সংসদীয় গণতন্ত্র নাকি ‘মৌলিক গণতন্ত্রের’ অন্য রূপ

‘সংসদীয় গণতন্ত্র নাকি “মৌলিক গণতন্ত্রের” পুনঃপ্রবর্তন’ শিরোনামে নিজাম উদ্দিন আহমদের একটি লেখা গত ১২ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছিল। এর সঙ্গে কিছুটা ভিন্নমত প্রকাশ করে ‘কমিশনের প্রস্তাব গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করবে’ শিরোনামে লিখেছিলেন ইমরান সিদ্দিক, যা প্রকাশিত হয় গত ২৪ মার্চ। এবার এই লেখার জবাব দিয়েছেন নিজাম উদ্দিন আহমদ

শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগ নিয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে আমার একটা লেখা প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়। এরপর সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ইমরান সিদ্দিক তাঁর একটি লেখায় আমার সঙ্গে কিছু বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাঁর এ লেখার জন্য আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। 

২.

ইমরান সিদ্দিক লিখেছেন, ‘...সংবিধানের ১২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বরাবরই মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিয়োগ করে থাকেন।’ লক্ষণীয় হলো, রাষ্ট্রপতির মহা–হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক বাছাই করার কোনো এখতিয়ার নেই। তাঁকে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তিকেই নিয়োগ দিতে হয়। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, ‘কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’ অতএব বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাঁর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতায় মহা–হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিয়োগ দিতে পারেন না। 

ইমরান সিদ্দিকের মতে, বাস্তবে এসব (রাষ্ট্রের উচ্চতর পদগুলোয়) নিয়োগপ্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে না। কিন্তু সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে মহা–হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ জন্য তাঁকে কারও পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে না। তিনি তাঁর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতায় এ নিয়োগ দিতে পারবেন। 

কমিশনের এ সুপারিশের অন্যতম প্রধান ত্রুটি হলো, এটা বাস্তবায়িত হলে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে রাষ্ট্রপতি স্বেচ্ছাধীন নিয়োগ প্রদানের এই ক্ষমতাকে একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। 

ইদানীং ভারতের বিরোধী দলগুলো বারবার নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের অভিযোগ উত্থাপন করেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনের আগে মোদি সরকার দেশটির সিএজি দপ্তরের একটি প্রতিবেদনকে ব্যবহার করে আম আদমি পার্টিকে বেকায়দায় ফেলেছিল—এমন অভিযোগ উঠেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সিএজি দপ্তরকে ব্যবহার করে যেভাবে একটি রাজ্য সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতিও একই ধরনের কাজ করতে পারেন—এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। 

একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়, সংবিধান সংস্কার কমিশন সব সাংবিধানিক পদের নিয়োগের ক্ষমতা জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলকে (এনসিসি) দেওয়ার সুপারিশ করেছে। একমাত্র ব্যতিক্রম সিএজি। সিএজি নিয়োগের ক্ষমতা কেন রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হলো, তার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। আমার মতে, সিএজি নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে এনসিসির ওপর ন্যস্ত করা প্রয়োজন। তা না হলে সিএজি দপ্তরকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের যে আশঙ্কা, সেটা রয়েই যাবে। 

  • সিএজি নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে এনসিসির ওপর ন্যস্ত করা প্রয়োজন। তা না হলে সিএজি দপ্তরকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের যে আশঙ্কা, সেটা রয়েই যাবে। 

  • মৌলিক গণতন্ত্রীরা যেভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন, সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও একইভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দেবেন। 

৩. 

ইমরান সিদ্দিক জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের গঠনপ্রক্রিয়া সম্পর্কে আমার বক্তব্যকে সঠিক নয় বলে তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, সাংবিধানিক কাউন্সিলের নয়জন সদস্যের মধ্যে তিনজন সরকারি দলের, তিনজন বিরোধী দলের এবং তিনজন নিরপেক্ষ। আমি আমার লেখায় বলেছিলাম, কাউন্সিলের মোট সদস্যের পাঁচজন বিরোধীদলীয় এবং এর ফলে কাউন্সিলের কাজে একধরনের ভারসাম্যহীনতা দেখা যেতে পারে। 

ইমরান সিদ্দিক সম্ভবত উচ্চকক্ষের স্পিকারকে সরকারি দলের সদস্য হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তিনি যেটা হিসাবের মধ্যে নেননি, তা হলো, উচ্চকক্ষের স্পিকার ও নিম্নকক্ষের স্পিকারের নির্বাচন একইভাবে হবে না। নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্ধারিত হবে প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে। যে দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করবে, সেই দল থেকে প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকার নির্বাচিত হবেন। 

অন্যদিকে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুসারে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হবে বিভিন্ন দলের প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে (পিআর পদ্ধতিতে)। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যেসব দেশে উচ্চকক্ষ আছে, তার মধ্যে বেশির ভাগ দেশেই কোনো দল এককভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পায় না। এর ফলে বিভিন্ন দলের মধ্যে পদগুলো (স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, হুইপ) ভাগাভাগির বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হয়।

অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে এটা ধারণা করা যায়, আগামী নির্বাচনে বিরোধীদের সম্মিলিত ভোট সরকারি দলের প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে বেশি হবে। এতে বিরোধীদের জন্য উচ্চকক্ষের স্পিকার পদ পাওয়া সম্ভব হবে। অবার সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুসারে উচ্চকক্ষে ডেপুটি স্পিকার পদ বিরোধীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এর ফলে বিরোধীরাই সম্মিলিতভাবে উচ্চকক্ষ নিয়ন্ত্রণ করবে—এমনটাই অনুমিত হচ্ছে। সরকারকে উচ্চকক্ষের নিয়ন্ত্রণ পেতে হলে দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের সঙ্গে ‘আঁতাত’ বা ‘সমঝোতা’ করতে হবে, যা সংসদীয় রাজনীতিতে নৈতিক হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। 

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার প্রতিনিধিত্বকারী সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের উভয় কক্ষের সদস্যরা ব্যতীত আইনসভার উভয় কক্ষের বাকি সব সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে তাঁদের মধ্য থেকে মনোনীত একজন সাংবিধানিক কাউন্সিলের সদস্য হবেন।’ 

এই বিধান অনুসারে, সংসদে সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দলের বাইরে যেসব দল থাকবে, তাদের মধ্য থেকেই তথাকথিত নিরপেক্ষ সদস্যকে বাছাই করতে হবে। ইমরান সিদ্দিক ছোট ছোট বিরোধী দলের সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিত সদস্যকে ‘নিরপেক্ষ’ বলে বিবেচনা করেছেন, এটা সঠিক নয়। দলীয় ভোটে নির্বাচিত ব্যক্তি ভোটের পর নিরপেক্ষ হয়ে যাবেন—এ রকমটা মনে করার কোন কারণ নেই।

আরও পড়ুন

৪. 

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার ব্যাপারে বহুদিন ধরেই একরকম মতৈক্য রয়েছে। তবে সংবিধান সংস্কার কমিশন যেভাবে সুপারিশ করেছে, সেভাবে নয়। কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, অর্থ বিল ব্যতীত নিম্নকক্ষের সদস্যরা তাঁদের মনোনয়নকারী দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন। 

আমার লেখায় উল্লেখ করেছিলাম, এ প্রস্তাব স্থিতিশীল সরকার গঠনের পরিপন্থী। এর ফলে ‘হর্স ট্রেডিং’-এর সুযোগ বাড়বে এবং দলীয় নেতৃত্বে ঘন ঘন পরিবর্তনের আশঙ্কা থাকবে। সরকারের অস্থিতিশীলতার সুযোগে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়বে এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে উঠবে। এ বিধান চালু হলে সরকারের বিরুদ্ধে ‘অনাস্থা প্রস্তাব’ উত্থাপনের প্রবণতা বাড়বে। 

ইমরান সিদ্দিক ‘অনাস্থা প্রস্তাব’কে সরকারের জবাবদিহির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এটা অনেক পুরোনো ধারণা। জবাবদিহির পদ্ধতি হিসেবে অনাস্থা প্রস্তাবকে আজকাল তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। 

শুধু বাংলাদেশে নয়, আরও অনেক দেশেই ‘ফ্লোর ক্রসিং’-এর ব্যাপারে বিধিনিষেধ রয়েছে। এর ফলে সংসদ সদস্যদের নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার অধিকার অত্যন্ত সীমিত। এমনকি যেসব দেশে এ ধরনের আইন নেই, সেসব দেশেও সংসদ সদস্যরা চাইলেই অতি সহজে নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারেন না। এ রকমটা করলে তাঁদের দল ও নির্বাচকমণ্ডলীর (ভোটার) কাছে জবাবদিহি করতে হয়; যাঁরা দলের বিরুদ্ধে যান, অনেক সময় তাঁরা সংসদের ভেতরে ও বাইরে ‘অস্পৃশ্য’ হিসেবে বিবেচিত হন। 

ব্রিটেনে বাংলাদেশের মতো ফ্লোর ক্রসিংবিরোধী আইন নেই; তাই বলে সংসদ সদস্যরা ‘পূর্ণ’ স্বাধীনতা ভোগ করে না। সেখানে দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কাজের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। লেবার পার্টির এমপি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আফসানা বেগম একবার দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ভোট দিয়েছিলেন। এ কারণে তাঁকে ছয় মাসের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

সব গণতান্ত্রিক দেশেই সংসদ সদস্যদের কিছু নিয়মের মধ্যে কাজ করতে হয়। কিন্তু সংবিধান সংস্কার কমিশন বাংলাদেশের সংসদ সদস্যদের জন্য ‘সীমাহীন’ স্বাধীনতার সুপারিশ করেছে। স্বাভাবিকভাবেই এর সঙ্গে একমত হতে পারেনি বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মতো রাজনৈতিক দলগুলো। (নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা চায় না প্রধান দলগুলো, প্রথম আলো, ২ এপ্রিল ২০২৫)

ইমরান সিদ্দিক লিখেছেন, ‘অনাস্থা ভোট’ গণতন্ত্রকে দুর্বল করে না, বরং শক্তিশালী করে। উদাহরণ হিসেবে তিনি ১৯৭৯ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জেমস ক্যালাহানের মাত্র ১ ভোটের ব্যবধানে পরাজয়ের বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি যদি ব্রিটেনের উদাহরণ না দিয়ে ১৯৫০-এর দশকের পাকিস্তানের উদাহরণ দিতেন, তাহলে বিষয়টি অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হতো। 

১৯৫১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর পুরো দশকই রাজনৈতিক অস্থিরতায় জর্জরিত ছিল। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত সাত বছরে ছয়জন প্রধানমন্ত্রী সরকার গঠন করেন। এ সময় সংসদ সদস্যদের মধ্যে দলত্যাগ অথবা দলবদলের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়; কিছুদিন পরপর সরকার গঠন ও ভেঙে যাওয়া অনেকটা রেওয়াজে পরিণত হয়। পাকিস্তান আমলের অভিজ্ঞতা থেকেই ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। 

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে স্বাধীনতার পর প্রায় ৪০ বছর পর্যন্ত ফ্লোর ক্রসিংবিরোধী কোনো আইন ছিল না। এর ফলে ১৯৭০–এর দশকে ভারতের রাজনীতিতে তুমুল অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। তখন বিশেষ করে বিধানসভার সদস্যদের দলত্যাগের প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। বিভিন্ন দলের সদস্যরা ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক সুবিধার জন্য বড় মাত্রায় দলবদল শুরু করেন। পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে সরকার গঠন ও সরকার টিকিয়ে রাখা অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ১৯৮৬ সালে সেখানে ফ্লোর ক্রসিংবিরোধী–সংক্রান্ত একটা আইন কার্যকর হয়, যার প্রধান উদ্দেশ্য সরকারকে স্থিতিশীল করা এবং সংসদীয় কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করা। 

পাকিস্তানেও ১৯৯৭ সালে এ ধরনের একটি আইন করা হয়। এ আইন অনুযায়ী পাকিস্তানের কোনো নির্বাচিত সংসদ সদস্য চার ক্ষেত্রে দলীয় নির্দেশনার বাইরে ভোট দিতে পারবেন না। এগুলো হলো, প্রধানমন্ত্রী অথবা মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন, বাজেট পাস, সংবিধান সংশোধনের বিল পাস এবং অনাস্থা ভোট। এসব বিষয় ছাড়া বাকি সব বিষয়ে দেশটির সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে মতামত ব্যক্ত করতে পারবেন এবং ভোট দিতে পারবেন। 

ভারত ও পাকিস্তান, উভয় দেশের আইন আমাদের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের তুলনায় অনেকটাই নমনীয়। বাংলাদেশে যা প্রয়োজন, তা হলো, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের যৌক্তিক সংস্কার, কিন্তু বিলোপ বা মৌলিক পরিবর্তন নয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। 

৫. 

ইমরান সিদ্দিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও প্রধানমন্ত্রীর সমর্থকের সংখ্যা নিয়ে আমার বক্তব্যকে খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, ‘প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজের নির্বাচনী এলাকায় মাত্র কয়েক হাজার ভোট পেয়ে নির্বাচিত হতে পারেন, যেখানে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় সারা দেশের জনপ্রতিনিধিরা অংশ নেবেন...।’

ইমরান সিদ্দিক সম্ভবত জনগণের প্রত্যক্ষ অথবা সরাসরি ভোটে নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের পরোক্ষ ভোটে নির্বাচন—এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্যটা বুঝতে পারেননি। লক্ষণীয় হলো, জাতীয় নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী অথবা বিরোধীদলীয় নেতার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তাঁরা হয়তো একটি, দুটি বা তিনটি আসন থেকে নির্বাচিত হন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁদের নির্বাচনী এলাকা দেশব্যাপী বিস্তৃত। তাঁরা যেমন তাঁদের দলের প্রার্থীদের পক্ষে প্রচার–প্রচারণা করেন, একই সঙ্গে দলীয় প্রার্থীদের ‘নিজের প্রার্থী’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। এ অবস্থা শুধু বাংলাদেশেই নয়; পৃথিবীর অধিকাংশ সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশেই বিদ্যমান। 

 এটা স্পষ্ট যে প্রধানমন্ত্রী শুধু কোনো নির্দিষ্ট আসন বা নির্বাচনী এলাকার দায়িত্বে থাকেন না; তাঁর দায়িত্বের পরিধি অনেক বড়। নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী অথবা প্রধান বিরোধী নেতাই দলের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেন। তাঁরা দলের পক্ষে কোটি কোটি ভোটারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন; দলের জয়–পরাজয়ের দায় তাঁদের ওপরই বর্তায়। ‘প্রধানমন্ত্রী কয়েক হাজার ভোটে নির্বাচিত হতে পারেন’—এ ধরনের বক্তব্য সঠিক নয়। এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা ও অবদানকে খাটো করা হয়। 

৬.

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ হলো, রাষ্ট্রপতি পরোক্ষ পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবেন। এ ক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন হলো, একজন পরোক্ষভাবে নির্বাচিত ব্যক্তির ওপর রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহী ক্ষমতা অর্পণ কি যথাযথ হবে? অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন প্রত্যক্ষ ভোটে। এ ক্ষেত্রে জনগণ আগে থেকেই অবহিত থাকেন যে তাঁরা কাকে বা কোন দলের প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছেন। 

কিন্তু পরোক্ষ পদ্ধতিতে ৫০৫ সংসদ সদস্যের পাশাপাশি কয়েক হাজার স্থানীয় প্রতিনিধির পক্ষ থেকে মাত্র ৭৬ জন স্থানীয় প্রতিনিধি (সমন্বয়ক) রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দেবেন; স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা থাকবে না। এটাই ‘মৌলিক’ গণতন্ত্রের আরেক রূপ। আইয়ুব খানের আমলে মৌলিক গণতন্ত্রীরা যেভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন, সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও একইভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দেবেন। 

নির্বাচনের এই পদ্ধতি রাষ্ট্রপতিকে অধিকতর ‘বৈধতা’ দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা। তথাকথিত এই বৈধতাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রপতিকে অতিরিক্ত ক্ষমতায়িত করা হতে পারে—এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এ রকম কোনো কিছু সংসদীয় সরকারব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না।

ড. নিজাম উদ্দিন আহমদ সাবেক অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়