অক্টোবরের শুরুতেই নির্বাচন। পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত ব্রাজিল। মনে হচ্ছে, অতি ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর পক্ষে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মধ্যবামপন্থী লুলা ডি সিলভাকে পরাজিত করা কঠিন হতে পারে। কারণ, দুইবারের ভাইস প্রেসিডেন্টের সমর্থন ধারাবাহিকভাবে ৪৫ থেকে ৪৭ শতাংশের মধ্যে। লুলার ১০-দলীয় জোট থেকে ১২ পয়েন্ট পেছনে আছেন বলসোনারো। নির্বাচনী জরিপগুলো ইঙ্গিত করছে, ৩০ অক্টোবর দ্বিতীয় দফা নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
হেরে গেলে বলসোনারোর সামনে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চালাকিপূর্ণ কৌশল তো আছেই। সেটি হচ্ছে, আপনি যদি নির্বাচনে হেরে যান, সংবাদমাধ্যম, ভোট, ভোটযন্ত্রকে দায়ী করুন। আর যদি কোনো সশস্ত্র বাহিনী বা আধা সামরিক বাহিনী দ্বারা অভ্যুত্থান করতে পারেন, তাহলে তো আরও ভালো। বলা বাহুল্য, ১৮৮৯ সালে প্রজাতন্ত্র হিসেবে যাত্রা শুরুর পর থেকে ব্রাজিলে চারবার অত্যন্ত সফলভাবে সামরিক শক্তি ক্ষমতায় আসার উদাহরণ আছে, যার মধ্যে একটি ২১ বছর ধরে দীর্ঘায়িত ছিল। যদিও মার্কিন জেনারেলরা ট্রাম্পকে সহায়তা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। ব্রাজিলেও তেমনটি ঘটবে কি না, স্পষ্ট নয়। তবে এর মধ্যে সহিংসতা চালিয়ে বলসোনারোর সমর্থকেরা লুলার ওয়ার্কার্স পার্টির নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন। এতে দুজন নিহতও হয়েছেন।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে দেখা যাচ্ছে, বলসোনারো নারী ভোটার ও সিদ্ধান্তহীন ভোটারদের কাছে নিজের ভাবমূর্তি নরম করার চেষ্টা করেছেন। জরিপগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, বলসোনারোর অতিরিক্ত পুরুষালি মনোভাব এবং নারী সাংবাদিকদের ওপর হামলার একাধিক ঘটনার কারণে তাঁর প্রতি নারী সমর্থকদের অনেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এর ফলে ২০ শতাংশ সুবিধা পাচ্ছেন লুলা। এরপরও নির্বাচনী প্রচারণায় নারীর জন্য অবমাননাকর বক্তব্য দিতে দেখা গেছে বলসোনারোকে, যেমনটি তিনি দিয়ে থাকেন।
চার বছর আগে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন বলসোনারো। ২০১৮ সালের নির্বাচনের দৌড়ে এগিয়ে থাকা লুলাকে অর্থ পাচার এবং দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং তাঁকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ফলে লুলার ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সাই পাওলোর সাবেক মেয়র ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ফার্নান্দো হাদ্দাদ ভোটারদের সমর্থন আদায় করতে মাত্র ছয় সপ্তাহের কম সময় পেয়েছিলেন। অন্যদিকে নির্বাচনী প্রচারণায় ছুরিকাঘাতের শিকার হয়ে আহত হওয়ায় সমর্থন বেড়ে যায় সাবেক সেনা ক্যাপ্টেন ও রিও ডি জেনিরোর কংগ্রেসম্যান বলসোনারোর। ফলে দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে তিনি হাদ্দাদকে ৫৫-৪৫ শতাংশ ভোটে হারিয়ে দেন। তাঁর বিজয়ের পেছনে বড় একটি ভূমিকা ছিল কট্টরপন্থী ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিষ্টানদের সমর্থন, যাঁরা এখন ব্রাজিলের জনসংখ্যার ৩১ শতাংশের বেশি।
বলসোনারোকে নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তাঁর অনেক প্রকাশ্য বিবৃতি অস্পষ্ট, অনেকটা ট্রাম্পের মতো। একদিন তিনি ঘোষণা করেন যে, নির্বাচনী ফলাফলকে সম্মান করবেন। পরদিন জোর দিয়ে বলেন যে, প্রথম দফায় তিনি ৬০ শতাংশ ভোট না পেলে বোঝা যাবে ভোট জালিয়াতি হয়েছে। সেই সঙ্গে রাজপথে সমর্থকদের নামানোর সক্ষমতাও প্রদর্শন করেছেন তিনি। বলসোনারো ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টে যে আঘাত হেনেছেন, তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে ও সামরিক হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে অনেকেই সেই সমাবেশে যোগ দেন।
ক্ষমতায় এসে বলসোনারো গুরুত্বপূর্ণ অনেক সরকারি পদে অতি ডানপন্থীদের নিয়োগ দিয়ে নতুন প্রশাসন সাজান। আন্তর্জাতিকভাবে তিনি ট্রাম্প সরকারের সঙ্গে একাত্ম হন এবং পুতিনের প্রতি সমর্থন প্রদর্শন করেন। তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক পরিষেবাগুলোর বাজেটে মারাত্মক কাটছাঁট করেন। আমাজন বনকে উজাড় করতে উত্সাহিত করেছিলেন। আদিবাসী অঞ্চলগুলোতে খনি ও কাঠ ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিয়েছিলেন। নারীবাদী ও সমকামিতা আন্দোলনকে একহাত নিয়ে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ উসকে দিয়েছিলেন তিনি।
ইতিমধ্যে লুলা ৫৮০ দিন কারাগারে ছিলেন। উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকায় তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ খারিজ করে দেন সুপ্রিম কোর্ট। অবশেষে তিনি প্রেসিডেন্ট পদে যোগ্য হয়েই ফিরে এলেন। সেই সঙ্গে নতুন করে ভোটের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেও দেরি করলেন না।
দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা দুর্বল করতে বলসোনারো নানা প্রচেষ্টা চালালেও সেখানে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। ব্রাজিলের গণতান্ত্রিক ভোটাধিকার রক্ষার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ—৯০ বছর ধরে। সুপ্রিম কোর্টের একজন সদস্যের নেতৃত্বে একটি বিশেষ আদালত গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়া তদারকি করেন। ১৯৯৬ সালে ব্যালট পেপারের বদলে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম চালু করা হয়, যার কারণে জালিয়াত প্রমাণ করা সহজ গেছে। নির্বাচনী ফলাফল পর্যবেক্ষণের জন্য গত আগস্টে সশস্ত্র বাহিনী নামানোর ডাক দেন বলসোনারো। কিন্তু দেশের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বদের অনেকে দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় একটি ইশতেহার ঘোষণা করেন, যেখানে অন্তত ১০ লাখ ব্রাজিলীয় স্বাক্ষর করেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোক্তা, ব্যবসায় সমিতি, ট্রেড ইউনিয়ন, মানবাধিকার সংগঠন।
যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন সরকারও ব্রাজিলের নির্বাচন সামনে রেখে বিবৃতি দিয়েছে। তারা ব্রাজিলের নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছে। সেই সঙ্গে এ-ও জানিয়েছে, সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য বলসোনারোর সম্ভাব্য প্রচেষ্টার প্রতি তারা নজর রাখছে। লুলা ডি সিলভা নির্বাচনী জরিপে এগিয়ে থাকার কারণে মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা তাঁর ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। ব্রাজিলের নাগরিক সংগঠনগুলোও বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, নির্বাচনের ফলাফলকে যেন স্বীকৃতি দেন তাঁরা।
তবে এ ব্যাপারে বলসোনারোকে নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তাঁর অনেক প্রকাশ্য বিবৃতি অস্পষ্ট, অনেকটা ট্রাম্পের মতো। একদিন তিনি ঘোষণা করেন যে, নির্বাচনী ফলাফলকে সম্মান করবেন। পরদিন জোর দিয়ে বলেন যে, প্রথম দফায় তিনি ৬০ শতাংশ ভোট না পেলে বোঝা যাবে ভোট জালিয়াতি হয়েছে। সেই সঙ্গে রাজপথে সমর্থকদের নামানোর সক্ষমতাও প্রদর্শন করেছেন তিনি। বলসোনারো ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টে যে আঘাত হেনেছেন, তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে ও সামরিক হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে অনেকেই সেই সমাবেশে যোগ দেন।
নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দিতে মার্কিন কংগ্রেস ভবনে ট্রাম্প-সমর্থকদের হামলার মতো ঘটনা ব্রাজিলেও ঘটবে কি না এবং সেটিকে সশস্ত্র বাহিনী, সামরিক পুলিশ বা আধা সামরিক বাহিনী সমর্থন করবে কি না, তা দেখার বাকি আছে। এটা হতে পারে যে বলসোনারোর হুমকিগুলো কেবল তাঁর অবস্থান নিরাপদ করার একটি উপায়। সরকারি অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির জন্য ফৌজদারি বিচার এড়াতে ভবিষ্যতে আলোচনার জন্য একটি চাপ হিসেবে কাজ করবে সেগুলো। অথবা সম্ভবত তিনি সহিংসতার অবলম্বনও করতে পারেন। তবে সব মিলিয়ে ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে গণতান্ত্রিক শাসনে ফিরে আসার পর থেকে ব্রাজিলে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন।
জেমস এন গ্রিন ব্রাজিলীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধ্যাপক, ব্রাউন ইউনিভার্সিটি, রোড আইল্যান্ড এবং ওয়াশিংটনে ব্রাজিল অফিসের ডিরেক্টর বোর্ডের প্রেসিডেন্ট
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত।