে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অনুপস্থিত ৪০ জন এবং এজেন্সির প্রতিবেদন বিবেচনায় ৫৯ জন মিলিয়ে মোট ৯৯ জনকে বাদ দিয়ে বাকি ২ হাজার ৬৪ জনকে চলতি বছর যোগদানের কথা বলে। কিন্তু যোগদানের মাত্র দুদিন আগে আবার অকস্মাৎ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আরও ২২৭ জনকে বাদ দেওয়ার খবর শুধু কর্ম কমিশনকে বিতর্কিত করছে না, বরং সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হচ্ছে, প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এ নিয়োগের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে থেকে ‘ক্লিন ইমেজ’–এর প্রার্থী নির্ধারণে এবং সরকারি নিয়োগপ্রক্রিয়ায় আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাতে ৪৩তম বিসিএসের সুপারিশ করা ২ হজার ১৬৩ জন প্রার্থীর বিষয়ে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই এবং ডিজিএফআইয়ের মাধ্যমে প্রাক্-চরিত্র পুনরায় অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা থেকে ২২৭ জন প্রার্থীর বিরুদ্ধে তাঁরা আপত্তি/ অসুপারিশ করে।
বিষয়টিকে সত্য ধরে আমরা কিছু প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করতে চাই। এই যে বিজ্ঞপ্তিতে ‘বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এ নিয়োগের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন’ করার কথা বলা হচ্ছে, প্রশ্ন হলো, কারা এই প্রশ্ন তুলছে? সেই সব প্রশ্ন কী?
এই প্রশ্নের উত্তর জনপ্রশাসন কী দেবে জানি না। তবে এই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হিসেবে গত বছরের ১৭ অক্টোবর ২ হাজার ৬৪ জনকে নিয়োগে ৪৩তম বিসিএসের যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, তা বাতিলের দাবি তুলেছিল বিএনপি। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দলীয় বিবেচনায় এসব বিসিএসে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ তোলে দলটি (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)।
এটাকে যদি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণের বিবেচনার অভিযোগ হিসেবে গণ্য করা হয়, তাহলে সমগ্র বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হবে। তাহলে কি বিসিএসে যাঁরা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁরা কি প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দেননি? লিখিত পরীক্ষায় ভালো করেননি?
মৌখিক পরীক্ষাকে পলিটিক্যাল ডাউট অব সিলেকশন যদি রাখি, তাহলে ৩ লাখ ২১ হাজার ৬৫০ জন প্রার্থী অংশ নেওয়া প্রার্থীর মধ্যে থেকে চূড়ান্ত সুপারিশপ্রাপ্ত একজন বিসিএস প্রার্থী হওয়াকে কিছুতেই অযোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে ধরা যায় না। এবার প্রশ্ন হলো, তাহলে কি কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে এই ২২৭ জনকে বিদায় জানানো হয়েছে? যদিও বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট এ ধরনের বক্তব্য নেয়, তবে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণের মধ্যে এই প্যারামিটার থাকতে পারে। ধরুন, একজন প্রার্থী ছাত্রলীগ, ছাত্রদল কিংবা শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। প্রশ্ন হলো, এই জড়িত থাকা কি একজন প্রার্থীর অযোগ্যতা?
আমরা তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করিনি। এ দেশে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধও নয়। যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তখন তারা নিজ ছাত্রসংগঠনগুলোকে ব্যবহার করেছে নিজেদের কাজে। এর পরম্পরায় ছাত্ররাজনীতি করার কারণে যদি কারও চাকরি না হয়, এটাকে অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে সবার আগে সরকারের উচিত হবে ছাত্ররাজনীতি ঠেকানো। সেটা বন্ধ না করে আপনি যদি ছাত্রসংগঠনের, (বিশেষ করে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ) জড়িত থাকার অপরাধে এইভাবে চূড়ান্ত সুপারিশনামা থেকে নাম কেটে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, তাহলে সেটা হবে একধরনের দ্বিচারিতা, যার দায়ভার সরকারের ওপর বর্তায়।
বিসিএসে এই এজেন্সি ভেরিফিকেশন বন্ধ করা উচিত। এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারগুলো দলীয় মতাদর্শ প্রার্থী বাছাইয়ে সুবিধা পায়। এজেন্সি ভেরিফিকেশন যদি সত্যি প্রয়োজন হয়, তাহলে এসব ভেরিফিকেশনের পরও কীভাবে একজন আমলা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, রাজনৈতিক নেতাদের সুরে কথা বলেন, সুবিধা আদায় করেন? বরং তাঁদের দক্ষ ও মানবিক কর্মকর্তা হওয়ার প্রশিক্ষণ দিন।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকার যেমনটা করেছিল। যে নোংরামি কৌশলের কারণে ২৮তম বিসিএস থেকে ৪২তম বিসিএস পর্যন্ত নিয়োগবঞ্চিত ২৫৯ জনকে এই অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে নিয়োগ দেওয়া হয় বলে প্রথম আলোর একটি খবরে বলা হচ্ছে। এখন এই সরকারও যদি একই পথে পা দেয়, তাহলে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের কার্যক্রমের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমের তফাত রইল কী?
এবার আসি কেন দ্বিতীয়বার যাচাই–বাছাই থেকে এই বিপুলসংখ্যক প্রার্থীকে বাদ দেওয়া হলো। দেখুন, বিসিএসে নিয়োগবিধির ১৯৮১ সালের অধ্যাদেশ ৪ নম্বর ধারায় যেসব উপধারা রয়েছে, সেখানে স্পষ্টভাবে একজন প্রার্থীকে বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার শর্তসহ কোনো ভিনদেশি নাগরিককে বিয়ে করা যাবে না শর্ত ছাড়াও স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও গোয়েন্দাদের যাচাই–বাছাইয়ের কথা ৩(খ)তে বলা হয়েছে, ‘the antecedent of the person so selected have been verified through the appropriate agencies and found to be such as do not render him unfit for the appointment in the service of republic.’
তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা চলে, চূড়ান্ত সুপারিশের আগে এসব প্রার্থীর এই নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ধরলাম, আওয়ামী লীগের আমলে এসব প্রার্থীর যোগ্যতা হিসেবে দলীয় মতাদর্শ বিবেচনা করা হয়েছিল। তাহলে এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই গত ১৫ অক্টোবর পুলিশ ও জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে পুনরায় যাচাই–বাছাই থেকে ৪০ জন স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অনুপস্থিত ব্যতীত যে ৫৯ জনকে বাদ দিয়েছিল, এরপর আবার রাষ্ট্রীয় যে দুই গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে কীভাবে ২২৭ জন বাদ পড়ল? এঁদের অযোগ্যতার মাপকাঠি ওরা ধরতে না পারলে গোয়েন্দারা কিসের বিবেচনায় ধরল?
মানলাম, গোয়েন্দা সংস্থার চেয়ে পুলিশ ও জেলা প্রশাসকের দক্ষতা ভিন্নতা রয়েছে, তাহলে কেন তাঁরা ১৫ অক্টোবর বাকিদের শনাক্ত করতে ব্যর্থ হলেন? সরকার কি জেলা প্রশাসক ও পুলিশের সেই সব রিপোর্ট প্রদানকারী কর্তাদের তলব করেছে?
যদিও বিজ্ঞপ্তিতে ক্লিন ইমেজ নামক একটি অসাড় শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে, যার একাডেমিক কোনো ভিত্তি নেই। এই ক্লিন ইমেজ বলতে একজন ব্যক্তিকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। যেমন সে ধার্মিক কি না, সে সুনাগরিক কি না, মামলা থেকে মুক্ত কি না, নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল কি না, সৎ ব্যক্তি কি না ইত্যাদি। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ভেদে ক্লিন ইমেজের বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। যেমন একজন মানুষ তাঁর পরিবারের প্রতি রয়্যাল বা বিশ্বস্ত হলেও তাঁর সহকর্মীদের কাছে তাঁর উল্টোটাও হতে পারেন। এই ক্ষেত্রে আপনি কোন মানদণ্ডে ক্লিন ইমেজ মনে করবেন বা ফেলবেন, সেটা নিছক প্যারামিটার স্বীয়ভাবে সেট করে দিতে হবে।
এই ক্ষেত্রে আমরা জানি না, সরকার আসলে ক্লিন ইমেজধারী এই ৪৩তম বিসিএস ক্যাডার বলতে আওয়ামী লীগ সমর্থন করেন না, এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বোঝায় কি না। বিসিএসে অধ্যাদেশ কোথাও এই ক্লিন ইমেজ সূত্রে ধরে নিয়োগের কথা বলা নেই। তাহলে এই যে ক্লিন ইমেজের কথা বলে ২২৭ জনকে বাদ দিলেন, সেটা কোন আইনের মধ্যে পড়বে শুনি? ওঁরা কী কোনো দেশদ্রোহী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন, কিংবা উগ্রবাদী সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যা সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি ছিল?
বিসিএসে এই এজেন্সি ভেরিফিকেশন বন্ধ করা উচিত। এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারগুলো দলীয় মতাদর্শ প্রার্থী বাছাইয়ে সুবিধা পায়। এজেন্সি ভেরিফিকেশন যদি সত্যি প্রয়োজন হয়, তাহলে এসব ভেরিফিকেশনের পরও কীভাবে একজন আমলা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, রাজনৈতিক নেতাদের সুরে কথা বলেন, সুবিধা আদায় করেন? বরং তাঁদের দক্ষ ও মানবিক কর্মকর্তা হওয়ার প্রশিক্ষণ দিন।
যা–ই হোক, এই ২২৭ জনকে ছাঁটাই একধরনের অন্যায়, বৈষম্যময় আচরণ বটে। যদি কেউ সুপারিশ করে থাকেন, কোনো বিশেষ বা অন্যায় সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন, যদি অপরাধী হয়ে থাকেন, এই রাষ্ট্রের সম্পদ বিনষ্ট করে থাকেন—এসব বিবেচনায় নিয়ে তাঁর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে কোনো আপত্তি নেই।
এখন সরকার বাদ পড়া ব্যক্তিদের পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদনের সুযোগ দিয়েছে। আশা করি পুনরায় তাঁদের প্রতি কোনো বৈষম্য হবে না।
ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]