৭৬ বছর বয়সী পাকিস্তানে অর্ধেক সময় কেটেছে সরাসরি সামরিক শাসনে। কিন্তু জনগণের ভোটে নির্বাচিত কোনো প্রধানমন্ত্রী মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। বরং অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন সোহরাওয়ার্দীসহ বেশির ভাগকে জেল খাটতে হয়েছে ক্ষমতাচ্যুতির পর।
পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৫১ সালে বন্দুকধারীর হাতে নিহত হন, আরেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বিতর্কিত বিচারের নামে ফাঁসি দেওয়া হয় ১৯৭৯ সালে। এরপর আশি ও নব্বইয়ের দশকে পিপলস পার্টি ও মুসলিম লিগ নওয়াজ ক্ষমতার মিউজিক্যাল চেয়ার ভাগাভাগি হলেও নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি ছিল সেনাবাহিনীর হাতে।
২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় মুসলিম লিগ নেতা নওয়াজ শরিফ জেলে ছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁকে বহু বছর লন্ডনে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয় সেনাবাহিনীর বিরাগভাজন হওয়ার করণে। এবার ঠিক উল্টোটা ঘটেছে। ২০২২ সালের এপ্রিলে ইমরান খান আস্থা ভোটে হেরে গিয়ে ক্ষমতা হারান, যার পেছনে সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল।
২০১৮ সালের নির্বাচনে ইমরানের দল পিটিআইএর প্রতি সেনাবাহিনীর প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসে ইমরান বেসামরিক বিষয়ে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করলে দুই পক্ষের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ইমরানের পদত্যাগের পর মুসলিম লিগ-পিপিপির কোয়ালিশন সরকার গঠনের নেপথ্যেও সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল বলে মনে করেন পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
এরপর দ্রুত রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যায়। গত বছর আগস্টে একটি মামলায় ইমরানকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। সে সময়ে সামাজিক মাধ্যম এক্সে তিনি নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমার শুধু একটাই আবেদন, নীরবে ঘরে বসে থাকবেন না।’ তাঁরা কেউ ঘরে বসে থাকেননি।
এ পর্যন্ত ইমরানের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা হয় এবং তিনটিতে কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যার উদ্দেশ্য তাঁকে নির্বাচনের বাইরে রাখা। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ক্ষমতাসীনেরা এই কৌশল অবলম্বন করেন।
নির্বাচন কমিশনও সরকারের ইচ্ছাপূরণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। একটি ঠুনকো অভিযোগে তারা পিটিআইএর প্রতীক কেড়ে নেয়। তাদের প্রতীক ছিল ক্রিকেটের ব্যাট। নির্বাচনের পর একজন সাংবাদিক মন্তব্য করেছেন, ‘ব্যাট ছাড়াই ইমরানের সেঞ্চুরি।’ সেনা নেতৃত্ব ইমরানকে নির্বাচনের বাইরে রাখলেও তার প্রতি জনজোয়ার রুখতে পারেনি। নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যায়, পিটিআই-অনুসারী প্রার্থীরাই সবচেয়ে বেশি আসনে জয়ী হয়েছেন। দলের বর্তমান চেয়ারম্যান গওহর খানের দাবি, তাঁর দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও বেশ কিছু আসনে তাঁদের প্রার্থীদের জোর করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ না হতেই সেনাপ্রধান আসিম মুনির নতুন তত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছেন। তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি ‘সব গণতান্ত্রিক শক্তির সমন্বয়ে ঐক্যবদ্ধ সরকার’ গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। জেনারেল মুনিরের বিবৃতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বেসামরিক বিষয়ে কোনো সেনাপ্রধান এ রকম বিবৃতি দিতে পারেন কি?
এ নির্বাচনে পাকিস্তানের জনগণ বেসামরিক সরকার ও তাদের চালিকা শক্তি সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন। কারাবন্দী ইমরান যে কারামুক্ত ইমরানের চেয়েও বেশি শক্তিশালী, নির্বাচনে সেটাই প্রমাণিত হলো।
৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল ছিল মুসলিম লিগ-নওয়াজ, বিলাওয়াল ভুট্টোর পিপিপি, এমকিউএম ও অন্যান্য ছোট দল। পিটিআই দলগত নির্বাচন করতে না পারলেও তাদের অনুসারীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়েছেন। উপমহাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতির প্রধান হাতিয়ার হলো দলীয় প্রতীক। অনেক ক্ষেত্রে প্রার্থী ও দলের চেয়ে প্রতীক বড় হয়ে ওঠে।
এই নির্বাচনকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ১৯৭০ সালের পর দ্বিতীয় ব্যালট-বিপ্লব বলেও অভিহিত করেছেন অনেকে। অবিভক্ত পাকিস্তানের সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুরো পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী পিটিআই পেয়েছে ৯৮টি, নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ ৬৯টি ও বিলাওয়াল ভুট্টোর পিপলস পার্টি ৫১টি আসন পেয়ে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে। মুসলিম লিগ ও পিপলস পার্টির প্রার্থীরা দলীয় প্রতীকে ভোট করলেও পিটিআইকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। পিটিআই সমর্থকেরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়েছেন। উপমহাদেশের নির্বাচনে ভোটারেরা প্রার্থীর চেয়ে দলীয় প্রতীককে বেশি চেনেন। তাঁদের কাছে প্রার্থীর চেয়ে দলীয় প্রধান কিংবা দলীয় প্রতীক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে পিটিআই দলগত নির্বাচন করার সুযোগ পেলে আরও ভালো করত বলে নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন।
নির্বাচনের পুরো ফল প্রকাশ না হলেও প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো সরকার গঠনের উদ্দেশ্য পারস্পরিক আলোচনা শুরু করেছে।
শনিবার রাতে কথা হয় পাকিস্তানের এক সাংবাদিকের সঙ্গে। তিনি জানান, নওয়াজ শরিফ নিশ্চিত ছিলেন যে তাঁর দলই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেতে যাচ্ছে। বিজয়ের ঘোষণা-সংবলিত একটি লিখিত কাগজও তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন সংবাদ সম্মেলন করবেন বলে। কিন্তু পরে আর সেটি পড়েননি। পকেটেই রেখে দিয়েছেন। নেওয়াজ সাংবাদিকদের জানান, তাঁর ভাই শাহবাজ শরিফকে বলা হয়েছে অন্যান্য দলের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠনের বিষয়ে আলোচনা করতে। পিপিপির নেতা বিলাওয়াল ও আসিফ আলী জারদারির সঙ্গে মুসলিম লিগ নেতাদের বৈঠক হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
ওই সাংবাদিক আরও জানান, পিপিপি-মুসলিম লিগ জোট সরকার গঠনে সমস্যা হলো প্রধানমন্ত্রী পদ নিয়ে। নওয়াজ ধরে নিচ্ছেন, তিনিই প্রধানমন্ত্রী হবেন। অন্যদিকে বিলাওয়ালও প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী। দ্বিতীয়ত, এই দুই দল মিলেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে না। আরও ছোট দলের সহায়তা প্রয়োজন হবে। অন্যদিকে পিটিআইয়ের সঙ্গে জোট করলে অন্যদের সহায়তার প্রয়োজন হবে না।
নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ না হতেই সেনাপ্রধান আসিম মুনির নতুন তত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছেন। তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি ‘সব গণতান্ত্রিক শক্তির সমন্বয়ে ঐক্যবদ্ধ সরকার’ গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। জেনারেল মুনিরের বিবৃতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বেসামরিক বিষয়ে কোনো সেনাপ্রধান এ রকম বিবৃতি দিতে পারেন কি?
তিনি সব গণতান্ত্রিক শক্তির একসঙ্গে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সব গণতান্ত্রিক শক্তি এক হলে বিরোধী দলে কারা বসবে—পিটিআই? পিটিআইএর নেতারা দলগতভাবে নির্বাচন করতে পারেননি। তাঁরা নির্বাচন করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। তাহলে সেনাপ্রধান কি পিটিআইয়ের বাইরে এমন একটি কোয়ালিশন সরকার গঠনের পরামর্শ দিচ্ছেন, যাদের ওপর অনায়াসে খবরদারি করতে পারবেন? কে হবেন তাদের অনুগত প্রধানমন্ত্রী? নেওয়াজ না অন্য কেউ?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি