বিশ্লেষণ
ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতির কী প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশে
ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতি এখন নিশ্চিতভাবেই সংরক্ষণমূলক হয়ে উঠবে। বাংলাদেশকেও কেন ট্রাম্পের নীতির সঙ্গে সমন্বয় করার বিষয়টি ভাবতে হবে, তা নিয়ে লিখেছেন আসজাদুল কিবরিয়া
১১ বছর আগের কথা; ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা) স্বাক্ষর করে। এর পাঁচ মাস আগে ২৮ জুন বাংলাদেশকে দেওয়া জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স (জিএসপি) সুবিধা স্থগিত ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্রের ওবামা সরকার। দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে অল্প সময়ের ব্যবধানে এ দুটি ঘটনা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
জিএসপি–সুবিধা স্থগিতকরণ টিকফা স্বাক্ষরকে ত্বরান্বিত করেছিল বলে ধরা যায়, যদিও তার আগে প্রায় এক দশক ধরে এ রকম একটি চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলেছে। প্রথমে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ রূপরেখা চুক্তি (টিফা) করার উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০২ সালে, শেষতক তা টিকফায় রূপ নেয়।
তবে জিএসপি স্থগিতকরণ ও টিকফা স্বাক্ষরের এক দশকের বেশি সময় পর এসে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক একটি নতুন মাত্রায় উপনীত হয়েছে। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতি যখন নিশ্চিতভাবেই সংরক্ষণমূলক হয়ে উঠবে, তখন বাংলাদেশকেও ট্রাম্পের নীতির সঙ্গে সমন্বয় করার বিষয়টি ভাবতে হবে।
উচ্চ শুল্কের পথে যুক্তরাষ্ট্র
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারকালে ট্রাম্প স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে তিনি নির্বাচিত হলে চীনা পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ হারে শুল্কারোপ করবেন। অন্য দেশগুলো থেকে পণ্য আমদানির ওপরও ১০ থেকে ২০ শতাংশ হারে শুল্কারোপ করা হবে বলে ঘোষণা দেন। এ ছাড়া মেক্সিকোর সরকার যদি সীমান্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে অভিবাসী প্রবেশের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা না করে, তাহলে মেক্সিকোর ওপরও ২৫ শতাংশ হারে শুল্কারোপ করতে দ্বিধা করবেন না ট্রাম্প।
নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ট্রাম্প এখন বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োগের জন্য তাঁর পছন্দের লোকজন বাছাই করছেন। পাশাপাশি আগামী বছরের ২০ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই শুল্কারোপের কাজ শুরু হয়ে যাবে তা নিশ্চিত। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্প আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের যে বিশেষ ক্ষমতা আছে, সেই নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন যেন দ্রুত শুল্কারোপ করা যায়।
মজার বিষয় হলো, ২০১৭-২০২০ মেয়াদে ট্রাম্প সেসব উচ্চ শুল্কারোপ করেছিলেন, ২০২১-২০২৪ মেয়াদে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তা প্রায় পুরোটাই বহাল রেখেছেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ট্যাক্স ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুসারে, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ট্রাম্প প্রশাসন হাজারখানেক পণ্যের ওপর ৩৮ হাজার কোটি ডলারের আমদানি শুল্কারোপ করেছিল। এর ফলে দেশটির নাগরিকদের ওপর আট হাজার কোটি ডলারের বাড়তি করের বোঝা চাপে।
ট্রাম্প নিজেকে ‘ট্যারিফ ম্যান’ বলে অভিহিত করেছেন প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার সময়ই। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে নিম্ন হারের বা শূন্য হারের আমদানি শুল্কের কারণে তিন দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়েছেন, লাখ লাখ শ্রমজীবীর মজুরি তেমন বাড়েনি বরং সমাজে বড় ধরনের আয়ের বৈষম্য তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলো তাদের রপ্তানি বাড়ানোর দিকে যতটা মনোযোগী হয়েছে, নিজ দেশের জনগণের জীবনমান বাড়ানোয় ততটা নজর দেয়নি। এসব দেশের শিল্পনীতিও সেভাবে প্রণীত ও বাস্তবায়িত হয়েছে। এতে ক্রমাগত বড় ধরনের বাণিজ্য–ঘাটতি মোকাবিলা করে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ট্রাম্পের সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) রবার্ট লাইটথাইজার এবারের নির্বাচনের কয়েক দিন আগে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের (২ নভেম্বর ২০২৪) এক নিবন্ধে এ বিষয়গুলো তুলে ধরেন।
এতে তিনি আরও বলেন যে এ ধরনের অন্যায্য শিল্পনীতির ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য আমদানি শুল্ক বাড়ানোই হলো উত্তম পথ, যা ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে করেছেন। এর সুফলও সে সময় মিলেছিল দাবি করে লাইটথাইজার বলেন যে শিল্পোৎপাদন বেড়েছিল, আমদানি কমে এসেছিল আর শ্রমিকেরা সর্বোচ্চ হারে মজুরি পেতে শুরু করেছিলেন। উচ্চ বাণিজ্য উদ্বৃত্ত সুবিধা ভোগকারী বাণিজ্য অংশীদারদের উদ্দেশে তিনি ট্রাম্পের পক্ষ থেকে আরও বলেন যে ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র তাঁর বাণিজ্যনীতি পরিবর্তন করছে, এমনটি অভিযোগ করার অবকাশ নেই। বরং যুক্তরাষ্ট্রের যে ক্ষতি হয়েছে, সেটা কাটানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হতে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
যুক্তরাষ্ট্র এখন বিশ্বের একক বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ। বৈশ্বিক পণ্য ও সেবার ১৮ শতাংশ আমদানি করে দেশটি। বিপরীতে রপ্তানি করে ১৪ শতাংশ। দেশটি বাংলাদেশসহ অনেক দেশের প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার তো বটেই, এমনকি প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) প্রধান জোগানদার। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এই রাষ্ট্রের সামরিক, অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক সক্ষমতার ধারেকাছে এখনো কেউ নেই, চীন ব্যতীত। তবে চীনকে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে সমানে সমান হতে।
প্রায় দুই বছর আগে (ডিসেম্বর, ২০২২) বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) যুক্তরাষ্ট্রের ১৫তম বাণিজ্যনীতি পর্যালোচনা বৈঠক সম্পন্ন হয়, যেখানে দেশটির সঙ্গে সারা বিশ্বের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের গুরুত্বের মাত্রা প্রতিফলিত হয়। যেমন এই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র ডব্লিউটিওর অন্যান্য সদস্যদেশের কাছ থেকে দুই হাজারের বেশি লিখিত প্রশ্ন পেয়েছিল।
মোটাদাগে বললে, যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত কোনো দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ককে এগিয়ে নেয় বা পরিবর্তন করে তার বৈশ্বিক বাণিজ্যনীতির ছায়ায়। আর তাই দেশটির ঘোষিত বাণিজ্যনীতি বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলোর জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা ও আভাস দিতে পারে। আর যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতি স্বচ্ছ ও উন্মুক্ত। সে কারণেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করার তাগিদে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতি নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করা এবং সেই অনুসারে নিজস্ব বাণিজ্যনীতি সমন্বয় করা।
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্য ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। গত এক দশকে বাংলাদেশ প্রতিবছর দেশটি থেকে গড়ে প্রায় ২৭ কোটি ডলারের প্রকৃত প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। ২০২৩ সাল শেষে দেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩৯৩ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। এ ছাড়া বাংলাদেশের বেসরকারি বৈদেশিক বাণিজ্য ঋণের অন্যতম প্রধান উৎসও এখন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০২৩ সাল শেষে যুক্তরাষ্ট্র থেকে নেওয়া দীর্ঘমেয়াদি বেসরকারি ঋণের স্থিতি ছিল প্রায় ৭৩ কোটি ৫২ লাখ ডলার, যা এই সময়ের বেসরকারি ঋণের মোট স্থিতির প্রায় ১০ শতাংশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ের ১১ শতাংশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে।
জিএসপি বাতিল
জিএসপি–সুবিধা স্থগিতের বিষয়টি পরিষ্কারভাবেই বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকার ও শিল্পকারখানার বিশেষত তৈরি পোশাক খাতের কর্মপরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ভবন ধসে ১ হাজার ১০০–এর বেশি পোশাকশ্রমিক প্রাণ হারান। পঙ্গু ও আহত হন আরও অনেক শ্রমিক। এ ঘটনা একুশ শতকে বিশ্বের অন্যতম বড় শিল্পকারখানা–সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
বিশ্বজুড়ে নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় ওঠে শ্রমিকদের অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ কারখানায় কাজ করানোর জন্য। এর জেরেই কারখানার কাজের পরিবেশ উন্নত করা এবং শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষার জন্য চাপ তৈরি করতে তৎকালীন ওবামা প্রশাসন এই বাণিজ্য–সুবিধা স্থগিত করে। তবে তার আগে ছয় বছর ধরে বাংলাদেশের কারখানা শ্রমিকদের অবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
যেহেতু বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি করা মোট পণ্যের ১ শতাংশের কম জিএসপি–সুবিধা পেত, সেহেতু এই সুবিধা স্থগিত করার নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব ছিল নগণ্য। তাই গত এক দশকে দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য প্রতিবছর গড়ে ১০ শতাংশের কিছু বেশি হারে বেড়েছে। আবার বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। এরপর হলো জার্মানির অবস্থান, যদিও সম্মিলিতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) বাজারই সবচেয়ে বড়।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৮৫০ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। জিএসপি স্থগিত হওয়ার পরের কয়েক বছরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একাধিকবার এই সুবিধা পুনরায় চালু করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেওয়া বিভিন্ন শর্ত প্রতিপালন করতেও দেখা যায়।
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ও টিকফা
অবশ্য জিএসপি ফিরে পাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (বিএফটিএ) সম্পাদন করার প্রস্তাব উঠেছিল বেশ কয়েক বছর আগেই। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ‘প্রথমে আমেরিকা’ বাণিজ্যনীতি গ্রহণ করেন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে বাণিজ্য–সুবিধা গ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হয়। সে সময় বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইএ) একটি পলিসি অ্যাডভোকেসি পেপারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিএফটিএ করার সুপারিশ করা হয়। তবে এ নিয়ে বাস্তবে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
বস্তুত যুক্তরাষ্ট্রের এফটিএ কাঠামো বেশ বিস্তৃত ও জটিল। পণ্য ও সেবা খাতের পাশাপাশি এতে একাধারে বিনিয়োগ, মেধাস্বত্ব অধিকার, শ্রম মান এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত।
বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিএফটিএ করার মানে হলো এমন একটি সর্বাত্মক চুক্তি করা, যেখানে অংশীদার দেশকে ক্রমাগতভাবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার সাধনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হয় এবং তা প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের বেঁধে দেওয়া শর্তে। সে কারণেই এখন পর্যন্ত মাত্র ২০টি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক বিএফটিএ স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর বাইরে জাপানের সঙ্গে শুধু গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদবিষয়ক একটি দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে।
অবশ্য বিএফটিও করার বিষয়টি কখনোই টিকফা কাউন্সিল সভার আলোচ্য সূচিতে আসেনি। এক দশকে এই ফোরামের সাতটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি শ্রমিক অধিকার ও শ্রম মান, বিনিয়োগের পরিবেশ ইত্যাদি স্থান পেয়েছে।
ঢাকায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত টিকফা কাউন্সিলের সপ্তম বৈঠকে বাংলাদেশের উপাত্ত সুরক্ষা আইনের মতো নতুন বিষয় উঠে এসেছে। এসব বৈঠক থেকে যেটা বোঝা যায় যে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমাগতভাবে বাণিজ্য–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের জন্য ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশকে চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে ও যাবে।
শ্রমিককেন্দ্রিক বাণিজ্যনীতি
এ বছরের প্রথম দিকে ইউএসটিআর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ২০২৪ সালের বাণিজ্যনীতির কার্যসূচি (ট্রেড পলিসি এজেন্ডা) প্রকাশ করে। এতে এটা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে দেশটি ‘শ্রমিককেন্দ্রিক বাণিজ্যনীতি কার্যসূচি’ বহাল রাখবে, যা সব বাণিজ্য অংশীদারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। পাশাপাশি জলবায়ু সংকট নিরসন ও পরিবেশের জন্য টেকসই পদক্ষেপগুলো জোরদার করতে বাণিজ্যকে অপরিহার্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি খাতকে সমর্থন দেওয়াও বাইডেন প্রশাসনের অন্যতম অগ্রাধিকার ছিল। আবার গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্যকে বাংলাদেশের বাজারে অবাধে প্রবেশ করতে দেওয়ার জন্য চাপ তৈরি করেছে দেশটি। পাশাপাশি ডিজিটাল বাণিজ্যবিষয়ক নীতি, ব্যবসা সহজীকরণ ও মেধাস্বত্ব অধিকার সুরক্ষা বিষয়েও চাপ এসেছে।
মনে রাখা দরকার যে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর বাণিজ্যনীতির আওতায় ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে এনেছিলেন। তবে বাংলাদেশকে জিএসপি–সুবিধা ফিরিয়ে দেননি কিংবা শুল্কমুক্ত বাজার–সুবিধা প্রদান করেননি। বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানির বিপরীতে প্রতিবছর গড়ে ১৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক আদায় করছে এক দশক ধরে। ডব্লিউটিওর সিদ্ধান্ত থাকার পরও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, নেপাল ও কম্বোডিয়া আজও যুক্তরাষ্ট্রে বাজার–সুবিধা পায়নি। আর ২০২৬ সাল শেষে বাংলাদেশ যেহেতু এলডিসির কাতার থেকে বেড়িয়ে আসবে, সেহেতু এই বাজার–সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে গেছে।
এখন বরং চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে যে ট্রাম্পের বর্ধিত শুল্কের ধাক্কা বাংলাদেশের ওপর কতটা এসে পড়বে। কারও কারও মতে, বাংলাদেশকে হয় দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির পথে হাঁটতে হবে, না হয় কেনিয়ার মতো স্ট্র্যাটেজিক ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারশিপ (এসটিআইপি) নিয়ে সমঝোতা করতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষে এর যেকোনো একটা বেছে নেওয়া খুব সহজসাধ্য নয়। তবে একক বৃহত্তম রপ্তানি বাজারে বাড়তি সুবিধা পেতে হলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার আওতায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছু মিলবে না, তা প্রায় নিশ্চিত।
আসজাদুল কিবরিয়া লেখক ও সাংবাদিক। ই–মেইল: [email protected]