ইসরায়েল হামাস, হিজবুল্লাহ ও ইরানের শীর্ষ রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের হত্যা করেই চলেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় এ মাসের শুরুতে ইসরায়েলে ইরান মিসাইল হামলা করেছে। এরপর মধ্যপ্রাচ্যের অনেকের কাছে ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সামনে কী ঘটতে চলেছে।
এই হামলা ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ডে প্রতিশোধ নেওয়ার ইরানি প্রতিশ্রুতি দেরিতে হলেও পূরণ হয়েছে। একইভাবে দেশটির জনগণের মধ্যে যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল সেটা প্রশমিত হয়েছে। কিন্তু ইসরায়েল কীভাবে পাল্টা জবাব দেবে, তা নিয়ে উদ্বেগও তৈরি হয়েছে।
তেহরানের মেজাজ অবাধ্য হয়ে উঠেছে, ইরান সরকারের কর্মকর্তারা যেকোনো ইসরায়েলি হামলায় জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান এ মাসের শুরুতে বলেছেন যে ‘ইসরায়েল যদি কোনো আক্রমণ করে, তাহলে আমরা শক্তিশালী ও কঠোরভাবে তার পাল্টা জবাব দেব।’
ইরান সরকারের আরেকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে তেহরান মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে ওয়াশিংটনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানিয়ে দিয়েছে যে ইসরায়েল যদি কোনো ধরনের হামলা চালায়, তাহলে তার পাল্টা জবাব দেওয়া হবে বেসামরিক স্থাপনায় আক্রমণসহ ‘অপ্রচলিত’ সব উপায়ে।
জল্পনা ছড়িয়ে পড়েছে যে ইসরায়েল ইরানের খার্গ দ্বীপের জ্বালানি তেলের স্থাপনায় হামলা করতে পারে। ইসরায়েল ইরানের তেল শোধনাগারে হামলা করে এই খাতকে দুর্বল করে দিতে চাইতে পারে। ইসরায়েল পূর্ণমাত্রায় হামলা চালালে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সেটা ঠেকাতে ব্যর্থ হবে।
ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) কমান্ডার জেনারেল হোসাইন সালিমি ইসরায়েলেকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে ‘আমরা আপনাদের বলছি যে আমাদের কোনো একটা ক্ষেত্রে যদি আগ্রাসন চালানো হয়, তাহলে আমরা আপনাদের সেই ক্ষেত্রে বেদনাদায়ক প্রত্যাঘাত করব।’
পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, ইসরায়েল যদি প্রতিশোধ নেয়, তবে ইরানকে একাই সেই আক্রমণের বোঝা বহন করতে হবে। কেননা, যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা ইসরায়েলকে তাদের সমর্থন দেওয়া অব্যাহত রাখবে।
এক বছর ধরে পশ্চিমারা গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধে সাহায্য ও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সেই যুদ্ধ এখন লেবানন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
ইরানের কৌশলগত মিত্র রাশিয়া ও চীন এখন পর্যন্ত তাদের অবস্থানের বিষয়ে অস্পষ্টতা দেখিয়ে চলেছে। পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা তাদের জাতীয় স্বার্থের কথাই বিবেচনা করবে।
ইরানের দুর্বলতা
ইরানের হামলার পরপরই ইসরায়েল প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। এক বিবৃতিতে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘ইরান আমাদের আত্মরক্ষার সংকল্প কতটা, সেটা বুঝতে পারছে না।’
ইসরায়েল কীভাবে হামলা করতে পারে এবং তাদের লক্ষ্যবস্তু কী হতে পারে, তা নিয়ে ইরানের কর্মকর্তারা তাঁদের নাগরিকদের একটা পরামর্শ দিয়েছেন। সাইবার ব্যবস্থায় নাশকতা থেকে শুরু করে সামরিক ঘাঁটি ও বেসামরিক নাগরিকদের স্থাপনায় হামলার মতো ঘটনা ঘটতে পারে বলে তাঁরা সতর্ক করেছেন। ইরানের তেল-জ্বালানি স্থাপনায়ও হামলা করতে পারে। উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যা, এমনকি পারমাণবিক স্থাপনাতেও হামলা করতে পারে।
ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থার মুখপাত্র বেহরুজ কামালভান্দি বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের হামলার ব্যাপারটা অসম্ভব ছিল। কিন্তু তারা যদি এখন হামলা করে, তাহলে যে ক্ষতিই হোক না কেন, সেটা খুব দ্রুত পূরণ করে ফেলা হবে।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সতর্ক করে বলেছেন, কোনো আরব দেশ যদি ইসরায়েল অথবা যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের দেশকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে ইরানে হামলা চালায়, তাহলে তেহরান তার প্রতিশোধ নেবে।
ইসরায়েল কী ধরনের পাল্টা জবাব দেবে, সেটা অবশ্যই ভবিষ্যতের হিসাব–নিকাশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার ওপর নির্ভর করে।
যা–ই হোক, ইসরায়েলের পাল্টা জবাবের ধরন কেমন হবে, কিংবা তার ব্যাপ্তি কতটা হবে, তার বাইরে বেরিয়েও বলা যায়, কয়েক দশক ধরে দুই দেশের মধ্যে যে সাংঘর্ষিক সম্পর্ক বিরাজ করছে সেখানে ইরানকে এ ধরনের অসংখ্য হামলা মোকাবিলা করতে হয়েছে।
ইরানের সাইবারব্যবস্থায় একের পর এক নাশকতা হয়েছে। ইরানের শহরগুলোর গ্যাসস্টেশনগুলোর জ্বালানিব্যবস্থা স্থবির করে দিতে সাইবার হামলা করেছে ইসরায়েল। ইরানের শাহিদ রাজি বন্দরের সাইবারব্যবস্থাতেও হামলা করেছে ইসরায়েল।
বিভিন্ন সময়ে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করেছে। সম্প্রতি তেহরানে রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে আসা হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকাণ্ডটি ছিল বিরাট এক ধাক্কা।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য ধাক্কা ছিল ২০১১ সালে ইরানের রকেট কর্মসূচির জনক হাসান তেহরানি মোগাদ্দামকে হত্যার ঘটনা। তেহরানের একটা সেনাঘাঁটির বাইরে বিস্ফোরণে নিহত হন তিনি। ইরান থেকে ইসরায়েল গুরুত্বপূর্ণ অনেক নথি চুরি করে নিয়ে গেছে এবং পারমাণবিক স্থাপনায় নাশকতা করেছে।
এটা কি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ?
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পারমাণবিক স্থাপনায় চেয়ে শিল্প ও শহুরে অবকাঠামোয় হামলা হলে সেটা সর্বাত্মক যুদ্ধ বেধে যাওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে দিতে পারে।
আসালুয়েহ বন্দর ও খার্গ দ্বীপের টার্মিনালসহ ইরানের তেল স্থাপনাগুলো ইসরায়েলের জন্য অপেক্ষাকৃত সহজ লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। কেননা, এগুলো দেশটির দক্ষিণে অবস্থিত। আর সেখানে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড হলে সেটা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বড় করে প্রচার পাবে।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো মাটির অনেক গভীরে অবস্থিত এবং সেগুলো দেশটির মধ্যভাগে অবস্থিতি। সেখানে হামলা করতে হলে ইসরায়েলের বড় ধরনের সামরিক প্রচেষ্টা যেমন দরকার, আবার যুক্তরাষ্ট্রের ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা পাওয়া দরকার। যা–ই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পারমাণবিক স্থাপনায় যেকোনো হামলার বিরোধিতা করেছেন।
এই সংঘাতে বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও ইরান সরকার প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। সম্প্রতি ইসরায়েলকে মিসাইলবিরোধী থাড প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আজিজ নাসিরজাদেহ বিষয়টির গুরুত্বকে খাটো করে এটিকে ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটা নতুন কোনো ব্যাপার নয়; আর এটা সুনির্দিষ্ট কোনো সমস্যাও তৈরি করবে না।’
ইরান সংসদের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির সদস্য ভায়িদ আহমাদি বলছেন, থাড ব্যবস্থায় হামলার সামর্থ্য ইরানের রয়েছে।
জল্পনা ছড়িয়ে পড়েছে যে ইসরায়েল ইরানের খার্গ দ্বীপের জ্বালানি তেলের স্থাপনায় হামলা করতে পারে। ইসরায়েল ইরানের তেল শোধনাগারে হামলা করে এই খাতকে দুর্বল করে দিতে চাইতে পারে। ইসরায়েল পূর্ণমাত্রায় হামলা চালালে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সেটা ঠেকাতে ব্যর্থ হবে।
মোহাম্মদ সালামি, ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালিসিসের গবেষণা সহযোগী
মিউলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত