প্রায় ১০০ কোটি ভোটার নিয়ে ভারতে নির্বাচন চলছে। এই নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি অসাধারণ অনুশীলনের প্রতিনিধিত্ব করবে, এমনটাই কথা ছিল।
কিন্তু মলিন বাস্তবতা হলো, এক দশক ধরে যে অবক্ষয় গণতন্ত্রকে ঘুণপোকার মতো কেটে চলেছে, তা ভারতের বিভিন্ন উদার প্রতিষ্ঠানকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই অবক্ষয় গণতান্ত্রিক চর্চার পরিসরকে সংকুচিত করে ফেলছে; রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে দুর্বলতর করেছে এবং গণতন্ত্রঘাতী পুরো প্রক্রিয়াটিকে আরও জোরালো করছে।
সবচেয়ে বড় কথা, গণতন্ত্রকে ফিকে করে দেওয়ার মিছিলে যিনি নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন, সেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখনো ভোটারদের মধ্যে জনপ্রিয়।
২০২২ সালে প্রকাশ পাওয়া আমার ‘আ ওয়ার্ল্ড অব ইনসিকিউরিটি: ডেমোক্রেটিক ডিস্যানচ্যান্টমেন্ট ইন রিচ অ্যান্ড পুওর কান্ট্রিস’ বইটিতে উল্লেখ করেছি, এ ধরনের রাজনৈতিক শক্তিগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে স্বল্পশিক্ষিত লোক, গ্রামীণ অঞ্চলের ভোটার ও বয়স্ক লোকদের মধ্যে সমর্থন বাড়ানোর চেষ্টা করে।
মোদির ভারতীয় জনতা পার্টিও (বিজেপি) এই কাজ করেছিল। তবে বাস্তবতা হলো, মোদির হাতে এখন গ্রামের অশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত লোক ও প্রবীণ ভোটারদের সমর্থনের পাশাপাশি শিক্ষিত, শহুরে ও উচ্চাক্ষাঙ্ক্ষী তরুণ ভোটারদেরও ব্যাপক সমর্থন রয়েছে।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে যেখানে বড় বড় শহরে জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে, সেখানে মোদি দিল্লি, মুম্বাই ও বেঙ্গালুরুতে দুর্দান্ত বিজয় অর্জন করেছিলেন।
এর একটি বড় কারণ হলো, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর অবিচল আস্থা, সরকারি ক্ষমতাকে কৈফিয়তের অধীন ও ভারসাম্যমূলক অবস্থায় রাখা এবং মুক্তভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করতে পারে, এমন রাজনৈতিক উদারতাবাদ ভারতে কখনোই ছিল না।
২০২৩ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারতের ৬৭ শতাংশ মানুষ এমন ধরনের ‘তেজি নেতা’র শাসনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন, যিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আদালত বা পার্লামেন্টের অনুমোদনের তোয়াক্কা করেন না। ওই জরিপে ভারতের ওই হার ছিল বিশ্বের সব কটি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বিশ্বের অন্যান্য এলাকায় মানুষের জেদ ও দুর্বলতাকে খুঁচিয়ে তোলা জনতুষ্টিবাদী বাক্যবাগীশ (ডেমাগগ) নেতারা সব সময়ই গণতন্ত্রের অংশগ্রহণমূলক দিকগুলোর ওপর জোর দিয়ে থাকেন।
কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে এখানে রাজনীতির পদ্ধতিগত দিকগুলোই বিশেষভাবে দুর্বল, যা সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদকে ভয়ংকর রূপ নিতে সক্ষম করে তোলে। এটি ভিন্নমত পোষণকারীদের, বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর রাষ্ট্র-প্ররোচিত নিপীড়নকে আরও তীব্র করে তোলে।
সরকারের পক্ষ থেকে জনগণকে দেওয়া বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণ সুবিধাকে প্রায়ই মোদির তরফ থেকে দেওয়া ‘উপহার’ (ফলাও করে মোদির ছবি ছাপাসহ) হিসেবে দেখানো হয়েছে। এটি নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের মধ্যেও এই বোধ তৈরি করেছে যে মোদি তাঁদের যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়নে তিনি সচেষ্ট।
ভারতের রাজনীতিতে অনুদারবাদের বাড়বাড়ন্ত এতটাই যে এখানে কট্টর বামপন্থীদের মধ্যেও অনুদারবাদ গেড়ে বসেছে। এখানকার বামপন্থীরা উদার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘বুর্জোয়া’ গণতন্ত্রের তল্পিবাহক মনে করেন।
অন্যদিকে ঐতিহ্যবাদীরা, এমনকি সহনশীলতাপন্থী গান্ধীবাদীরা যে মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন, তা মূলত ভারতীয় সমাজের পুরুষতান্ত্রিক ও জাত–পাত–শ্রেণি মেনে চলা রীতির প্রতিনিধিত্ব করে।
আর উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করা হিন্দু-আধিপত্যবাদী মতাদর্শের প্রচারক আরএসএসের তো উদারতাবাদের সঙ্গে নিজেকে জড়ানোর প্রশ্নই ওঠে না।
এ অবস্থার ভেতর ভারতের যে দরিদ্র শ্রেণি ঐতিহ্যগতভাবে জাতীয় পর্যায়ের মধ্য–বাম ঘরানার দল কিংবা আঞ্চলিক দলগুলোর সমর্থক ছিল, তারাও বিজেপির সব হিন্দুকে এক ছাতার তলায় আনার কৌশলে আকৃষ্ট হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে জনগণকে দেওয়া বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণ সুবিধাকে প্রায়ই মোদির তরফ থেকে দেওয়া ‘উপহার’ (ফলাও করে মোদির ছবি ছাপাসহ) হিসেবে দেখানো হয়েছে। এটি নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের মধ্যেও এই বোধ তৈরি করেছে যে মোদি তাঁদের যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়নে তিনি সচেষ্ট।
মূলত দুটি ন্যারেটিভ বা ভাষ্য বিজেপির জনসমর্থনকে জোরদার করেছে; যদিও সে দুটোর কোনোটিই জনগণ নির্মোহভাবে যাচাই করেনি।
প্রথম ভাষ্যটি হলো, মোদির সরকার একাই দুর্নীতি নামক দানবকে মেরে ফেলতে পারবে। কিন্তু তার সরকার যে দুর্নীতি দমন ইস্যুতে খুব একটা অগ্রগতি পেয়েছে, এমন কোনো প্রমাণ নেই।
বরং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করাপশন পারসেপশন ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে দুর্নীতির ক্ষেত্রে ভারত ৯৩তম অবস্থানে ছিল। অর্থাৎ কিনা ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর ভারত এ ক্ষেত্রে আট ধাপ নেমে গেছে। ‘লোকনীতি’ নামের একটি ভারতীয় জরিপ প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে তারা জরিপের সময় যত ভারতীয় নাগরিককে প্রশ্ন করেছিল, তার ৫৫ শতাংশ উত্তরদাতার ধারণা, গত পাঁচ বছরে দুর্নীতি বেড়েছে।
ভারতে সমাজ ও সরকারের নিম্নস্তরের দুর্নীতিও (যেটিকে ‘ছোটখাটো’ দুর্নীতি বলা হয়) আগের অবস্থায় রয়ে গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পুলিশ কর্মকর্তা বা সরকারি পরিদর্শকদের ঘুষ নেওয়ার ঘটনা কমেছে বলে মনে হয় না।
এ ছাড়া ২০১৬ সালে ‘কালোটাকা’ বের করে আনার কথা বলে মোদি সরকার যে বিপর্যয়কর নোট বাতিল করেছিল, তা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দরিদ্রদের জন্য বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে আনলেও কালোটাকা বের হওয়ার কথা খুব কমই জানা গিয়েছিল।
অন্যদিকে, বড় দুর্নীতি কমেছে, এটি বিশ্বাস করারও খুব একটা কারণ নেই। কারণ, বৃহৎ সরকারি প্রকল্পে ঠিকাদারদের কাছ থেকে কর্মকর্তাদের মোটা ‘কমিশন’ হাতিয়ে নেওয়ার গল্প আছে বেশুমার।
বিজেপির দ্বিতীয় যে ভাষ্য ভোটারদের সবচেয়ে বেশি মোহিত করেছে, সেটিকে সংক্ষিপ্ত করে ‘মিগা’ (মেক ইন্ডিয়া গ্রেট এগেইন) বলা যেতে পারে। বিজেপির সব কটি প্রচারযন্ত্র থেকে অবিরাম ঘোষণা করা হচ্ছে যে ভারত তার সব ধরনের প্রভাব, সুযোগ–সুবিধা ও সমৃদ্ধি ব্যবহার করে খুব শিগগির একটি বৈশ্বিক পরাশক্তি হয়ে উঠবে।
পশ্চিমারা বিকল্প বাজার ও চীনকে মোকাবিলার ভূরাজনৈতিক অংশীদার হিসেবে ভারতকে গ্রহণ করায় এই ভাষ্য ভারতের বিপুলসংখ্যক তরুণ–যুবার (এমনকি তাঁদের মধ্যে বেকার অথবা সামান্য মজুরির কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরাও রয়েছেন) কল্পনাশক্তিকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছে।
কিন্তু তাদের সেই কল্পনার জগৎ শিগগিরই বাস্তব হয়ে ধরা দেবে, এমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
প্রণব বর্ধন বার্কলের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ইমেরিটাস অধ্যাপক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ