ইদানীং তরুণদের কোনো আড্ডায় যোগ দিলে সব বিষয় ছাপিয়ে আলোচনা যেন একবিন্দুতে এসে দাঁড়ায়। শুধু কি আড্ডায়? আত্মীয়স্বজন, নিকটজন, বন্ধুদের সাধারণ আলোচনায়ও বিষয়টি চলে আসে। আর তা হলো, বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে কার কী পরিকল্পনা। কে আইইএলটিএস দিয়েছে, ‘ফুল স্কলারশিপ’পেতে কত স্কোর লাগবে, কার ক্লাস কবে শুরু, ইউরোপ ভালো হবে নাকি আমেরিকা, নাকি অস্ট্রেলিয়া বা কানাডা। চারদিকে কেবল এই আলাপই শুনছি না, ঢের দেখছিও। আমাদের মেধাবী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছেলেমেয়েরা বিদেশে পাড়ি জমাতে হন্যে হয়ে চেষ্টা করছেন। পড়াশোনা শেষে আবার ফিরে আসবেন কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে, অনেকের উত্তর, ‘আগে তো যাই, তারপর দেখা যাবে।’
তরুণদের এই প্রবণতাকে কোনোভাবেই নেতিবাচক বলতে পারি না।
তবে এর আগে বলা দরকার, বিদেশে উচ্চশিক্ষায় গমনের ক্ষেত্রে একটা নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। একটা সময় ছিল, কেবল ধনী পরিবার, বড় ব্যবসায়ী, মন্ত্রী-মিনিস্টার আর আমলা-পুত্রকন্যারাই এ সুযোগ পেতেন বা নিতেন। সমাজের ক্ষমতাশালীরা অবশ্য সব সময় নিজের সন্তানসন্ততিদের বিদেশে নিরাপদে রাখার নীতিতে বিশ্বাসী।
যা-ই হোক, এখন মধ্যবিত্ত তো বটেই, সাধারণ গরিব ঘরের, এমনকি কৃষক পরিবারের সন্তানেরাও উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছেন। ওয়েবসাইটে ঢুকে আবেদন করে, বৃত্তি অর্জন করে, প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে, ধারকর্জ করে টিকিট কিনে, ব্যাগপত্র গুছিয়ে উড়োজাহাজে উঠে বসছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমিটরিতে থাকছেন, ক্লাস করছেন, লেখাপড়ার ফাঁকে যতটুকু কাজের সুযোগ আছে, তা গ্রহণ করছেন। কেউ টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট বা টিএ হিসেবে আগেই মনোনীত হচ্ছেন। সবকিছুই একধরনের শৃঙ্খলার মধ্যে সেখানে চলছে বলে প্রতীয়মান হয়।
আরেকটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি, সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মায়েরাও তাঁদের মেয়েকে পর্যন্ত উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ পাঠাচ্ছেন। আগে সাধারণত বিয়ের পর মেয়েদের বিদেশ পাঠানোর অনুমতি দিতেন বাবা-মায়েরা। এখন বিয়ের আগেই মেয়েরা যেতে পারছে। চিন্তার এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানাতে হয়।
সম্প্রতি আমাদের এক নিকটজন যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার্থে গিয়েছেন। যাওয়ার পর কয়েকবার তাঁর সঙ্গে কথাও হয়েছে। যাওয়ার দিন দশেকের মাথায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি শেয়ার করেছেন। সেই ছবিতে তাঁকে দেখে ভালো লেগেছে।
কেবল তিনি নন, যাঁরা পড়তে যান বা পড়া শেষে সেখানে কাজ জুটিয়ে নেন, স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য অনুমতি পান, সবার খবর শুনে, ছবি দেখে ভালো লাগে। তাঁদের কেউ কেউ বলেন, তাঁরা যেখানে গেছেন, সে দেশে বা সে শহরে একটা ‘লাইফ’ আছে। লেখাপড়া, কাজ, আড্ডা, বেড়ানো—সবই চলছে। অবশ্য লাইফের ধারণা সব সময়ই ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। একজন মানুষ কীভাবে তাঁর জীবন গোছাবেন, এটা একান্তই তাঁর নিজস্ব ব্যাপার। তারপরও আমাদের বিশেষ করে ২ কোটি ১০ লাখ মানুষের ঢাকা শহরে যতটা বায়ুদূষণ, যতটা শব্দদূষণ, এই যন্ত্রণা থেকে তো তাঁরা আপাতত মুক্তি পেয়েছেন, এটা ভেবে আমার ভালোই লাগে।
যারা মেধাবী, তারা যদি এভাবে শয়ে শয়ে দেশ ছাড়তে থাকেন, তাহলে দেশটাকে কারা এগিয়ে নেবে? ভবিষ্যতে কারা নেতৃত্ব দেবে? ‘ঠেকার কাজ চালানোর’ মতো লোক দিয়ে একটি দেশ কীভাবে সামনের দিনগুলোতে কঠিন, কঠোর প্রতিযোগিতায় নাম লেখাবে?
২.
আমাদের প্রিয় বাংলাদেশও অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট এগিয়েছে ও এগোচ্ছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ দৃষ্টিনন্দন সব অবকাঠামো তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির যন্ত্রণা সত্ত্বেও জীবনমান বেড়েছে, মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু সার্বিকভাবে বেড়েছে। তারপরও এটা হয়তো তরুণদের বিদেশমুখিনতা আটকানোর জন্য যথেষ্ট নয়। অথবা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ধারা আর তরুণদের বাইরের দুনিয়ার প্রতি আগ্রহ—দুটি ভিন্ন বিষয়। এ বিষয়ে বোধ করি সমাজ-গবেষকেরা ভালো ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
তরুণদের অনেকের মধ্যে এ রকম ধারণা আছে, ঠিকমতো পড়াশোনা করলেও ফলাফলে তা প্রতিফলিত হবে না। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চাকরি জুটবে না। কোনো না কোনোভাবে বৈষম্যের স্বীকার হওয়ার ঝুঁকি তাঁর জীবনে আসতে পারে। আর চলমান বাস্তবতা তো এটা অস্বীকার করে না যে আমাদের শিক্ষাঙ্গন কলুষিত। ছাত্ররাজনীতি একেবারেই ঠিক পথে নেই। আজ থেকে দুই-আড়াই দশক আগে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন ছাত্ররাজনীতি দেখেছি। অনেক কিছু বদলেছে, আবার অনেক কিছু বদলায়নি। লাঠালাঠি, কোপাকুপি থেকে গেছে এখনো। সাধারণ শিক্ষার্থীরা আজও নির্যাতিত। এমন অবস্থায় একজন সাধারণ মেধাবী তরুণ বা তরুণী বিদেশমুখী হয়ে স্বাভাবিক জীবন বেছে নেবে না কেন?
তারপরও বিচলিত বোধ করি, যখন ভাবি, যারা মেধাবী, তারা যদি এভাবে শয়ে শয়ে দেশ ছাড়তে থাকেন, তাহলে দেশটাকে কারা এগিয়ে নেবে? ভবিষ্যতে কারা নেতৃত্ব দেবে? ‘ঠেকার কাজ চালানোর’ মতো লোক দিয়ে একটি দেশ কীভাবে সামনের দিনগুলোতে কঠিন, কঠোর প্রতিযোগিতায় নাম লেখাবে?
৩.
তারপরও তরুণদের এই বিদেশমুখিতাকে নেতিবাচক হিসেবে দেখি না, ইতিবাচকই বলতে হবে। কিন্তু জরুরি প্রশ্ন হলো, উন্নত রাষ্ট্রে পড়াশোনা করে দক্ষতা অর্জন শেষে তাঁরা কি দেশে ফিরে আসতে পারবেন? আসা দরকার। আমরা দেখছি, অনেক ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলার পুত্রকন্যারা লেখাপড়া শেষে দেশে ফিরে আসছেন। এসে অনেকেই পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরছেন। আবার কেউ কেউ যাওয়া-আসার মধ্যে আছেন। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা তুলনামূলক কম ফিরছেন বলে মনে হয়। তাঁরা বলছেন, তাঁদের দক্ষতা অনুযায়ী দেশে কাজের সুযোগ নেই। তার চেয়ে উন্নত বিশ্বের দেশে, যেখানে তাঁরা আছেন, চাকরি করার সুযোগ, বসবাসের পরিবেশ ভালো। অর্থ আয়ই সব সময় উন্নত জীবনযাপন বা ভালো থাকার একমাত্র নির্ণায়ক হয় না। সরকারি সেবা, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, মর্যাদা অনেক কিছুই এর সঙ্গে যুক্ত।
কিন্তু আমরা কি আমাদের মেধাবী তরুণদের হেলায় হারাব? তাঁদের দেশের কাজে লাগাব না? দেশের কাজে তাঁদের লাগাতেই হবে। এ জন্য সব সময় যে দেশে এসেই কাজ করতে হবে, এমন নয়। বিদেশে বসেও দেশের জন্য কাজ করা যায়। কেবল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বিদেশে খেলতে গেলে তাদের সমর্থন করার মধ্যে দেশপ্রেম সীমাবদ্ধ রাখলে চলে না।
আমাদের যেসব তরুণ বিদেশে পড়তে গিয়ে আর ফিরে আসেননি, সেখানে চাকরি, ব্যবসা বা গবেষণা করছেন, তাঁদের দেশের কাজে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, এ বিষয়ে জোরেশোরে আলোচনা শুরুর দরকার আছে।
কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক