বিজেপি কি একক শক্তি নিয়ে ক্ষমতায় ফিরতে পারবে

বিজেপি ও এনডিএ জোট ৪০০ আসনে জয় পেতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেছবি: রয়টার্স

ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচন ১৯ এপ্রিল শুরু হয়েছে। সাত ধাপের এ নির্বাচন শেষ হবে ১ জুন। ফলাফল জানা যাবে ৪ জুন। এ নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে ইভিএমে সম্পন্ন হচ্ছে। ভোটার প্রায় ৯৭ কোটি। নির্বাচন হচ্ছে ৫৪৫টি আসনের ৫৪৩টিতে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে একটি দলকে অথবা জোটকে ন্যূনতম ২৭২টি আসন পেতে হবে। নির্বাচনের বাজেট ধরা হয়েছে ১ হাজার ৪৪০ কোটি রুপি। ভোট গ্রহণ হচ্ছে প্রায় ১০ লাখ ৫০ হাজার কেন্দ্রে। 

রাজ্যভিত্তিক অনেক দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকলেও নির্বাচনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে ক্ষমতাসীন বিজেপি, তাদের জোট এনডিএ (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স) এবং প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস ও তাদের জোট আইএনডিএ বা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্সের মধ্যে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দাবিদার। অন্যদিকে বিরোধীরাও ভালো করার আশাবাদী।

বিজেপি ও এনডিএ ৪০০ আসনে জয়ী হতে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, বিজেপি এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও এনডিএ জোট ক্ষমতায় ফিরবে, তবে দুর্বল জোট হতে পারে। এরই মধ্যে বিজেপি তার হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডা সামনে রেখে সংবিধান পরিবর্তন করে ভারতকে ‘হিন্দু রাষ্ট্রে’ পরিবর্তনের ঘোষণা দেওয়ায় দেশটির ধর্মনিরপেক্ষপন্থীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।

আরও পড়ুন

বিজেপি এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় প্রথমে বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্মীয় অনুভূতি কাজে লাগাতে চেয়েছিল। তবে রামমন্দির নির্মাণের আগে যে উন্মাদনার কথা শোনা গিয়েছিল, মন্দির উদ্বোধনের পর সেটা দেখা যায়নি। ভারতের একজন বিখ্যাত বিশ্লেষকের মতে, ভগবান রামের যে প্রভাব হিন্দিভাষী অঞ্চলে (উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা ও গুজরাট) রয়েছে, অন্যান্য অঞ্চলে তেমনটা নেই। বিষয়টি সরকারি দল ও জোটকে ভাবিয়ে তুলেছে।

এ কারণেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাজস্থানে এক সমাবেশে সরাসরি সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করেছেন। এর আগে ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে এমনটি দেখা যায়নি। শুধু তা–ই নয়, ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত আম্বানি ও আদানিকে নিয়েও তিনি নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। 

নরেন্দ্র মোদির এসব বক্তব্য নিয়ে ভারতে এখন তোলপাড়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, চতুর্থ দফা নির্বাচনের পর বিজেপি ও জোটের মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা লক্ষণীয়। যেহেতু এবার গত নির্বাচনের মতো জাতীয়তাবাদের চেতনা, পুলওয়ামার মতো ঘটনা, পাকিস্তানবিরোধী অ্যাজেন্ডা নেই, তাই অন্যান্য ব্যর্থতা ঢাকতে ধর্মীয় কার্ড ব্যবহার করতে হচ্ছে।

ভারতে গত ১০ বছরের মোদি সরকারের শাসনামলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভ্রান্ত ধারণা, শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, রুপির নিম্নমুখী মান এবং করোনাকালের অব্যবস্থাপনা—সবই প্রকট হয়ে উঠেছে। এসব জাতীয় ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে বিজেপি ধর্মান্ধতা ও হিন্দুত্ববাদের বিষয়টিতেই জোর দিচ্ছে। মোদি সরকারের এ প্রয়াসে বলিউডের কিছু নির্মাতা যোগ দিয়েছেন, কিন্তু এসব চলচ্চিত্র সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। 

সব মিলিয়ে মনে হতে পারে, সরকারি দল বিজেপি আবার ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু একক শক্তি হওয়া নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। চতুর্থ দফা ভোট গ্রহণ পর্যন্ত আসা বিভিন্ন অভিযোগের কারণে স্পষ্ট হচ্ছে, এবার ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থায় যথেষ্ট ব্যত্যয় ঘটছে। উদার গণতান্ত্রিক দেশের সূচকে ভারতের অবস্থান ১০৪তম। ভারত পড়েছে ‘নির্বাচনভিত্তিক স্বৈরতন্ত্র’ বিভাগে। ভারতের এ অবস্থা গণতান্ত্রিক বিশ্বের জন্য উদ্বেগজনক।

এবারের নির্বাচন যেভাবে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি নিজেদের অনুকূলে আনার চেষ্টায় নির্বাচনী আইন ও মডেল কোড অব কন্ডাক্ট ভঙ্গ করে চলেছে। এর বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে জমা পড়লেও কমিশনকে তেমন তৎপর হতে দেখা যাচ্ছে না। বিজেপির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের অভিযোগ করা হলেও দলটির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বিজেপির প্রধানকে দায়সারা চিঠি দিয়ে নির্বাচন কমিশন বেশ বিতর্কিত হচ্ছে।

পর্যবেক্ষকদের মতে, বিগত দিনগুলোয় ক্ষমতাসীনেরা যেভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে চেপে ধরেছে, তাতে ভারতের বিচারালয় থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশনও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনে দুজন কমিশনারের নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।

অন্যদিকে সরকার কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলো, যেমন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি), আয়কর বিভাগ, গোয়েন্দা সংস্থা ইত্যাদিকে সরকারবিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে বলে দৃশ্যমান অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, আম আদমি পার্টির অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার ও জেলে পাঠানো আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

এনডিএ জোটে যোগ দেওয়ার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করায় কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। কেজরিওয়ালের কিছু কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠিত হয়নি। নিম্ন আদালত তাঁকে জামিন দেননি। ৫০ দিন জেলে থাকার পর সুপ্রিম কোর্ট থেকে তিনি জামিন পান। শুধু কেজরিওয়ালই নন, বিরোধী আরও অনেক নেতার বিরুদ্ধে এমনটি দেখা যায়। 

অনেক জায়গায় ভয়ভীতি দেখিয়ে অথবা সামান্য কারণে মনোনয়নপত্র বাতিলের অভিযোগও রয়েছে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে। সুরাটের একটি আসনে বিভিন্ন অভিযোগে প্রধান বিরোধী দলের প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল ও বিভিন্ন কারণে অন্যদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের কারণে আসনটিতে বিজেপি প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন সমালোচনার মুখে পড়েছে। অরুণাচলের ৬০ আসনবিশিষ্ট রাজ্য সংসদে ১০ জন বিজেপি প্রার্থী বিরোধীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার বা বাতিল হওয়ার কারণে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ভারতে আগের কোনো নির্বাচনে এমন ঘটনা বিরল।

এ ধরনের বহু অভিযোগ রয়েছে, যার সিংহভাগ নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপের ভোটের হার প্রকাশ নিয়েও জোর সমালোচনা চলছে। তৃতীয় ধাপে পর্যবেক্ষক, নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনুরোধ ও আপিল সত্ত্বেও বৈধ ভোটার ও ভোটারের সংখ্যা প্রকাশ করেনি বা করার ইচ্ছাও প্রকাশ করেনি তারা। নির্বাচন কমিশনের এসব কার্যকলাপকে খুব ভালোভাবে গ্রহণ করছে না সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগ অব্যাহত রয়েছে যে কিছু কিছু জায়গায় সংখ্যালঘু ভোটারদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

এবার ভারতের নির্বাচনে দুর্নীতি একটি প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে ‘ইলেকটোরাল বন্ড’ ইস্যু প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে। এর মারফত অজ্ঞাত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে বিশাল অঙ্কের অর্থ রাজনৈতিক দলকে অনুদান দেওয়া হয়েছে। এ অনুদানের (প্রায় ৭ হাজার কোটি রুপি) মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বিজেপি। তৃতীয় স্থানে কংগ্রেস, ১ হাজার ৩০০ কোটি রুপির বেশি। অবশ্য কর বিভাগ অনাদায়ি করের অজুহাতে কংগ্রেসসহ কয়েকটি বিরোধী দলের তহবিল অকার্যকর করে রেখেছে। এবার ভারতের প্রচারমাধ্যমও অনেক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে।

সব মিলিয়ে মনে হতে পারে, সরকারি দল বিজেপি আবার ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু একক শক্তি হওয়া নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। চতুর্থ দফা ভোট গ্রহণ পর্যন্ত আসা বিভিন্ন অভিযোগের কারণে স্পষ্ট হচ্ছে, এবার ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থায় যথেষ্ট ব্যত্যয় ঘটছে। উদার গণতান্ত্রিক দেশের সূচকে ভারতের অবস্থান ১০৪তম। ভারত পড়েছে ‘নির্বাচনভিত্তিক স্বৈরতন্ত্র’ বিভাগে। ভারতের এ অবস্থা গণতান্ত্রিক বিশ্বের জন্য উদ্বেগজনক।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ) 

[email protected]