ইসরায়েলে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ২০২১ সালে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলে, আত্মজীবনী লেখার সিদ্ধান্ত নেন। বছর খানেকের মধ্যেই ‘বিবি: মাই স্টোরি’ বাজারে আসে। ইংরেজি ও হিব্রু ভাষায় লেখা সাড়ে ৬০০ পাতার বইটি প্রকাশের পর দ্রুতই সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের স্বীকৃতি পায়।
প্রায় ২৫ বছর ধরে জনসমক্ষেই ছিলেন নেতানিয়াহু। ফলে নেতানিয়াহুর জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল নিজেকে ঠিক কীভাবে উপস্থাপন করলে নতুন কিছু জানতে পারবে পাঠক। আর পাঠকের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল, আত্মপ্রেম আর অতিরঞ্জিত ভাষ্যের বাইরে নেতানিয়াহুর প্রকৃত চেহারা খুঁজে বের করা সম্ভব হবে কি না।
খ্যাতনামা বই সমালোচক জেন আইজনারও তাই নেতানিয়াহুকে বুঝতে পাশাপাশি দুটি বই রাখলেন। একটি—‘বিবি: মাই স্টোরি’। আর অন্যটি ছিল, ইসরায়েলি সাংবাদিক অ্যানশেল ফেফারের ‘বিবি: দ্য টারব্যুলেন্ট লাইফ অ্যান্ড টাইমস অব বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু’। গার্ডিয়ানে লিখলেন, বই দুটি পড়ে তিনি একটা বিষয়ে পরিষ্কার। নিজের গুণকীর্তনে নেতানিয়াহুর মেধা অতুলনীয়। তিনি এমনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন, যে তাঁর তুলনা তিনিই। যেমন, তিনি অতুলনীয় রাষ্ট্রনেতা, তাঁর বাবা বেনিজয়ন অতুলনীয়, ভাই জোনাথন অতুলনীয়, স্ত্রী সারাহ নেতানিয়াহুর তো স্বর্গ–মর্ত্য কোথাও কোনো তুলনা নেই – এমন আরকি।
একদিক থেকে নেতানিয়াহু অতুলনীয়ই বটে। তাঁকে বলা হয়, ইসরায়েলের প্রথম ‘টিভি’ প্রধানমন্ত্রী। জনসমক্ষে যেন তাঁর কলাকৌশল ঠিকঠাক থাকে, সে জন্য তিনি অভিনয়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তিনি নিয়মিত মেকআপ করেন। আলোকচিত্রী ও ভিডিওগ্রাহকদের বলা আছে, কেবল যে অ্যাঙ্গেলে তাঁকে ভালো দেখায়, সেই অ্যাঙ্গেল থেকেই যেন ছবি তোলা হয়। যখন ইসরায়েলের আর সব নেতারা ফুলহাতা শার্টের হাতাটুকু গুটিয়ে অনায়াসে ক্যামেরার সামনে বসে যেতে পারেন, নেতানিয়াহু তখন অতি মূল্যবান স্যুটে স্বচ্ছন্দ। বিলাসব্যসনের প্রতি তাঁর অনুরাগ প্রকাশ্য এবং চিরকালীন।
নিজেকে তিনি চার্চিলের ইসরায়েলি সংস্করণ বলে দাবি করেন। তিনিই ইরানের বিপজ্জনক হামলা থেকে সুরক্ষা দানকারী, তিনিই সারা বিশ্বের ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের ত্রাণকর্তা। তবে সমালোচকেরা বলছেন, ৭৫ বছর বয়সী রাষ্ট্র ইসরায়েল এর আগে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। দেশটির গণতন্ত্র হুমকির মুখে, জাতি হিসেবে এত বিভেদ আগে কখনো ছিল না। ইসরায়েল ক্রমশ ডুবছিল, সেটা এখন দৃশ্যমান।
মাস চারেক আগে গার্ডিয়ান, ‘দ্য নেতানিয়াহু ডকট্রিন: হাউ ইসরায়েলস লঙ্গেস্ট সার্ভিং লিডার রিশেপড দ্য কান্ট্রি ইন হিজ ইমেজ’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন ছাপে।
গার্ডিয়ান লিখেছে, ৭ অক্টোবর হামাস হামলা চালিয়েছে। কিন্তু এমন হওয়ার কথা ছিল না। অন্তত যখন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ক্ষমতায়। তাঁকে তাঁর বশংবদেরা ‘মি. সিকিউরিটি’ বলে জানে। তাঁর আমলেই ইসরায়েল আয়রন ডোম গড়েছিল গাজা উপত্যকা থেকে ছোড়া রকেট হামলা থেকে সুরক্ষা পেতে। গাজা সীমান্তে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে কাঁটাতারের বেড়া, মাটির তলদেশে সেন্সর, দূর নিয়ন্ত্রিত অস্ত্র ও সর্বত্র ক্যামেরা।
নেতানিয়াহু দুর্গরাষ্ট্র ইসরায়েল গড়েছেন। তেল আবিবের ক্যাফেতে বসে ফিলিস্তিনিদের ভোগান্তি তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। গত দশকে ফিলিস্তিন অপেক্ষাকৃত শান্ত ছিল, এই মিথের ভিত্তি কিছুটা কল্পনা। কংক্রিটের দেয়ালের পেছনে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার যে আকাঙ্ক্ষা, সেটা চাপা পড়ে থাকবে, উপেক্ষা করলেও ক্ষতি নেই—এমনটাই ভেবেছিল তারা। তারা ভেবেছিল, কেবল প্রযুক্তি আর অস্ত্র দিয়েই ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ করা যাবে। বিশ্ব তথা সুন্নি আরব রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে ক্লান্ত। ফিলিস্তিনিদের নিয়ে বিশ্ব আর মাথা ঘামাচ্ছে না। তাই ইসরায়েলি সরকার যা খুশি, তা-ই করতে পারে।
খুব অল্প সময়ের জন্য বিরোধী দলে ছিলেন নেতানিয়াহু। এর বাইরে প্রায় এক যুগ তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেকেই নেতানিয়াহুকে ‘কিং বিবি’ বলে থাকেন। এত কিছুর পরও তাঁর সমর্থকদের কাছে রাজনীতিতে তিনি এক অজেয় পুরুষ।
ফিলিস্তিন ইস্যুতে নেতানিয়াহুর আচরণ এত নির্লজ্জ কেন
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, নেতানিয়াহুর জন্ম ১৯৪৯ সালে তেল আবিবে। তিনি বেড়ে উঠেছেন জেরুজালেমে। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় তিনি পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তাঁর বাবা ঐতিহাসিক বেনজিয়ন নেতানিয়াহু ওখানে শিক্ষকতা ও গবেষণার সুযোগ পেয়েছিলেন।
১৯৬৭ সালে নেতানিয়াহু আইডিএফের অভিজাত শাখা সাইয়েরেত মাতকালে যোগ দেন। ১৯৭২ সালে ছিনতাই হওয়া উড়োজাহাজ থেকে জিম্মি উদ্ধার অভিযান ও ১৯৭৩ সালে ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন। স্থাপত্যকলায় স্নাতকের পর এমআইটি থেকে ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা ও হার্ভার্ডে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন।
‘বিবি: মাই স্টোরি’তে নেতানিয়াহু তিনটি চরিত্রের কথা বলেছেন, যাঁরা তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব রেখেছে। এই তালিকায় আছেন তাঁর বাবা বেনজিয়ন। ১০২ বছর বয়সে ২০১২ সালে তিনি মারা যান। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিন নেতানিয়াহুর তুতো ভাই ড্যান নেতানিয়াহুকে উদ্ধৃত করে লিখেছে, বেনজিয়ন স্বভাবে ছিলেন অত্যন্ত একরোখা এবং জটিল চরিত্রের মানুষ। কিন্তু তাঁকে নেতানিয়াহু রীতিমতো পূজা করতেন। এই বেনজিয়ন ছিলেন জায়নবাদী, অতি ডানপন্থী ব্যক্তি। তিনি মনে করতেন, নাৎসিদের ধারাবাহিকতার প্রতীক হলো ফিলিস্তিনিরা। তারা শয়তানের আধার। নেতানিয়াহু এই বোধ নিয়ে বড় হয়েছেন। এ নিয়ে কোনো রাখঢাক কখনোই করেননি।
বড় ভাই জোনাথন, যাঁকে নেতানিয়াহু ইয়োনি বলে ডাকতেন, তিনিও নেতানিয়াহুকে চালিত করেছেন। জোনাথন উগান্ডার এনটেবেতে ১৯৭৬ সালে জিম্মি উদ্ধার অভিযানে নিহত হন। নেতানিয়াহু তাঁর ভাইয়ের স্মরণে একটি সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট চালু করেন। এই ভাইও তাঁর ওপর বড় প্রভাব রেখেছেন।
‘বিবি: মাই স্টোরি’তে নেতানিয়াহু তাঁকে একজন অবিস্মরণীয় বীর হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘কোনো ইসরায়েলি সৈনিক এত প্রশংসা, এত শ্রদ্ধা পায়নি তার মতো।’ নেতানিয়াহু রাজনীতিক হিসেবে যত ওপরে উঠেছেন, নেতানিয়াহু ইয়োনিকে নিয়ে তাঁর নানাবিধ প্রকল্পও তত বেড়েছে।
অ্যানশেল ফেফার যদিও লেখেন, নেতানিয়াহু জোনাথনকে কিংবদন্তি চরিত্রে রূপান্তর করেন নিজের স্বার্থে। এ থেকে সর্বোচ্চ মুনাফা তুলে নিয়েছেন তিনি। ফেফার জানান, ইয়োনি নির্দেশ অমান্য করে উগান্ডার সৈনিকদের দিকে গুলি ছুড়েছিলেন। তার পরিবার বলার চেষ্টা করেছে, উগান্ডার ছিনতাইকারীদের নেতা এক জার্মান অধিনায়কের গুলিতে ইয়োনি নিহত হন। আফ্রিকার একজন ‘নিম্নশ্রেণি’র ছিনতাইকারীর গুলিতে ইয়োনির মৃত্যু তাঁদের চোখে ছিল কম মর্যাদার।
নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক জীবন
সে যাক, লেখাপড়া শেষে নেতানিয়াহু কিছুদিন বেসরকারি খাতে চাকরি করেছেন। তিনি ইসরায়েলের বৃহত্তম আসবাব প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। টাকার জন্য চাকরিটা করেছিলেন বটে, তবে বিক্রির এই কৌশল তিনি আর জীবনেও ভোলেননি। বাগাড়ম্বর আর ধোঁকা দেওয়ার সব উপায়ই তিনি শিখে নিয়েছিলেন সে সময়।
১৯৮২ সালে তিনি ওয়াশিংটনে ফিরে যান ইসরায়েলের উপরাষ্ট্রদূত হিসেবে। চোস্ত মার্কিন উচ্চারণে ইংরেজি বলা নেতানিয়াহু অল্পদিনের মধ্যে মার্কিন টেলিভিশনের পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। উগ্রবাদিতা ছিল তাঁর ট্রেডমার্ক। শুরু থেকেই মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছেন তিনি। যেমন বুক ফুলিয়ে বলেছেন, ইহুদিরা আরবদের জমি দখল করেনি, বরং আরবরাই ইহুদিদের জমি দখল করেছে। ইহুদিরাই এ অঞ্চলের প্রকৃত বাসিন্দা। আরবরা উপনিবেশ করেছে।
জাতিসংঘে তাঁর কাজ ছিল ডানপন্থী নেতা ও প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক শামিরের পক্ষে সপাটে কথা বলে যাওয়া। তিনি নিয়মিত নাইটলাইন ও ইউএস নিউজে হাজির হতেন। সেখানেও আলোকচিত্রীদের বলা ছিল এমনভাবে ক্যামেরা ধরতে হবে, যেন তাঁর ঠোঁটের ওপরের কাটা দাগ দেখা না যায়। উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় তিনি জেরুজালেম থেকে একটা আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। হঠাৎ সাইরেন বেজে উঠলে তিনি মুখে মাস্ক পরে আলোচনা চালিয়ে যান।
১৯৮৮ সালে নেতানিয়াহু দেশে ফিরে আসেন। ইসরায়েলের পার্লামেন্ট কেনেসেটে তিনি লিকুদের সদস্য হিসেবে আসন পান এবং উপপররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ইসরায়েলের পক্ষে মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করেন।
১৯৯২ সালে লেবার পার্টি লিকুদের রাজনৈতিক প্রভাবকে চূর্ণ করে দেয়। আইজ্যাক রাবিন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু করেন। পরের বছর নেতানিয়াহু তাঁর একদা ‘বস’ শামিরকে সরিয়ে লিকুদের চেয়ারম্যান হন। শান্তি আলোচনা ও পরবর্তীকালে অসলো শান্তি চুক্তি নিয়ে সুযোগ পেলেই তিনি একহাত নিতে শুরু করেন। তিনি ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে শান্তি আলোচনার ঘোর বিরোধী ছিলেন।
১৯৯৫ সালের অক্টোবরে জেরুজালেমের এক প্রতিবাদ সমাবেশে তিনি তাঁর কুখ্যাত ‘বেলকনি স্পিচ’ দেন। সমাবেশে রাবিনকে নাৎসি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। নেতানিয়াহু পরে দাবি করেন, ওই সমাবেশে উত্তেজক এমন কিছু বলা হয়নি। যদিও লিকুদের যে রাজনীতিকেরা সে সময় সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা ঠিকই বুঝতে পারছিলেন কী ঘটতে চলেছে। এক মাস পর উগ্রবাদী ইহুদি তেল আবিবে একটি শান্তি সমাবেশের শেষে রাবিনকে হত্যা করে।
পরের বছর নির্বাচনে নেতানিয়াহু জয়লাভ করেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী দপ্তরের ভাষ্য, নেতানিয়াহু হেবরন ও ওয়াই শান্তি চুক্তি করেন ফিলিস্তিনের সঙ্গে। তিনি বৈদেশিক মুদ্রা নীতিমালাকে শিথিল করেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারি খাতে স্থানান্তর করেন এবং বাজেটঘাটতি কমিয়ে আনেন। তাঁর সময় বৈদেশিক বিনিয়োগ শীর্ষে পৌঁছায়।
নির্ধারিত সময়ের ১৭ মাস আগে ডাকা নির্বাচনে ১৯৯৯ সালে নেতানিয়াহু লেবার পার্টির ইহুদ বারাকের কাছে পরাজিত হন। তিনি লিকুদ থেকেও সরে দাঁড়ান এ সময়। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন অ্যারিয়েল শ্যারন। ২০০১ সালে শ্যারন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে আবারও সরকারে ফেরেন নেতানিয়াহু। এবার তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। অধিকৃত গাজা উপত্যকা থেকে ইহুদি বসতি প্রত্যাহারের প্রতিবাদে ২০০৫ সালে তিনি পদত্যাগ করেন।
তবে নেতানিয়াহুকে খুব বেশি দিন ক্ষমতার বাইরে থাকতে হয়নি। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে শ্যারন কোমায় চলে যাওয়ার আগে লিকুদ পার্টি ছেড়ে শ্যারন কাদিমা নামের মধ্যপন্থী একটি দল গঠন করেছিলেন। ফলে নেতানিয়াহু আবারও লিকুদের নেতৃত্বে আসেন এবং ২০০৯ সালের মার্চে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। এ দফায় তিনি প্রায় ১০ মাস অধিকৃত পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন বন্ধ রেখেছিলেন। প্রকাশ্যে সে সময় স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কথাও বলেছিলেন। তবে এ সবই ছিল মুখের কথা।
তিনি কখনো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে ছিলেন না। ২০১৯ সালে তিনি ইসরায়েল রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কখনই হবে না। মানুষ যেমনটি বলছে, তেমনটি তো নয়ই। এটা কখনই হবে না।’
এক যুগের মধ্যে ২০২১ সালে চতুর্থবারের মতো ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে আবারও সংঘাত দেখা দেয়। এর আগে তাঁর পতনের জন্য বিরোধীপক্ষগুলো এককাট্টা হয়েছিল। কিন্তু অমীমাংসিত একাধিক নির্বাচনের পর তাঁরা নেতানিয়াহুর বিরোধিতার পথ থেকে সরে আসেন। তাঁর পেছনেই এসে দাঁড়ান।
২০২২ সালের নভেম্বরে পঞ্চমবারের মতো নির্বাচিত হয়ে নেতানিয়াহু ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে কট্টর সরকার গঠন করেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে সবার হয়ে উঠবেন। কিন্তু সরকার গঠন করেই তিনি বিচার বিভাগ সংস্কারের প্রস্তাব আনলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে লাগাতার প্রতিবাদ সভা চলছে। ৭৫ বছর আগে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর কখনো এত বড় প্রতিবাদ সভা দেখেনি দেশটির লোকজন।
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় সংকটের মুখোমুখি এখন। দেশটির বিচার বিভাগ যেভাবে চলছিল, তিনি আর সেভাবে চলতে দিতে চান না।
নেতানিয়াহু ইসরায়েলের কট্টরপন্থীদের কাছে এখনো জনপ্রিয় নেতানিয়াহু ধর্মনিরপেক্ষ ও আশকেনাজি (ইউরোপ থেকে আসা ইহুদি)। তাঁর ওঠাবসা জেরুজালেমের উদারবাদীদের সঙ্গে। আর তাঁর ভোটাররা এই উদারবাদীদের বিরুদ্ধ পক্ষ। নেতানিয়াহুর বিদ্যাবুদ্ধি আছে, তিনি অত্যন্ত প্রতিহিংসাপরায়ণ। বাগাড়ম্বর করতে ভালোবাসেন।
তবু তাঁর বন্ধু বেনি যিফার বলেন, ‘আমি বিবিকে দেখি, আর ভাবি, আমাদের প্রতিদিন ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। কারণ, বিবি আমাদের কাছে ঈশ্বরের পক্ষ থেকে আসা উপহার।’
বিচার বিভাগ সংস্কারের উদ্যোগের চেষ্টায় নেতানিয়াহুর অনেক অর্জন মলিন হয়ে গেছে বলে অনেকেরই মত। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সাফল্য ও আন্তর্জাতিক অবস্থান। জোট সরকারে তাঁর অংশীদারেরা নিয়মিত তাঁকে কথা শোনান। তিনি নিজেও মামলার চক্করে পড়েছেন। হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প আমলের মতো যাতায়াত নেই। এই দুঃখে তিনি অস্থির। (নভেম্বরে নির্বাচনে জয়লাভের পরের বছর ২০ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রথমবারের মতো নেতানিয়াহুকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানান। তা–ও সে সময় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলছিল)।
সমর্থকেরা বলতে চান, তারপরও নেতানিয়াহু নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন, এ কথা বলা যাবে না। ইসরায়েল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউট এক জরিপে দেখেছে, নেতানিয়াহুর কট্টর সমর্থকদের কাছে এখনো নেতানিয়াহুর আকর্ষণ কমেনি। দেশের বড় অংশে, বিশেষ করে অধিকৃত পশ্চিম তীরের ইহুদি বসতি থেকে শুরু করে ইসরায়েলের পশ্চাৎপদ কট্টরপন্থীদের কাছে তিনি এখনো ‘কিং বিবি’।
কর্তৃত্ববাদীরাই বন্ধু, বিরক্ত অন্যরা
নেতানিয়াহু শুধু নিজেকে মধ্যপ্রাচ্যের উইনস্টন চার্চিল মনে করেন না। তিনি মনে করেন, তিনি মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের প্রতিনিধি। এই যুদ্ধ শুরুর পর তাঁকে আমরা বলতে শুনি, ‘আমরা হলাম আলোর সন্তান, আর ওরা অন্ধকারের।’ এটা যে তিনি শুধু মুখে বলেন, তা–ই নয়। এটা তাঁর বিশ্বাস। সে কারণে তিনি গাজার সঙ্গে অন্তহীন সংঘাত চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে পশ্চিমাদের স্বঘোষিত প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দিলেও পশ্চিমা নেতাদের অনেকেই তাঁকে পছন্দ করেন না। কর্তৃত্ববাদীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক মধুর।
যেমন ২০১৯ সালে নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহৃত একটা পোস্টারে তাঁকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে করমর্দন করতে দেখা যায়। পোস্টারের ক্যাপশন—‘নেতানিয়াহু: যে কারণে তিনি স্বতন্ত্র’।
অনেকের মতে, নেতানিয়াহুর প্রধান দুই সাফল্যের একটি হলো ইসরায়েলকে স্টার্টআপে সর্বোচ্চ বিনিয়োগের দেশে পরিণত করা এবং অপরটি হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরক্কোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন। ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘাতের তিনি ‘দিক পরিবর্তন’ করেছেন বলে লিকুদের এক সংসদ সদস্য দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনকে বলেছেন। কারণ, তিনি সুকৌশলে ফিলিস্তিন ইস্যুকে এড়িয়ে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ করতে পেরেছেন।
কিন্তু ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ নামে পরিচিত এই চুক্তি আসলে অস্ত্র চুক্তি। চুক্তিতে স্বাক্ষর করে পেগাসাসের মতো নজরদারির প্রযুক্তি হাতে পেয়েছে এই দেশগুলো। নেতানিয়াহু প্রযুক্তিকে পুঁজি করে স্বৈরাচারদের ঘনিষ্ঠ হয়েছেন। তবে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন সহজ হবে না। এ জন্য ফিলিস্তিনকে ছাড় দিতে হবে। আবার নেতানিয়াহুর কট্টর সহযোগীরা এই ছাড়ে রাজি নন।
প্রতিটি সংঘাতেই নেতানিয়াহুর ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেয়েছে। কিন্তু এক ট্রাম্প বাদে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টই ঠিক তাঁর বন্ধু নয়। অ্যারন ডেভিড মিলারের ‘দ্য মাচ টু প্রমিজড ল্যান্ড’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিন লিখেছে, ১৯৯৬ সালে নেতানিয়াহুর সঙ্গে প্রথম বৈঠকের পরই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন বিল ক্লিনটন। তিনি তাঁর সহযোগীদের বলেছিলেন, ‘সে নিজেকে কী মনে করে? কে সুপারপাওয়ার?’
আবার ধরুন, ২০১১ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে বলেন, ‘আমি নেতানিয়াহুকে সহ্য করতে পারি না। একটা মিথ্যুক।’ জবাবে ওবামা বলেন, ‘আপনি ওকে নিয়ে বিরক্ত। কিন্তু আমাকে তো এই লোককে নিয়ে কারবার করতে হয় অনেক বেশি।’ দুজনেই মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে এই উক্তি করেন।
নেতানিয়াহুর সঙ্গে বারাক ওবামার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত খারাপ। ২০১৫ সালে নেতানিয়াহু কংগ্রেসে এক বক্তৃতায় পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ইরানের সঙ্গে চুক্তি করায় যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেন। এতে ওবামা প্রশাসন অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়। প্রশাসন নেতানিয়াহুর এ সফরকে ক্ষতিকর বলে উল্লেখ করে। আরও বলে, নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলিয়েছেন।
পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন নিয়েও ওবামার প্রতিক্রিয়া ছিল কঠোর। নেতানিয়াহু নিজেই তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ওভাল অফিসে তিনি ওবামার সঙ্গে দেখা করতে যান। সৌজন্যমূলক কোনো কথাবার্তা ছাড়াই ওবামা তাঁর ওপর চড়াও হন। ওবামাকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘বিবি! আমি যা বলেছি তা–ই। এই মুহূর্তে ১৯৬৭ সালের সীমারেখার বাইরে যে নির্মাণকাজ চলছে, তা বন্ধ করতে হবে। একটা ইটও বসানো যাবে না।’ নেতানিয়াহু অগত্যা বলেন, তাঁরা শর্তহীনভাবে ফিলিস্তিনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত আছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মার্কিন সরকার ও ইসরায়েল সরকারের নীতির মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তৈরি হয়। এক বছরের মধ্যে ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
গোটা আরব বিশ্বে এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। জেরুজালেমের পূর্বাংশের অর্ধেক অংশ ১৯৬৭ সালে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের পর ইসরায়েল দখল করে নিয়েছে, ফিলিস্তিনের এ দাবির প্রতি আরব বিশ্বের সমর্থন আছে। ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত নেতানিয়াহুর জন্য এক বিরাট কূটনৈতিক অভ্যুত্থান।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে ট্রাম্প ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি আলোচনার নতুন নীলনকশা উপস্থাপন করেন। নেতানিয়াহুর সেই প্রস্তাব খুবই পছন্দ হয়। তিনি বলেন, এই শতকের সবচেয়ে ভালো সুযোগ এসেছে।
যদিও আদতে ফিলিস্তিনিরা এ প্রস্তাবকে একপক্ষীয় বলে অভিযোগ করে। ওই পরিকল্পনাও যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল, সেভাবেই পড়ে থাকে। ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে অর্থনৈতিক অবরোধ দেন। যদিও ট্রাম্প ইসরায়েলি এই নেতাকে অবিশ্বস্ত বলে আখ্যা দেন পরে। কারণ, ২০২০ সালের নভেম্বরে বাইডেন জিতে আসায় নেতানিয়াহু তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
এখন কী
২০১৬ সালের পর নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়েছে। পরে তাঁর বিরুদ্ধে ঘুষ দেওয়া, চালিয়াতি করা ও বিশ্বাসভঙ্গের মতো তিনটি পৃথক মামলা হয় ২০১৯ সালে। ২০২০ সালের মে মাসে তাঁর বিচার শুরু হয়। তিনিই প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যাঁর বিরুদ্ধে বিচার শুরু হলো।
ধনী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সোনাদানা, শ্যাম্পেইনসহ বেশুমার উপঢৌকন নেওয়া, সংবাদপত্রে কাভারেজ পাওয়ার জন্য কাউকে কাউকে আনুকূল্য দেখানোর দৃষ্টান্তও বিস্তর। এসব অপরাধে তাঁর অন্যতম সহযোগী তৃতীয় স্ত্রী সারা নেতানিয়াহু। (প্রথম স্ত্রীর গর্ভকালীন তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। তৃতীয় স্ত্রী সারা নেতানিয়াহুকে লুকিয়ে জড়িয়েছিলেন আরেকটি সম্পর্কে। এর পর থেকে নেতানিয়াহুকে প্রতিটি পদক্ষেপে সারা নেতানিয়াহুর অনুমতি নিয়ে চলতে হয় বলে একাধিক সূত্র লেখকদের নিশ্চিত করেছেন)।
অবশ্য দুর্নীতির এসব অভিযোগ নেতানিয়াহু ও তাঁর স্ত্রী সারা নেতানিয়াহু অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, খুঁজে খুঁজে তাঁর দোষ ধরা হচ্ছে। এগুলো বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র।
সারা নেতানিয়াহু তো খুবই রুষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কী! আমরা তো চাইলেই ইসরায়েল ছেড়ে চলে যেতে পারি। কিন্তু বিবি তো ইসরায়েল রাষ্ট্রের চেয়ে বড়। সে ছাড়া ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ কী? তোমরা খুন হবে, পুড়ে মরবে। ইসরায়েল পুড়বে।’
অনেকেরই ধারণা, নেতানিয়াহুর পতন আসন্ন। কিন্তু ফিলিস্তিনের প্রতি ইসরায়েলের যে মনোভাব, তাতে খুব একটা পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না।
ফিলিস্তিন ইস্যুতে একটি ‘নেতানিয়াহু মডেল’ তৈরি করেছেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এর মূল কথা হলো ফিলিস্তিনকে অনির্দিষ্টকালের জন্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
২০০৯ সালে বার ইলহান ইউনিভার্সিটিতে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘সামরিক’ শক্তিবিহীন একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হতে পারে। কিন্তু এর সঙ্গে তিনি যেসব শর্ত জুড়ে দেন, তা ফিলিস্তিনের কেন দুনিয়ার কোনো নেতার পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। রাষ্ট্রটি শুধু অসামরিক হলেই চলবে না, তার আকাশসীমা ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর অধীন থাকবে, গোটা জেরুজালেম ইসরায়েলকে দিয়ে দিতে হবে। মোদ্দাকথা, শান্তি প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা জিইয়ে রেখে দখলদারি টিকিয়ে রাখা নেতানিয়াহু মডেলের মূল কথা। ইসরায়েলের সিংহভাগ মানুষ এই মডেলের পক্ষে।
তথ্যসূত্র: দ্য নিইউয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিন, গার্ডিয়ান, বিবিসি, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ওয়েবসাইট
শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক। ই-মেইল: sabiha.alam@prothomalo. com