২০১১ সাল থেকে ২৭টি ডিজিটাল পরিষেবা খাতে সরকারের দেওয়া কর অব্যাহতি চলমান অর্থবছরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তথ্যপ্রযুক্তি খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অংশীজন এই অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানোর দাবি জানিয়ে এসেছেন। অবশেষে সরকারের বাজেট ঘোষণায় এই কর অব্যাহতির মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়ানো হয়েছে। স্মার্ট হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগোতে থাকা একটি দেশের জন্য এটি যে সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সঙ্গে সঙ্গে অংশীজনদের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়ার সংস্কৃতি তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রেও এটি উদাহরণ হয়ে থাকবে।
তবে তালিকায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ব্লকচেইনের মতো নতুন কিছু খাত যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি বলতে গেলে কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবে বাদ পড়েছে ক্লাউড পরিষেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাত। অথচ এই ক্লাউড পরিষেবার ওপর নির্ভর করবে উপাত্ত সুরক্ষা, ডেটা বিশ্লেষণ, ডেটাভিত্তিক সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর বহু উদ্ভাবনী সমাধানের আবির্ভাব। যেখানে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক হরেক রকম ক্লাউড পরিষেবা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সরকারের উৎসাহমূলক উদ্যোগ হাতে নেওয়া উচিত, সেখানে কী যুক্তিতে সেটিকে কর অব্যাহতির বাইরে রাখা হয়েছে, সেটি বোধগম্য নয়।
অ্যাকিলিসের জন্মের পর দেবতা থেটিস তাঁকে অমরত্ব দেওয়ার লক্ষ্যে স্টিক্স নদীতে ডুবিয়ে নেন। এ নদীর পানি শরীরের যে যে অংশে লাগবে, কোনো অশুভ শক্তি সে অংশের ক্ষতি করতে পারবে না, সেটি হয়ে উঠবে অপরাজেয়
অন্যদিকে কোন সে কারণে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করা ইন্টারনেট সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠান আইএসপিগুলোকে, অংশীজনেরা ক্রমাগত দাবি জানিয়ে আসার পরও, তথ্যপ্রযুক্তি সেবা (আইটিইএস) খাতে অন্তর্ভুক্তি করা হয়নি, সেটিও অজানাই থাকল। এর সঙ্গে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেটের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা। ইন্টারনেটের মূল্য কম রাখলে যে ক্ষতি হবে, গ্রহণযোগ্য গতি দিতে পারলে তার কয়েক গুণ লাভ ফ্রিল্যান্সাররাই নিয়ে আসবেন। মূল্য নয়, প্রয়োজন ইন্টারনেটের গতি বৃদ্ধির।
অবশ্য সবকিছুকে ছাপিয়ে আলোচনায় এসেছে এই কর অব্যাহতি পাওয়ার জন্য সব ব্যবসায়িক কার্যক্রম ক্যাশলেস হওয়ার শর্ত। অনেকটা হঠাৎ জুড়ে দেওয়া এই শর্ত কিছুটা অস্পষ্টও। সব ব্যবসায়িক কার্যক্রম ক্যাশলেস হওয়ার অর্থ কী? নগদের পরিবর্তে শতভাগ কার্যক্রম নোটবিহীন বা ক্যাশলেস হওয়া এমনিতেই অবাস্তব চিন্তা। পরীক্ষা হলেও তো ১০০–এর মধ্যে ৮০ পেলে সেটিকে অনন্য (এক্সিলেন্ট) হিসেবে ধরা হয়। তাহলে কত শতাংশ কার্যক্রম ক্যাশলেস হলে সব ব্যবসায়িক কার্যক্রম ক্যাশলেস বলা যাবে? ব্যবসা দ্বিপক্ষীয় বিষয়, দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে কোনো নীতি বাস্তবায়ন করতে হলে দুই পক্ষকে সক্রিয় হতে হয়। যেকোনো একটি পক্ষ যদি ক্যাশলেস না হয়, অন্য পক্ষ চাইলেও সহজে ক্যাশলেস হতে পারবে না।
সরকারের সব সেবা কি কাশলেস হয়েছে? তা না হলে সরকারের সঙ্গে সব ব্যবসায়িক কার্যক্রমই তো ক্যাশলেস করা সম্ভব নয়। সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ির চালককেও সতর্ক থাকতে হয়, শুধু নিজে সতর্ক থাকলে দুর্ঘটনা এড়ানো যায় না। দেশের কত শতাংশ মানুষ ডিজিটাল আর্থিক খাতের আওতায় এসেছে? যদি ৩০ শতাংশও সে আওতায় না আসে, তাদের সঙ্গে কী করে ক্যাশলেস কার্যক্রম চালানো সম্ভব? তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ী মানেই ক্যাশলেস হওয়ার শর্ত দিয়ে দেওয়া—কিছুটা হারমোনিয়াম ব্যবসায়ীকে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার শর্ত দিয়ে দেওয়ার মতো হয়ে গেল।
তবে যে উদ্দেশ্য নিয়ে এ শর্ত দেওয়া হয়েছে, সেটির যৌক্তিকতা আছে। ক্যাশলেস তৈরির যে ভিশন সরকারের আছে, সেটি এই খাতসংশ্লিষ্ট অংশীজনেরাই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে নিতে পারবেন। এর জন্য অনেক উপায়ে ধাপে ধাপে ‘ক্যাশলেস’ হওয়ার শর্ত দেওয়া যেতে পারে। যেমন ৬০ শতাংশ কার্যক্রম ক্যাশলেস হওয়ার শর্ত থাকতে পারে, নগদ লেনদেনের ক্ষেত্রে অব্যাহতির কিছু অংশ কমানো যেতে পারে, প্রতিবছর ক্যাশলেস কার্যক্রম ২০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেলেই যথেষ্ট ধরা যেতে পারে প্রভৃতি উপায়ে সহনীয়ভাবে এই ক্যাশলেস উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
অন্যদিকে ব্যবসায়িক কার্যক্রম ক্যাশলেস করার জন্য যে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ প্রয়োজন, সেটি কি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া যাচ্ছে? কার্ডে লেনদেন করলে, মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন করলে, ক্যাশ আউট করলে যদি উল্লেখযোগ্য হারে কমিশন দিতে হয়, লেনদেন নিষ্পত্তি হতে যদি একাধিক দিন দেরি হয়, তাহলে মনস্তাত্ত্বিক কারণেই ক্যাশলেস লেনদেনে মানুষ উৎসাহিত হবে না।
নগদ টাকার লেনদেনের ক্ষেত্রে মানুষকে কখনো শুনতে হয় না যে আজ শুক্রবার, ছুটির দিন, আজ লেনদেন বন্ধ। ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের ক্ষেত্রে সেটি যদি শুনতে হয়, মানুষ তো নগদ লেনদেনে যাবেই। যৌক্তিক আর প্রযুক্তিগত যত কারণই থাকুক না কেন, মানুষ তাৎক্ষণিক লেনদেনে অভ্যস্ত, যেটি সারা দেশে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল পরিষেবা জনপ্রিয় হওয়ারও অন্যতম কারণ। অতএব গোটা দেশের ক্যাশলেসবান্ধব অবকাঠামো ও পরিবেশ সৃষ্টি না করে সেটি শুধু তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মানুষদের ওপর চাপিয়ে দিলে হবে না।
অ্যাকিলিসের জন্মের পর দেবতা থেটিস তাঁকে অমরত্ব দেওয়ার লক্ষ্যে স্টিক্স নদীতে ডুবিয়ে নেন। এ নদীর পানি শরীরের যে যে অংশে লাগবে, কোনো অশুভ শক্তি সে অংশের ক্ষতি করতে পারবে না, সেটি হয়ে উঠবে অপরাজেয়। কিন্তু গোড়ালির যে অংশ হাতে ধরে অ্যাকিলিসকে পানিতে ডুবিয়েছিলেন থেটিস, সেই অংশ ঠিকই শুকনা থেকে যায়। বিখ্যাত ট্রয়ের যুদ্ধে সে গোড়ালিতে বিষাক্ত তির বিঁধেই মৃত্যু হয় অ্যাকিলিসের। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে স্টিক্স নদীর পানিতে ডুবানো হলো ঠিকই, সঙ্গে ক্যাশলেস হওয়ার শর্ত বসিয়ে গোড়ালিটুকু শুকনা রেখে দেওয়া হলো কি না, সে আশঙ্কা কিন্তু দূর হলো না।
ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক