১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশনের (ন্যাটো) চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সে সময়কার মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান বলেছিলেন, এই ‘সামান্য দলিলটা’ যদি ১৯১৪ এবং ১৯৩৯ সালে বিদ্যমান থাকত, তাহলে তা আগ্রাসনবাদীদের দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার সব তৎপরতা নস্যাৎ করে দিতে পারত। ট্রুম্যান সেখানে বলেছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন, এই নবপ্রতিষ্ঠিত জোট সম্ভাব্য আগ্রাসনকারীদের প্রতিহত করে বিশ্বে শান্তি ধরে রাখা নিশ্চিত করবে।
সম্প্রতি ফিনল্যান্ড ও সুইডেন যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে ন্যাটোর বর্তমান সদস্যসংখ্যা ৩২। এখন ইউক্রেনকে সদস্য করে নিয়ে তাকে রক্ষায় অবশ্যই অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে এসব সদস্যকে। আমাদের বুঝতে হবে, ন্যাটোর বর্তমান কিংবা সম্ভাব্য সদস্যদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে জোটটির মধ্যে কোনো ধরনের গড়িমসি প্রকাশ পেলেই তা আগ্রাসন ডেকে আনবে। ইউক্রেন এবং জর্জিয়া সদস্যপদ চাওয়ার পর ন্যাটোর ২০০৮ বুখারেস্ট সম্মেলনে তাদের সদস্য করার প্রক্রিয়াকে স্থগিত করার সিদ্ধান্ত হয়। তাদের ওই সিদ্ধান্ত রাশিয়াকে ওই বছরেরই শেষ দিকে জর্জিয়া আক্রমণের দিকে পরিচালিত করে।
পশ্চিমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে, রাশিয়া ইতিমধ্যে ন্যাটোর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। ক্রেমলিন সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাচ্ছে, বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা চালাচ্ছে, ইউরোপের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ইন্ধন দিচ্ছে, গণতান্ত্রিক দেশগুলোর নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করছে এবং ইউরোপজুড়ে একটি নাশকতার প্রচারণার পরিকল্পনা করছে বলে জানা যাচ্ছে।
২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়াকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর ন্যাটো চোখ ফিরিয়ে রেখেছিল এবং ঠিক একইভাবে তার ফল হিসেবে রাশিয়া ২০২২ সালে ইউক্রেনে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে। যদি ইউক্রেনকে হেরে যেতে দেওয়া হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে রাশিয়া আরও আগ্রাসী হয়ে উঠবে। তবে ইউক্রেনকে দ্রুত সদস্য হিসেবে নিয়ে ন্যাটো যদি কিয়েভের পক্ষে দাঁড়ায়, তাহলেই স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত হতে পারে।
এই যুদ্ধে যদি ইউক্রেন হেরে যায়, তাহলে আগ্রাসনের পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু হবে এস্তোনিয়া, পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড অথবা তাইওয়ান। শীতল যুদ্ধের সময় ন্যাটোর কৌশলের একটি মৌলিক নীতি ছিল শক্তিকে আরও বেশি শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করা। ১৯৪৬ সালে তৎকালীন আমেরিকান কূটনীতিক জর্জ কেনান এই কৌশলগত নীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন যেখানে ‘যৌক্তিক যুক্তিকে’ পাত্তা দিতে চায় না, সেখানে সে ‘ক্ষমতার যুক্তির’ সামনে মাথা নত করে। বাস্তবেও দেখা গেছে, যখনই সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েছে, তখনই সে পিছু হটেছে।
পরবর্তী দশকগুলোতে কেনানের কথা প্রমাণিত হয়েছে। শীতল যুদ্ধের সময় যখনই পশ্চিমা শক্তিগুলো বুঝিয়েছে, তারা পশ্চিম জার্মানি ও দক্ষিণ কোরিয়াকে রক্ষায় বদ্ধপরিকর, তখনই সোভিয়েত পিছু হটেছে। আবার যখনই পশ্চিমারা ইতস্তত করেছে, তখনই সোভিয়েতরা আক্রমণ করেছে।
ইউক্রেনকে সদস্য করার একটি সুস্পষ্ট সময়সূচি ঠিক করতে রাজি না হওয়ার মধ্য দিয়ে ন্যাটো প্রকারান্তরে রাশিয়ার দাবির কাছে নতি স্বীকার করছে। এর মাধ্যমে ন্যাটো কার্যত ভ্লাদিমির পুতিনকে এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে রুশ সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারে পুতিন যে স্বপ্ন দেখছেন, তা বাস্তবসম্মত। এভাবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠছে।
পশ্চিমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে, রাশিয়া ইতিমধ্যে ন্যাটোর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। ক্রেমলিন সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাচ্ছে, বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা চালাচ্ছে, ইউরোপের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ইন্ধন দিচ্ছে, গণতান্ত্রিক দেশগুলোর নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করছে এবং ইউরোপজুড়ে একটি নাশকতার প্রচারণার পরিকল্পনা করছে বলে জানা যাচ্ছে।
দুর্ভাগ্যবশত, পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলো এই বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার বিষয়ে ধীরে চলার নীতি নিয়েছে। ন্যাটো পুতিনকে ‘উসকানি’ দিয়েছিল কি না এবং পুতিনকে ‘মুখ রক্ষার’ সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে কি না—এসব নিয়ে যখন পশ্চিমা নেতারা নিজেদের মধ্যে তর্কবিতর্ক করছেন, ঠিক সেই সময় রাশিয়া এবং চীন তাঁদের ‘সীমানাহীন’ সামরিক অংশীদারিকে আরও গভীর করছে। এই দুই শক্তি একটি ‘অভ্যুত্থানের অক্ষ’ গড়ে তুলছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।
ইউক্রেন, ইউরোপ এবং ন্যাটোর ভাগ্য অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ সম্প্রতি ‘ইউরোপ নশ্বর’ বলে মন্তব্য করেছেন এবং এর মাধ্যমে তিনি ইউরোপের ভঙ্গুরতার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। ইউরোপের মৃত্যু ঘটতে পারে—এমন আলামত ইতিমধ্যে দু–একটি দৃশ্যমানও হচ্ছে।
রাশিয়ার পুনর্গঠনবাদী উচ্চাভিলাষ যে ভয়ানক হুমকি সৃষ্টি করেছে, তা এখনই মোকাবিলা করা দরকার। এর অংশ হিসেবে ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যুক্ত করতে হবে। আগামী জুলাইয়ে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠেয় ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলনে দেশটিকে সদস্য হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানোর একটি মোক্ষম সুযোগ তৈরি হবে। বাকি সদস্যদের এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে।
● ইউরি গোরোদনিচেঙ্কো বার্কলের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার অর্থনীতির অধ্যাপক
● ইলোনা সোলোগউব ইউক্রেনভিত্তিক সাময়িকী ভক্সইউক্রেন–এর সম্পাদক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত