ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জন করছে। অনেক শহর ও গ্রাম তারা মুক্ত করছে এবং রুশ বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করছে। ইউক্রেনীয় পাল্টা আক্রমণ কত দূর যাবে তা দেখার বিষয়, তবে এটি ইতিমধ্যেই স্পষ্ট যে রণক্ষেত্রের কৌশলগত ভারসাম্যে পরিবর্তন আসছে।
ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন শক্তি সংকট মোকাবিলায় পুরোপুরি সক্রিয় হয়েছে। আমরা ১ নভেম্বর টার্গেট তারিখ ধরে ইতিমধ্যে আমাদের গ্যাসের মজুতভান্ডার ৮০ শতাংশের বেশি পূরণ করেছি এবং শীতকালে গ্যাসের ব্যবহার কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে সম্মত হয়েছি। নাজুক অবস্থায় পড়া ভোক্তা এবং ব্যবসায়ীদের মূল্যবৃদ্ধিজনিত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বিষয়ে সহায়তা করতে আমরা অতিরিক্ত মুনাফা করেছে, এমন জ্বালানি কোম্পানিগুলোর ওপর উইন্ডফল ট্যাক্স আরোপের মতো প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।
তদুপরি জি-৭ এবং অন্য সমমনা অংশীদারদের সঙ্গে সমন্বয় সাপেক্ষে আমরা রাশিয়ান তেল রপ্তানির সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছি। আমরা গ্লোবাল সাউথ বা বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোতে আমাদের অংশীদারদের রাশিয়ার নৃশংস আগ্রাসন এবং শক্তি ও খাদ্যের নিষ্ঠুর অস্ত্রায়নের কুফল সামলাতে সাহায্য করছি।
সংক্ষেপে বলা যায়, রাশিয়ার বিরুদ্ধে সামগ্রিক কৌশল কাজ করছে। আমাদের অবশ্যই ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়া অব্যাহত রাখতে হবে, নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাশিয়াকে চাপ দিতে হবে এবং আমাদের বৈশ্বিক অংশীদারদের সংহতির চেতনায় সাহায্য করতে হবে।
যাঁরা নিষেধাজ্ঞাগুলো কাজ করছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তাঁরা ক্রমবর্ধমান নড়বড়ে ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছেন। সাধারণভাবে, নিষেধাজ্ঞা বা অবরোধগুলোর দ্বৈত কার্য রয়েছে: সংকেত দেওয়া এবং বাধ্য করা।
সংকেত একটি রাষ্ট্রের আচরণের বিরোধী মত প্রকাশ করে। যেমন আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন এবং বেসামরিক লোক ও বেসামরিক অবকাঠামোর ওপর বেপরোয়া আক্রমণের বিরুদ্ধে অবস্থান ঘোষণা হিসেবে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়ে থাকে।
অন্যদিকে, আমরা রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যেহেতু যুদ্ধে নেই, সেহেতু বাধ্যতামূলকভাবে তার আচরণে পরিবর্তন আনতে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
একটি খুব স্পষ্ট বার্তা দিয়ে ইইউ রাশিয়ান জ্বালানির ওপর তার নির্ভরতা শেষ করে দেওয়ার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ক্রেমলিন গ্যাস রপ্তানির পরিমাণ নাটকীয়ভাবে হ্রাস করার মাধ্যমে বিশ্ববাজারকে ধাক্কা দিয়ে তার চুক্তি ভঙ্গ করেছে।
জ্বালানি বন্ধ করে দিয়ে ব্ল্যাকমেল করার ক্ষমতাকে রাশিয়ার একটি শক্তি বলে মনে হতে পারে; কিন্তু এটি শেষ পর্যন্ত একটি হারানো কৌশল।
জনপ্রিয় বিশ্বাসের বিপরীতে দাঁড়ানো প্রকৃত বাস্তবতা হলো, রাশিয়া সহজে ইউরোপীয় বাজারের বিকল্প টেকসই বাজার খুঁজে পাবে না। এর কারণ হলো, দেশটির বেশির ভাগ গ্যাস-রপ্তানি অবকাঠামো (পাইপলাইন এবং এলএনজি টার্মিনাল) ইউরোপে রপ্তানির উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছে। সেই পাইপলাইনগুলো ঘুরিয়ে চীনের মতো দেশে গ্যাসের প্রবাহ চালু করতে প্রথমত কয়েক বছর সময় লাগবে, দ্বিতীয়ত এতে রাশিয়ার কয়েক শ কোটি ডলার খরচ হবে।
এটি সত্য, রাশিয়া সাম্প্রতিক গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি থেকে উপকৃত হয়েছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ব্যর্থ হয়েছে। আসলে রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি কমানোর বিষয়ে ইউরোপের নেওয়া সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ প্রভাব দেখতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। এখন পর্যন্ত ইউরোপ শুধু রাশিয়ান কয়লা আমদানি নিষিদ্ধ করেছে এবং রাশিয়ান তেলের ক্রয় কমিয়েছে। তবু তার প্রভাব লক্ষণীয় হয়ে উঠছে।
রাশিয়া সাম্প্রতিক গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি থেকে উপকৃত হয়েছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ব্যর্থ হয়েছে। আসলে রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি কমানোর বিষয়ে ইউরোপের নেওয়া সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ প্রভাব দেখতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। এখন পর্যন্ত ইউরোপ শুধু রাশিয়ান কয়লা আমদানি নিষিদ্ধ করেছে এবং রাশিয়ান তেলের ক্রয় কমিয়েছে। তবু তার প্রভাব লক্ষণীয় হয়ে উঠছে।
রাশিয়ার কয়লা রপ্তানির সাম্প্রতিক পরিমাণ তার ইউক্রেনে আক্রমণ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত সময়ে রপ্তানি হওয়া পরিমাণের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে। এটি ক্রেমলিনের অন্যান্য ক্রেতা খুঁজে পেতে ব্যর্থতার প্রতিফলন ঘটায়। একইভাবে, যেহেতু ইইউ ঘোষণা করেছে, তারা ২০২২ সালের শেষ নাগাদ রাশিয়ান তেলের আমদানি ৯০ শতাংশ কমিয়ে দেবে, সেহেতু তেলের দাম অনেক কমে গেছে। ক্রেমলিন যদি ইউরোপে তার গ্যাস সরবরাহ আরও কম করে, তবে তার রাজস্ব আরও কমে যাবে।
যেমন জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক বলেছেন, ইউরোপ অতীতে হয়তো রাশিয়ান গ্যাসের জন্য আরও অনেক কম মূল্য পরিশোধ করতে পারত, কিন্তু তারা তাদের নিরাপত্তার শর্তে অর্থ প্রদান করার কারণে মস্কোকে বেশি দাম দিতে হচ্ছিল। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেছিল কারণ তারা নিশ্চিত ছিল, ইইউ রাশিয়ার ওপর অতিরিক্ত জ্বালানিনির্ভর হওয়ায় ইইউ দেশগুলো রাশিয়ার ওপর অবরোধ আরোপে বিভক্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভুল হিসাব করেছেন।
রাশিয়ান জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে ইউরোপ সেই পুরোনো বিশ্বাস থেকে নিজেকে মুক্ত করছে, যেখানে মনে করা হতো অর্থনৈতিক পারস্পরিক নির্ভরতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক উত্তেজনা হ্রাস করে। ৪০ বছর আগে এই উপলব্ধি হয়তো সঠিক ছিল, কিন্তু এটি অবশ্যই এখন কার্যকর নয়। কারণ পারস্পরিক অর্থনৈতিক নির্ভরতা এখন অস্ত্র হয়ে উঠেছে। আবার অভ্যন্তরমুখী হয়ে নিজেদের গুটিয়ে রাখাও কাজের কাজ নয়। আমাদের অবশ্যই একটি উন্মুক্ত অর্থনীতি দরকার; কিন্তু আমরা স্থিতিস্থাপকতা এবং বৈচিত্র্য ব্যতীত পরস্পর নির্ভরতাকে গ্রাহ্য করতে পারি না। আমরা যাদের সঙ্গে বাণিজ্য করি এবং যোগাযোগ রাখি, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। অন্যথায়, পুতিন ২০ বছর ধরে যে ফাঁদ পেতে রেখেছেন, আমরা সেই একই ধরনের ফাঁদে পা দেব।
নিষেধাজ্ঞাগুলোও স্পষ্টতই রাশিয়ার ওপর একটি বাধ্যতামূলক প্রভাব ফেলেছে। পশ্চিমা প্রযুক্তির নাগাল হারানোটা রাশিয়ান সামরিক বাহিনীকে আঘাত করতে শুরু করেছে। কারণ, রাশিয়ার ট্যাংক, বিমান, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা এবং নির্ভুল অস্ত্রগুলোও পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আমদানি করা উপাদানগুলোর ওপর নির্ভর করে।
শুধু নিষেধাজ্ঞাই কি হানাদারকে পরাজিত করার জন্য যথেষ্ট হবে? না। সে কারণেই আমরা ইউক্রেনকে ব্যাপক অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করছি এবং ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করার জন্য একটি ইইউ সামরিক প্রশিক্ষণ মিশন মোতায়েন করার জন্য কাজ করছি। যুদ্ধ শেষ হয়নি এবং পুতিনের হাতে এখনো কিছু কার্ড রয়েছে। কিন্তু বর্তমান পশ্চিমা কৌশলের সামনে ক্রেমলিন শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। যতক্ষণ আমরা আমাদের কৌশলের সঙ্গে লেগে থাকি ততক্ষণ সময় এবং ইতিহাস ইউক্রেনীয়দের পক্ষে থাকছে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
জোসেপ বোরেল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড সিকিউরিটি পলিসির একজন হাই রিপ্রেজেন্টিটিভ। একই সঙ্গে তিনি ইউরোপিয়ান কমিশন ফর এ স্ট্রংগার ইউরোপ ইন দ্য ওয়ার্ল্ড-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট।