কদমতলী, বটতলী, আমবাগান, নিমতলা বা বিভিন্ন গাছের নামে চট্টগ্রামের যেসব এলাকা রয়েছে, সেগুলোয় নামের সঙ্গে মিল রেখে গাছ লাগানোর এক চমৎকার উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
বটতলী রেলস্টেশনের ঠিক কোন জায়গাটিতে বটগাছটা ছিল বা কদমতলী বাসস্ট্যান্ডের ভিড়-কোলাহলের মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেল কদমগাছটি, সেগুলো খুঁজে বের করে সেখানে নতুন করে একই জাতের একটি গাছ লাগালে রীতিমতো ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের মতো একটি ব্যাপার হবে। জেলা প্রশাসনকে এ রকম সৃজনশীল একটি উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ জানাতেই হয়।
এ ছাড়া জেলাজুড়ে ২২ লাখ গাছ লাগানোর ঘোষণাও দিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি)। অবশ্য ঘোষণাটি এসেছে এমন এক সময়, যখন বন বিভাগের পক্ষ থেকে প্রায় দুই একর জায়গাজুড়ে থাকা বন উজাড় ও গাছ কাটার অভিযোগ তোলা হয়েছে জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে। উপকূলীয় বন বিভাগের কর্মকর্তা তো গাছ কাটতে হলে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়ার কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন।
জেলা প্রশাসনের বক্তব্য, এসব জায়গা সম্প্রতি দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। একটি পার্ক ও পাখিদের অভয়ারণ্য করার কথা জানিয়ে তারা বলছে, নতুন করে ১০ হাজার গাছ সেখানে লাগানো হবে।
সরকারি দুটি সংস্থার এই চাপান-উতোর দেখে সমন্বয়হীনতার কথাটি মনে আসতে বাধ্য। সীতাকুণ্ডের কাট্টলী উপকূলে জেলা প্রশাসনের পার্ক তৈরির উদ্যোগটি আপাতদৃষ্টে আকর্ষণীয় বলেই মনে হয়। সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে এ রকম একটি পার্ক বা বিনোদনকেন্দ্র স্থানীয় এলাকাবাসী তো বটেই, ব্যস্ত কোলাহলমুখর জীবনে অভ্যস্ত নগরবাসীর জন্যও এটি ক্লান্তি অপনোদনের ব্যবস্থা হিসেবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। তবে প্রাকৃতিক পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করেই এসব উদ্যোগ নেওয়া উচিত। জেলা প্রশাসন ও বন বিভাগের মধ্যে এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা হলেই বরং প্রকৃত ভারসাম্য রক্ষা হবে।
বন রক্ষা ও পার্ক নির্মাণ নিয়ে সরকারি দুটি সংস্থার বিতর্কের মধ্যেই নতুন একটি সংবাদে দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। চট্টগ্রামের সড়কে নামছে প্রধানমন্ত্রীর উপহার দেওয়া দুটি পর্যটক বাস। নগরের টাইগারপাস এলাকা থেকে ডিসি পার্ক (ফৌজদারহাট) হয়ে এই বাস পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে যাতায়াত করবে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। সপ্তাহে শুক্র ও শনিবার এটি চলবে এবং মোটামুটি যুক্তিসংগত ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে যাতায়াতের জন্য।
পাহাড়চূড়ার বাড়িটি ছেড়ে নগরের কোনো একটি সুন্দর বাড়িতে ডিসির বাসভবন স্থানান্তরিত হলে তাঁর ‘ঘুমের ব্যাঘাত’ বা ‘প্রাইভেসি’ যেমন ক্ষুণ্ন হবে না, তেমনি তাঁর বদান্যতার কথাও দীর্ঘকাল মনে রাখবে এ অঞ্চলের মানুষ। সরকারি পদ দীর্ঘস্থায়ী নয়, কিন্তু সৎ ও সাহসী উদ্যোগের জন্য জনমনে স্থায়ী স্থান করে নিতে পারেন সরকারি কর্মকর্তাও। আশা করতে চাই, বর্তমান জেলা প্রশাসক সেই হৃদয়বেত্তার পরিচয় দেবেন।
সব মিলিয়ে এই ভ্রমণ বিত্তনির্বিশেষে মানুষের চিত্তবিনোদনের জন্য একটি ভালো ব্যবস্থা হবে বলে ধারণা করি। এসব উদ্যোগ-আয়োজন দেখে বর্তমান জেলা প্রশাসককে উদ্যোগী ও কর্মতত্পর মানুষ বলেই মনে হয়। সুতরাং তাঁর কাছে একটি পুরোনো বিষয় নতুন করে উপস্থাপনের সুযোগ নিতে চাই।
পর্যটক–বাসের যাত্রা যখন টাইগারপাস থেকে ডিসি পার্ক পর্যন্ত বলে উল্লেখ করা হয়, তখন একটু বিভ্রমের মধ্যেই পড়তে হয়। কারণ, নগরের কেন্দ্রস্থল নন্দনকাননের প্রকৃতিশোভিত যে পাহাড়ে জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার মহোদয় থাকেন, তাকেই তো ডিসি হিল পার্ক নামে চেনে নগরবাসী। নবনির্মিত একটি পার্ককে সেই একই নামে অভিহিত করা কি যথার্থ হবে?
তারপর নাগরিক সমাজের যে দাবি আমলাতন্ত্রের বেড়াজালে আটকে আছে, তা হলো ডিসি হিল পার্কটি সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক। সারা বছর এই পার্কের মুক্তমঞ্চে যে নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো, সাংস্কৃতিক কর্মীদের সেই কর্মকাণ্ড পরিচালনার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হোক। এই নগরে যে স্বল্পসংখ্যক মিলনায়তন আছে, তাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মতো আর্থিক সামর্থ্য সব সংগঠনের নেই, আবার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত মিলনায়তনে দর্শক-শ্রোতা হিসেবে প্রবেশের সৌভাগ্যও সবার হয় না।
ডিসি হিল পার্কটি ছিল সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত একটি বিনোদনকেন্দ্র। চমৎকার একটি মুক্তমঞ্চও আছে এখানে। কিন্তু ২০১৭ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ডিসি হিলে পয়লা বৈশাখ ছাড়া আর সব ধরনের অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
এ নিয়ে নাগরিক সমাজ ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা অনেক দেনদরবার ও আন্দোলন করেছেন। এমনকি বর্ষীয়ান রাজনীতিক ও সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের উদ্যোগ সত্ত্বেও তৎকালীন জেলা প্রশাসককে টলানো যায়নি। বর্তমান সরকারের আমলে আমলাদের দাপট কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার একটি উদাহরণ হতে পারে এ ঘটনা।
মূল সমস্যা হচ্ছে, ডিসি হিলের চূড়ায় আছে ডিসি সাহেবের বাসভবন। তৎকালীন জেলা প্রশাসক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ‘কোলাহল’ নিয়ে বিরক্ত এবং প্রাতঃ ও সান্ধ্যভ্রমণকারীদের অবাধ চলাফেরার ফলে ‘প্রাইভেসি’ ক্ষুণ্ন হওয়ায় রীতিমতো ক্ষুব্ধ ছিলেন।
সাউন্ড সিস্টেমের আওয়াজে তাঁর ঘুমের ব্যাঘাত হয়, সন্ধ্যার পর এখানে অসামাজিক কার্যকলাপ হয় ইত্যাদি অভিযোগও তুলেছিলেন তিনি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে, প্রাতঃ ও সান্ধ্যভ্রমণকারীদের যাতায়াত সীমিত করে দিয়ে মাথাব্যথার জন্য মাথা কাটার ব্যবস্থা করে দিয়ে গিয়েছিলেন এই দাপুটে সরকারি কর্মকর্তা।
চট্টগ্রাম শহরে অতীতে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান, মোজাম্মেল হক, হাসনাত আবদুল হাইয়ের মতো কীর্তিমান ব্যক্তিরা। নগরের উন্নয়ন ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাঁদের অবদানের কথা মানুষ আজও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। কিন্তু যে ব্যক্তি নিজের অহমিকা বজায় রেখে ডিসি হিল পার্কটিকে ব্যক্তিগত সম্পদ বিবেচনা করেছিলেন, তিনি আজও নগরবাসীর কাছে খলনায়কই।
বর্তমান জেলা প্রশাসক বেশ কিছু সৃজনশীল উদ্যোগ নিয়েছেন, আমরা সেই উদ্যোগের সাফল্য কামনা করি। পাশাপাশি ডিসি হিল পার্কটি উন্মুক্ত করে দিয়ে এর সুন্দর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার আহ্বান জানাই। পাহাড়চূড়ার বাড়িটি ছেড়ে নগরের কোনো একটি সুন্দর বাড়িতে ডিসির বাসভবন স্থানান্তরিত হলে তাঁর ‘ঘুমের ব্যাঘাত’ বা ‘প্রাইভেসি’ যেমন ক্ষুণ্ন হবে না, তেমনি তাঁর বদান্যতার কথাও দীর্ঘকাল মনে রাখবে এ অঞ্চলের মানুষ। সরকারি পদ দীর্ঘস্থায়ী নয়, কিন্তু সৎ ও সাহসী উদ্যোগের জন্য জনমনে স্থায়ী স্থান করে নিতে পারেন সরকারি কর্মকর্তাও। আশা করতে চাই, বর্তমান জেলা প্রশাসক সেই হৃদয়বেত্তার পরিচয় দেবেন।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক