ঢালাওভাবে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিলের যৌক্তিকতা কতটুকু?

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গণমাধ্যমগুলোকে স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এরই মধ্যে গণমাধ্যম সংস্কারবিষয়ক একটি কমিশনও গঠন করা হয়েছে।

সরকারের গণমাধ্যমের প্রতি আন্তরিকতা সংবাদমাধ্যমগুলোকে আরও বেশি দায়িত্বশীল ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে অনুপ্রাণিত করছে, যার নমুনা আমরা দেখছি। প্রায় প্রতিদিনই আমাদের গণমাধ্যমগুলো বিশেষ বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করার সাহস দেখাচ্ছে। আগের সরকারে যে সংবাদটি প্রকাশ করতে ভাবতে হতো, এখন তা ভাবতে হচ্ছে না। বিপ্লব-পরবর্তী রাষ্ট্র বিনির্মাণে সংবাদপত্রের সঙ্গে সরকারের এই মেলবন্ধন সত্যিই প্রয়োজন ছিল।

আমরা যখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলছি, তখন সরকারের ভেতর এক অদ্ভুত শক্তি গত তিন দফায় মোট ১৬৭ জন সাংবাদিকের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে। এ তিন তালিকায় চোখ বোলালে দেখা যাচ্ছে, এসব সাংবাদিকদের সিংহভাগই সক্রিয় সাংবাদিকতায় জড়িত। পত্রিকার সম্পাদক থেকে শুরু করে সাংবাদিকদের ঢালাও ছাঁটাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে শুধু খর্ব করছে না, এটি একটি খারাপ নজিরও স্থাপন করতে যাচ্ছে, যা নিয়ে ইতিমধ্যে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) এবং বাংলাদেশের সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন ‘সম্পাদক পরিষদ’ প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, সরকার এই তিন মাসের মেয়াদের মধ্যে সাংবাদিকদের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিলের জন্য উঠেপড়ে লাগল কেন? অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল হলেও কি সংবাদপত্রে স্বাধীনতার পুনর্জন্ম হবে? নাকি বিতর্ক তৈরি করে সরকার নিজেই বিব্রতবোধ করবে?

আপাতদৃষ্টে বাতিল হওয়া অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড মালিকদের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, তাঁদের মধ্যে একটি অংশ বিদায়ী সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন। অনেকেই শেখ হাসিনা সরকারের তাঁবেদারি করতে গিয়ে সাংবাদিকতাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। অনেকেই প্রধানমন্ত্রী দপ্তরের সংবাদ সংগ্রহের জন্য হাউসগুলো থেকে নিয়োজিত। কেবল আওয়ামী লীগ বিটের সংবাদ পরিবেশনের অপরাধে কারও অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, তবে সংবাদপত্রের সম্পাদকদের রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বলি দেওয়া সংগত মনে হচ্ছে না।

সরকার যে যুক্তিতে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে, সেই যুক্তিগুলোর দিকে নজর দিলে দেখা যাচ্ছে, অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিলে প্রেস অ্যাক্রেডিটেশনের নীতিমালা ২০২২ চেয়ে পতিত শেখ হাসিনা সরকারপন্থী সাংবাদিকদের তালিকাকে সামনে রাখা হয়েছে, যাঁরা অতীতে সরকারপন্থী সাংবাদিকদের সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছে, সদস্য ছিল।

তথ্য অধিদপ্তর (পিআইডি) অ্যাক্রেডিটেশনের নীতিমালা ২০২২-এর অনুচ্ছেদ ৬.৯, ৬.১০, ৯.৫ এবং ৯.৬ ধারার আলোকে স্থায়ী ও অস্থায়ী সাংবাদিকদের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিলের কথা বলেছে। কার ক্ষেত্রে ঠিক কোন ধারাগুলোর আওতায় পড়েছে, তা সেই চিঠিতে স্পষ্ট না হলেও পাঠকদের সুবিধার্থে এই ধারাগুলো নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।  

নীতিমালার প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড ইস্যুর সাধারণ শর্তাদির ৬.৯ অনুচ্ছেদ বলা হচ্ছে,  প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কার্ডধারী সাংবাদিকেরা রাষ্ট্রীয় কোনো আইন, বিধি বা নীতিমালা লঙ্ঘন করলে প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কমিটি সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন, বিধিবিধান ও নীতিমালা অনুসারে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। তবে গুরুতর লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে প্রধান তথ্য অফিসার তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্ত সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে পরে প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কমিটির সভায় তা উপস্থাপন করতে হবে।

অর্থাৎ এই ধারায় অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল হওয়া দেড় শতাধিক সাংবাদিক রাষ্ট্রীয় ঠিক কোন আইন বা নীতিমালা ভঙ্গ করলেন, তা বলা হয়নি। রাষ্ট্রীয় আইন যদি তাঁরা সত্যি সত্যি ভঙ্গ করেন, তাহলে তাঁরা কীভাবে এখনো সক্রিয় সাংবাদিকতা করে যাচ্ছেন, প্রতিদিন সংবাদ সংগ্রহ করছেন এবং তা পত্রিকায় পরিবেশন করছেন? ধরলাম, তাঁরা কোনো আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন, তাহলে তাঁদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নিয়ে ‘তাৎক্ষণিক অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল’ করার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু ছিল? আর রাষ্ট্রীয় আইন ভঙ্গ করলে, দেশে ফৌজদারি আইন রয়েছে, যাঁরা অপরাধে জড়িয়ে পড়বেন, তাঁদের শাস্তি আদালতে হবে।  

একই অনুচ্ছেদের ৬.১০ ধারায় বলা হচ্ছে, ‘মিথ্যা, হয়রানিমূলক, রাষ্ট্রদ্রোহ বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী কোনো সংবাদ প্রচারের অভিযোগে প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কার্ডধারী কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা দায়ের হলে এবং উক্ত মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল হলে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের নামে ইস্যুকৃত অ্যাক্রেডিটেশন কার্ডটি প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কমিটি সাময়িকভাবে স্থগিত করতে পারবে এবং দোষী সাব্যস্ত হলে কমিটি কার্ডটি বাতিল করতে পারবে।’

অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ঢাকায় অর্ধশতাধিক সাংবাদিকের নামে নালিশি মামলা হয়েছে। যা নিয়ে এরই মধ্যে সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো উদ্বেগ জানিয়েছে। যদি আমরা ধরেও নিই অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিলকৃতদের নামে মামলা হয়েছে, তাহলে সেই সংখ্যাটি নিশ্চয় ১৬৭ জন নয়। আবার মামলা যদিও হয়েও থাকে অভিযোগপত্র দাখিল হওয়ার আগপর্যন্ত অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিলের নিয়ম ৬.১০ বলা হয়নি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মামলার গ্যাঁড়াকলে পড়া সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এখনো পুলিশ বা তদন্তকারী কর্মকর্তারা অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেছে, এমন তথ্য এই কার্ড বাতিল হওয়ার নোটিশের আগপর্যন্ত আসেনি বা হয়নি। তাহলে কোন যুক্তিতে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিলের দায় হিসেবে নীতিমালার ৬.১০ অন্তর্ভুক্ত করা হলো? এটা কি নিছক কোনো অনুচ্ছেদ নাকি তথ্য অধিদপ্তরে ভর করা অদৃশ্য শক্তির ইশারা?

আবার আসি অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল বা স্থগিতের যে বিধিবিধান গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সেই বিষয়ে। তিন দফায় সাংবাদিকদের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল হওয়া শর্তের ৯.৫ এবং ৯.৬ অনুচ্ছেদে। এখানে বলা হচ্ছে, ‘প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কার্ডধারী সাংবাদিক/সংবাদকর্মী বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল কর্তৃক প্রণীত “কোড অব কনডাক্ট” অথবা সরকার কর্তৃক অনুমোদিত “প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন নীতিমালা’-র কোনো শর্ত লঙ্ঘন করলে তাঁর অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হবে এবং বাতিলসংক্রান্ত আদেশ তথ্য অধিদপ্তর তাৎক্ষণিকভাবে জারি করবে।’

এখন অনুচ্ছেদ বিবেচনায় সরকার চাইলে ঠুনকো অভিযোগ তুলে যে কারও অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করতে পারে। এখন এই নীতিমালায় যেসব বাতিলের শর্ত শুরুতে রয়েছে (৯.১), অ্যাক্রেডিটেশন কার্ডধারী কেউ কর্মস্থল পরিবর্তন কিংবা সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিত্ব থেকে বিরত থাকলে তাঁর অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হবে। আমার ব্যক্তিগত জানামতে বাতিল হওয়া কিছু সাংবাদিক তাঁর কর্মস্থল পরিবর্তন করেছে, নতুন কর্মস্থলে গিয়ে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড আবেদন করেছে কি না, জানি না, তবে এই অ্যাক্রেডিটেশন কার্ডধারীদের সিংহভাগই বর্তমান কর্মস্থলে নিয়োজিত। এ বিবেচনায় অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিলের ঢালাও সম্ভাবনাটুকু ক্ষীণ।

এখন প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনার অনুরাগী সাংবাদিকদের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করলে সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ফেরাতে পারবে কি না? যদিও তথ্য উপদেষ্টা জোর গলায় বলছেন, তাঁরা গণমাধ্যমের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে চান না (প্রথম আলো, ১২ নভেম্বর)। সেটাই যদি হয়, তাহলে ‘গণমাধ্যমের ওপর সরকারের কোনো চাপ নেই’ বক্তব্য কেন আসবে? এসব বক্তব্য আমরা অতীতে শুনেছি। গণমাধ্যম স্বাধীন বলে সারা দিন চিৎকার করেছিল তারা। আমরা সেই স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছি, যার ফলে মানুষ ফুঁসে উঠেছিল, রাস্তায় নেমেছে এবং আপনাদের ক্ষমতায় বসিয়েছে। এখন আপনারা যদি মনে করেন, এ দেশে ভিন্নমতের সাংবাদিকেরা ‘মুক্ত সাংবাদিকতা’র চর্চা করতে পারবেন না, তাহলে এই রক্তের বিনিময়ে আমরা কোন দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখব?

আপনারা যদি আমাদের সাংবাদিকদের নিশ্চিত করতে পারেন, সাংবাদিকেরা ভবিষ্যতে দলীয়বৃত্তিতে সাংবাদিকতা করবেন না, অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড আবার ক্ষমতাসীন সাংবাদিকদের গলায় ঝুলবে না, অপেশাদার সাংবাদিকেরা সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে আসবে না, তাহলে আমি অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিলের পক্ষে। কিন্তু আপনারা যদি কেবল কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনা সরকারের দোসর মনে করে ঢালাওভাবে কোনো যৌক্তিকতা ছাড়ায় সাংবাদিকদের তথ্য পাওয়ার সুরক্ষার অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করবেন, তাহলে সেটা হবে দ্বিচারিতা।

এ কথা সত্য, অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল হওয়া কিছু অখ্যাত গণমাধ্যম রয়েছে, তাদের সাংবাদিক রয়েছে। তাঁরা পেশাদার সাংবাদিক কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। প্রয়োজনে তাঁদের তথ্য অধিদপ্তর তলব করতে পারে। কিন্তু পেশাদার সাংবাদিকদের, সম্পাদকদের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল কিছুতে মানা সম্ভব না। এটা একধরনের নিপীড়ন, যা সরকারের আদর্শের সঙ্গে যায় না। আমরা এই সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করতে চাই, নতুন করে বৈষম্যের জন্ম হোক, তা কেউই চাই না।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে বিশ্বাস করতে হলে ‘সাংবাদিকদের মত’ প্রকাশের স্বাধীনতাটুকুও থাকা চাই। সাংবাদিকদের পেশাদারিতে প্রশ্ন থাকলে সরকার সে বিষয়ে আলোচনা করতে পারে। সেটা না করে এই দেড় শতাধিক সাংবাদিকের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল সরকারের ভালো কাজকে বিতর্ক তৈরি করবে, বিব্রত করবে। তাই সরকারের উচিত, অবিলম্বে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিলের আদেশটি প্রত্যাহার করে নেওয়া। মুক্ত সাংবাদিকতার প্রতিটি দরজা খুলে দেওয়া।

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল: [email protected]