গাজার নুসাইরাত শরণার্থীশিবিরে ৮ জুন অভিযানের সময় ইসরায়েলের সেনাবাহিনী কমপক্ষে ২৭৪ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে। আহত করে ৭০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনিকে।
সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলো এ গণহত্যায় যথারীতি দায়সারাগোছের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল সর্বশেষ ইসরায়েলি ‘বেসামরিক গণহত্যার’ নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘এই রক্তস্নান অবশ্যই দ্রুত বন্ধ করতে হবে।’
এই গণহত্যার মাধ্যমে হামাসের হাতে বন্দী চারজন জিম্মিকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় ইসরায়েলিরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজয় আনন্দে আত্মহারা হয়ে আত্ম–অভিনন্দনের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন এবং ধুমধামের সঙ্গে গণহত্যা উদ্যাপন করছেন। ইন্টারনেট ভেসে যাচ্ছে সেই উদ্ধার অভিযানের আবেগঘন বর্ণনায় এবং স্বজনদের সঙ্গে মুক্ত হয়ে আসা ব্যক্তিদের কান্নাজড়িত পুনর্মিলনের ছবি ও ভিডিওতে।
প্রকৃতপক্ষে, মাত্র আট মাসের যুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে গাজার ৩৭ হাজার লোককে হত্যা করেছে ইসরায়েল। এই যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের জীবনের প্রতি নির্লজ্জ অবজ্ঞা দেখিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
এমন একটা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু কতটা আর মনোযোগ কাড়তে পারে। ধুলায় মিশে যাওয়া গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া লোকদের ধরা হলে এই যুদ্ধে নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা যে আরও অনেক বেশি, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
ইসরায়েলি বয়ানে ফিলিস্তিনিদের কখনোই মানুষের বলে মনে করা হয় না। অবশ্য এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রমও আছে; সেটা হলো ফিলিস্তিনিদের যখন প্রোপাগান্ডার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে ইসরায়েল। যেমন হামাসের বিরুদ্ধে সাধারণ ফিলিস্তিনিদেরকে ‘মানবঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ তোলে ইসরায়েল। এই বয়ানের মাধ্যমে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনিদের হাসপাতাল ও স্কুলে হামলা চালানোর বৈধতা তৈরি করার চেষ্টা করে।
গাজায় চিরস্থায়ী রক্তস্নানের আগের পর্বের দিকে তাকালে চারজন জিম্মিকে মুক্ত করে আনার বিনিময়ে ২৭৪ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করার বিষয়টি ইসরায়েলের সামরিক যুক্তিতে কোলাটেরিয়েল ড্যামেজ বা সমান্তরাল ক্ষতি হিসেবে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় খেলোয়াড়দের একজন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্যারিসে সংবাদ সম্মেলনে চারজন জিম্মির মুক্ত করে আনার ঘটনার প্রশংসা করেন। তিনি আরও বলেন, ‘সব জিম্মিকে মুক্ত করে ফিরিয়ে আনা এবং যুদ্ধবিরতি না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের কাজ থামাব না।’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিজেই যখন রক্তস্নান ঘটানোর জন্য ইসরায়েলিদের প্রশংসা করছেন, তখন কীভাবে একটা যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানো সম্ভব?
কেননা ইসরায়েলিদের জীবন একটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ সত্য দিয়ে অঙ্কিত। তারা মনে করে সংঘাতে যতজন ইসরায়েলি মারা যাবে ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা তার থেকে বহুগুণ বেশি হতে হবে। সব সময়ই ইসরায়েলিরা নিজেরা নিজেদের ভুক্তভোগী থেকে যাবে।
উদাহরণ হিসেবে কাস্ট লিড অভিযানের কথায় ধরুন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ইসরায়েল গাজায় এই অভিযান পরিচালনা করেছিল। ২২ দিনের এই অভিযানে ১ হাজার ৪০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ছিল সাধারণ মানুষ। শিশু ছিল চার শ। আর ইসরায়েলের ১০ জন সেনা ও তিনজন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছিলেন।
এরপর ২০১৪ সালে ৫০ দিন ধরে চলা ইসরায়েলের প্রটেকটিভ এডজ অভিযানে ৫৫১ শিশুসহ ২ হাজার ২৫১ জন গাজার বাসিন্দা হ্রাস পেয়েছিল। অন্যদিকে ইসরায়েলের ৬৭ জন সেনা ও ৬ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছিলেন।
বন্দী বিনিময়ের ক্ষেত্রেও বহুবার দেখা গেছে ইসরায়েলের জীবনের মূল্য ফিলিস্তিনিদের জীবনের মূল্য থেকে অনেক বেশি। ২০১১ সালে ইসরায়েলি বন্দী সেনা জিলাড শালিটের মুক্তির বিনিময়ে কমবেশি ১ হাজার ২৭ জন ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
এখন, নুসাইরাত শরণার্থীশিবিরের গণহত্যার ঘটনাটি একমাত্র ঘটনা নয়, যার মাধ্যমে বিশ্বকে অসংযত ভ্রষ্টাচারের পথে নিয়ে যেতে প্ররোচিত করছে ইসরায়েল। এটা আক্ষরিক ও প্রতীকীভাবে ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রচেষ্টাও। শনিবার শরণার্থীশিবিরে অভিযানকে উল্লাসের মাধ্যমে যেভাবে উদ্যাপন চলছে, সেটা ফিলিস্তিনিদের মুছে ফেলারই কার্যকর উদ্যোগ।
নুসাইরাত শিবিরে অভিযানকে কোলাটেরাল গণহত্যা বলুন।
এই হামলার পরে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে পোস্ট দিয়েছে সেখানে ফিলিস্তিনিদের হতাহতের কোনো উল্লেখই করা হয়নি। বরং কিন্তু সেখানে এমন চটুল বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে, ‘হামাস সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, যাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে যন্ত্রণা ও দুর্ভোগ সৃষ্টি’।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম জেরুজালেম পোস্ট ইসরায়েলি সেনাদের অভিনন্দন না জানানোয় আরব দেশগুলোর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের দোষারোপ করেছে। জেরুজালেম পোস্ট রীতিমতো বিলাপ করেছে এই বলে যে ইসরায়েলি সেনারা বীরত্বপূর্ণ অভিযানে চারজন বন্দীকে মুক্ত করে আনল। অথচ হামাসের সমর্থক কিছু মানুষ ইসরায়েলকে দোষারোপ করছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় খেলোয়াড়দের একজন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্যারিসে সংবাদ সম্মেলনে চারজন জিম্মির মুক্ত করে আনার ঘটনার প্রশংসা করেন। তিনি আরও বলেন, ‘সব জিম্মিকে মুক্ত করে ফিরিয়ে আনা এবং যুদ্ধবিরতি না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের কাজ থামাব না।’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিজেই যখন রক্তস্নান ঘটানোর জন্য ইসরায়েলিদের প্রশংসা করছেন, তখন কীভাবে একটা যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানো সম্ভব?
এই তো মাত্র মাসখানেক আগে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সতর্ক করে দিয়েছিলেন, গাজার দক্ষিণাঞ্চলের রাফায় ইসরায়েল যদি সর্বাত্মক অভিযান চালায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে অস্ত্র দেওয়া বন্ধ করবে। এর কারণ হিসেবে বাইডেন বলেছিলেন, এসব বোমায় বেসামরিক মানুষ নিহত হবেন। কিন্তু হঠাৎ করেই সেটা গুরুত্বহীন বিষয়ে পরিণত হলো। বেসামরিক লোকদের হত্যা চলতেই থাকল।
৬ জুন নুসাইরাত শরণার্থীশিবিরে জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলে ইসরায়েলি হামলায় সেখানে আশ্রয় নেওয়া ৪০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। আল-জাজিরার বিশ্লেষণে বেরিয়ে আসে, যে অস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলিরা হামলা চালায়, তার অংশবিশেষ যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি।
দেখেশুনে মনে হচ্ছে ইসরায়েলকে দেওয়া বাইডেনের সতর্কতা কোলাটেরাল ড্যামেজে পরিণত হয়েছে। অথবা সম্ভবত গণহত্যা পুরোপুরি স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।
বেলেন ফার্নান্দেজ আল-জাজিরার কলামিস্ট
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত