গত ২০ শ্রাবণ ১৪৩১, ৫ আগস্ট ২০২৪–এ বাংলাদেশে তরুণ ও কিশোর ছাত্রছাত্রীরা এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলল। আষাঢ়-শ্রাবণে এমন রাজনৈতিক প্লাবন বাংলাদেশে আর কখনো হয়নি। এ যেন জাতীয় কবি নজরুলের টগবগে খুনের তরুণদের উষার দুয়ারে আঘাত হেনে রাঙা প্রভাত আনার ছন্দময় এক বিপ্লব।
এতে সয়লাব হয়ে গেল একচ্ছত্র ক্ষমতার লালকুঠি গণভবন। ভেসে গেল শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের মসনদ। এল এক নতুন সকাল। জাতি ইতিমধ্যে এটার নাম দিয়েছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা। কী এক অদ্ভুত সমান্তরাল রেখায় তিনটা দেশ এবার মিলিত হলো। ব্রিটিশরাজ ভেঙে কালের পরিক্রমায় তিনটা দেশ হয়েছিল—ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ।
ঢাকার এক দেয়ালে শোভা পাচ্ছে এ গণ-অভ্যুত্থানের মূল আপ্ত বাক্য, ‘চাকরি খুঁজতে গিয়ে আস্ত এক স্বাধীনতা খুঁজে পেলাম।’ এখন দেশে চলছে সেই স্বাধীনতার রূপকল্পের প্রাথমিক সরকারব্যবস্থা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সরকারের আপাতত মূলত তিনটা কাজ—এক. দেশের প্রশাসনব্যবস্থা চালু রাখা। দুই. ১৫ বছরের আবর্জনা সরিয়ে প্রশাসনব্যবস্থাকে যতটুকু সম্ভব ঢেলে সাজানো। এবং তিন. ভবিষ্যতে এ জাতির সরকারব্যবস্থা কেমন হবে, তার একটা মৌলিক কাঠামো দাঁড় করানো। এই গণ-অভ্যুত্থান ছিল সব ধরনের বৈষম্য, স্বৈরাচার ও অপশাসনের বিরুদ্ধে। তাই স্বভাবতই এর বিপরীত মেরুর যে শাসনব্যবস্থা প্রত্যাশিত, তা হলো জনগণের শাসন। এ গণ-অভ্যুত্থানের মহানায়ক ছাত্র-জনতার দাবিও সেটাই।
ভবিষ্যতের প্রত্যাশিত শাসন ও প্রশাসনব্যবস্থা নিয়ে অনেক কিছু আলোচিত হচ্ছে বা লেখা হচ্ছে। আমার এ লেখাও মূলত সেই আলোচনার পরিগণ্ডিতেই। তবে এই লেখাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিনটা কাজের মধ্যে তৃতীয় কাজ সম্পর্কে কিছু মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাব এখানে পেশ করব।
প্রসঙ্গ: সংবিধান
প্রথমেই আসবে নতুন বাংলাদেশের সংবিধান। এ দেশের বর্তমান সংবিধান নিয়ে বিস্তর সমালোচনা আছে। সংবিধানটা জাতীয় শাসনব্যবস্থার একমাত্র দিকনির্দেশক । কিন্তু একে যাচ্ছেতাইভাবে গত ৫০ বছরে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। যে শাসন করবে, সেই শাসিত হয়েছে। এর কারণ হলো, এই সংবিধানের অস্পষ্টতা ও পরস্পর সাংঘর্ষিক ধারা-উপধারা। কোনো বিস্তারিত বিশ্লেষণে না গিয়ে মোটাদাগে যা বলতে চাই, সেগুলো হলো—
এক. ভবিষ্যতের সংবিধানটা যেন আকারে ছোট হয়, যা একজন নাগরিক বুকপকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবে। আর পড়ামাত্রই বুঝতে পারবে। সাধু ভাষার মারপ্যাঁচে মূল কথাটা যেন দুর্বোধ্য না থেকে যায়, এমনভাবে তা লিখতে হবে।
দুই. নতুন সংবিধানে বিচার বিভাগকে প্রথমে এবং সম্পূর্ণ স্বাধীন রাখতে হবে। এরপর আইন প্রণয়ন ও নির্বাহী বিভাগগুলোকে রাখতে হবে। বিচার বিভাগের প্রাধান্যতা বাকি দুটি বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
তিন. সংবিধানে দ্বৈত নাগরিকত্ব বিধান থাকবে না। কেউ যদি ভিনদেশের নাগরিকত্ব নিতে ইচ্ছুক থাকে, তবে তাকে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করতে হবে। তাহলে এ দেশে–বিদেশি পাসপোর্টধারী ব্যক্তিদের রাজনীতি ব্যবসা বন্ধ হবে।
চার. সংবিধানে বিশেষ ক্ষমতা আইন থাকবে না।
পাঁচ. কোনো সরকার শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের ভোটার ভিত্তিতে সংবিধান পরিবর্তন করতে পারবে না। যেকোনো ধরনের পরিবর্তন কেবল গণভোটের মাধ্যমে হতে হবে। অথবা পূর্ববর্তী নির্বাচনে সুনির্দিষ্ট সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সংসদে ভোটাভুটির মাধ্যমে তা হতে পারবে। কোনো সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ইচ্ছেমতো সংবিধান সংশোধনের বিল আনতে পারবে না।
ছয়. সব আদালতের ওপরে একটা সাংবিধানিক আদালত থাকবে।
প্রসঙ্গ: সরকারব্যবস্থা ও নির্বাহী বিভাগ
এক. নতুন বাংলাদেশের ভবিষ্যতের সরকারব্যবস্থা হবে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র।
দুই. নির্বাহী বিভাগ রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর ক্যাবিনেট দ্বারা গঠিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী প্রচলিত সংসদীয় প্রথাতেই নিযুক্ত হবে, তবে রাষ্ট্রপতি জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন।
তিন. রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন চার থেকে ছয় বছরের জন্য। একই ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি পদে এক মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেন না।
চার. রাষ্ট্রপতি কোনো দলীয় প্রার্থী হবেন না।
পাঁচ. রাষ্ট্রপতির নিজস্ব নির্বাহী ক্ষমতা থাকবে এবং প্রধানমন্ত্রীর বা সংসদের সুপারিশকে অগ্রাহ্য করতে পারবেন।
প্রসঙ্গ: নির্বাচনব্যবস্থা
এক. সংসদীয় গণতন্ত্রের নির্বাচনব্যবস্থা হবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক। এ ব্যবস্থায় জনগণ কোনো প্রার্থীকে নয়; বরং কোনো একটা রাজনৈতিক দলকে ভোট দেবেন। জাতীয় পর্যায়ে মোট ভোটের প্রাপ্ত শতাংশ অনুযায়ী সংসদে দলীয় প্রতিনিধিত্ব থাকবে। দল তার পছন্দ অনুযায়ী প্রতিনিধি পাঠাবে।
দুই. কোনো দলের সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে হলে জাতীয় নির্বাচনে মোট ভোটের অন্তত ৭ শতাংশ ভোট পেতে হবে। কোনো দল জাতীয় নির্বাচনে পরপর তিনবার কমপক্ষে ৭ শতাংশ ভোট পেতে ব্যর্থ হলে সে দলের রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়ে যাবে। এমন একটা ব্যবস্থায় শুধু এক নেতাভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কিচিরমিচির বন্ধ হবে।
তিন. নির্বাচনের পর কোনো মনোনীত প্রতিনিধি সংসদীয় শপথ নেওয়ার পর দল পাল্টাতে পারবে না। দল পাল্টালে তার প্রতিনিধিত্ব থাকবে না।
চার. কোনো শপথবদ্ধ প্রতিনিধি একটানা ৩০ দিনের বেশি সংসদে অনুপস্থিত থাকতে পারবেন না। অনুপস্থিতির ভিত্তিতে দৈনিক ভাতা ও মাসিক সম্মানী কাটা যাবে।
পাঁচ. কোনো সংসদ সদস্য বিনা শুল্কের সরকারি গাড়ি সুবিধা পাবেন না।
ছয়. যেহেতু কোনো সদস্য কোনো বিশেষ নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধিত্ব করবেন না, তাই স্থানীয় পর্যায়ের কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে থাকতে পারবে না।
সাত. জাতীয় নির্বাচনে প্রত্যাশিত সম্ভাব্য প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ অনুসারে কোনো দল ততজন নেতা বা দলীয় প্রার্থীর সম্পদের বিবরণ, জীবনবৃত্তান্ত ও সরকারি কর পরিশোধের খতিয়ান নির্বাচনের অন্তত ছয় মাস আগে নির্বাচন কমিশনে জমা করবে। যাতে নির্বাচন কমিশন ওই সব ব্যক্তির প্রার্থিতা আগে থেকে যাচাই-বাছাই করতে পারে। ফৌজদারি বা অর্থ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত, সামান্য পরিমাণের হলেও কোনো ঋণখেলাপি বা সামাজিকভাবে পরিচিত দুশ্চরিত্র ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব গ্রহণ করা হবে না। কোনো দল এমন কোনো ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করলে ওই দলকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হবে।
আট. ভোট গ্রহণ কোনো দালান ঘরের ভেতরে হবে না, পোলিং বুথ খোলা আকাশের নিচে শামিয়ানার নিচে হতে হবে। এতে সব রকম কারচুপি রোধ করা যাবে।
প্রসঙ্গ: রাজনৈতিক দল
এক. বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা থাকবে।
দুই. প্রতিটি দলের বার্ষিক কনভেনশন ও দলীয় নির্বাচনের খতিয়ান নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হবে। কোনো ব্যতিক্রম হলে দলের রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়ে যাবে।
তিন. কোনো রাজনৈতিক দলের পিতৃপ্রতিম, মাতৃপ্রতিম, ভাতৃপ্রতিম বা ভগ্নিপ্রতিম–জাতীয় কোনো শাখা-উপশাখা সংগঠন থাকতে পারবে না।
চার. কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো বৈদেশিক শাখা থাকতে পারবে না।
পাঁচ. কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো ছাত্রসংগঠন থাকতে পারবে না।
ছয়. কোনো রাজনৈতিক দলের মনোনীত কোনো ব্যক্তি যদি প্রধানমন্ত্রিত্ব হারান বা নির্বাচনে প্রতিশ্রুত ফলাফল অর্জন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ওই ব্যক্তি তাঁর দলের নেতৃত্বে থাকতে পারবেন না।
সাত. জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচনী ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে থাকতে হবে।
আমাদের জাতীয় ইতিহাসের ৫০ বছরে রাজনীতির সাপ-লুডুর খেলা চলে আসছে, যার বিষাক্ত পরিণতি আমরা বারবার দেখেছি। স্বাধীনতার চ্যাম্পিয়ন একনায়ক হয়েছে, বহুদলীয় গণতন্ত্রের সংসদীয় পদ্ধতির সংবিধান বারবার বলাৎকারের শিকার হয়েছে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বেচ্ছাচারিতা ও পরিবারতন্ত্র রাজনৈতিক দল ও সরকারব্যবস্থাকে এবং সর্বোপরি সমগ্র জাতিকে জিম্মি করে রেখেছে। দ্বিতীয় স্বাধীনতার বৈষম্যবিরোধী স্লোগান এসব অনিয়ম ও কলুষতাপূর্ণ সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ। অনেক রকম সংস্কারের মধ্যে এখানে প্রস্তাবিত সংবিধান, বিচার, নির্বাহী, আইন প্রণয়ন, নির্বাচনব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক দল সম্পর্কিত সংস্কারগুলো মাধ্যমে ভবিষ্যতে একটা সুন্দরতম ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। এ সংস্কারগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে একটা সর্বজনীন জবাবদিহিমূলক জাতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে।
মু. মনিরুজ্জামান সহযোগী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব শারজা, সংযুক্ত আরব আমিরাত
ই–মেইল: [email protected]