‘সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মুসলিমদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। দেশে এই প্রথম কোনো মুসলিম লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিজেপির সংসদ সদস্য হতে পারছেন না। কোনো মুসলমান মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হন না। বিজেপি ভুল কাজ করেছে। আমাদের (কংগ্রেস) সরকার ছিল গোটা দেশের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু তারা “হিন্দ, হিন্দু, হিন্দুত্ব” স্লোগান দিয়ে জাতির পরিচয় বদলে দিতে চায়। এটা ভালো নয়।’
কথাগুলো ভারতের কংগ্রেস দলের সংসদ সদস্য শশী থারুরের।
ভারতের মুসলমানদের ভাগ্য এমনই; যাদের সংখ্যা ২০ কোটিরও বেশি এবং মোট ভারতীয় জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে টানা তৃতীয়বারের মতো দেশ চালাবে বিজেপি। সপ্তাহ খানেক আগে ৭১ জন মন্ত্রী ও রাজ্যের মন্ত্রীদের নিয়ে মন্ত্রিসভা ঘোষণা করেছেন নরেন্দ্র মোদি। তাঁদের মধ্যে কেউই মুসলমান নন। যেখানে নতুন সংসদে নির্বাচিত বিজেপির ২৪০ জন সংসদ সদস্যের কেউই মুসলমান নন, মন্ত্রিসভায় একজন মুসলমান কীভাবে থাকবে। দলটি মনোনয়নও দিয়েছিল মাত্র একজন মুসলিমকে, কেরালায় তিনি হেরেছেন।
নির্বাচনকালীন মোদির বক্তব্যেই স্পষ্ট হয় মুসলিমবিরোধিতার বিষয়টি। ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজস্থান রাজ্যে বিপুল জনতার সামনে মোদি বলেন, ‘ক্ষমতায় গেলে দেশের প্রধান বিরোধী দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দেশের সম্পদ “অনুপ্রবেশকারী” ও “যাদের বেশি সন্তান আছে”, তাদের মধ্যে বণ্টন করে দেবে।’
মোদি আরও বলেন, ‘কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তারা বলেছিল, সম্পদের ওপর মুসলমানদের অগ্রাধিকার রয়েছে। তারা তোমাদের সব সম্পদ একত্র করবে এবং যাদের বেশি সন্তানসন্ততি, তাদের মধ্যে বণ্টন করে দেবে। তারা অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে বিতরণ করবে।’ মোদি বলেন, ‘আপনারা কি মনে করেন, আপনাদের কষ্টার্জিত অর্থ অনুপ্রবেশকারীদের দেওয়া উচিত? আপনারা কি এটা মেনে নেবেন?’
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে মুসলমানরা তাঁর বিভেদমূলক রাজনীতি পরিহার করেছে। অন্যদিকে মোদির সহযোগীরা ও তাঁর হিন্দুত্ববাদী দল মুসলমানদের দূরে রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। তারা সম্ভবত এটি আরও পছন্দ করত, যদি কোনোভাবে মুসলমানদের ভারতীয় ভোটাধিকার থেকে দূরে রাখা হতো। কিন্তু তারা পারেনি, যে কারণে মুসলমানরা কংগ্রেস বা অন্যান্য ছোট রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে ২৪টি সংসদীয় আসনে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল।
ভারতের মোট ৫৪৩টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ২৪টি ছিটেফোঁটা আসন (৫% এরও কম) মুসলমানরা পেয়েছে, যেখানে ভারতের প্রায় ২০ কোটি মুসলমান রয়েছে। কিন্তু তারপরও এটা একটা প্রমাণ যে সুযোগ পেলে মুসলমানরা কিছুটা রাজনৈতিক শক্তির পরিচয় দিতে পারে। আর একেই ভয় করছে নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল। মোদি বা তাঁর দল কেউই বহু ধর্মীয়, সর্বজনীন, ধর্মনিরপেক্ষ ভারত চায় না। তারা এমন একটি ভারত চায়, যেখানে একক ধর্ম তার কট্টর হিন্দুত্বের সঙ্গে একটি নতুন ধর্মতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, পৌরাণিক রামরাজ্য ও মহাভারতের দিনগুলোয় ফিরে গিয়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাবে। অন্তত বিজেপি ও মোদির প্রচারযুদ্ধ ও কার্যকলাপ দেখে তা-ই মনে হচ্ছে।
ভক্স নিউজলেটারে বিজেপি মিশনের ব্যাখ্যা দিয়ে জাচ বিউচ্যাম্প লিখেছেন, ‘অযোধ্যায় একটি মন্দির নির্মাণ এমন একটি এজেন্ডার বিস্ময়বোধক পয়েন্ট, যার মধ্যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের দীর্ঘকাল ধরে প্রদত্ত স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহার, মুসলমানদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট নতুন নাগরিকত্ব ও অভিবাসন বিধি তৈরি করা এবং ভারতীয় ইতিহাস থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দু সহিংসতাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য পাঠ্যপুস্তক পুনর্লিখন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সুতরাং এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে একসময় সর্বভারতীয় দল হিসেবে পরিচিত বিজেপির মন্ত্রিসভায় একজনও মুসলমান নেই, ২৪০ জন নতুন সংসদ সদস্যের মধ্যে একজনও মুসলিম পার্লামেন্টারিয়ান নেই।’ (রাজ্যসভায় একমাত্র মুসলিম বিজেপি সদস্য মুখতার আব্বাস নকভি এই বছরের শুরুতে বিজেপি থেকে পদত্যাগ করেছেন।)
কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল কি পারবে ১৫ শতাংশ জনগণকে দমন করে ভারত শাসন করার জন্য তাদের বিভেদমূলক রাজনীতি চালিয়ে যেতে? নিশ্চয়ই না।
ইতিমধ্যেই বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির মোহ থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে দেশটির জনগণ। লোকসভায় বিজেপি চার শতাধিক আসন দখল করবে বলে নির্বাচনী প্রচারে মোদির বাগাড়ম্বর এবং বাগাড়ম্বরের মাধ্যমে দলটি যে দাবি করেছিল, তা বেলুনের মতো ফেটে পড়েছে।
ভারত একটি বিশাল দেশ, যা বহু বিশ্বাসের বহুত্ব এবং তার বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কারণে বিদেশি ও দেশীয় অনেক আক্রমণ থেকে বেঁচে গেছে। এটি টিকে আছে, কারণ ধর্ম, বর্ণ বা জাতিগত ভিত্তিতে তার জনগণের মধ্যে বিভাজন তৈরি করার চেষ্টা সত্ত্বেও ভারতের সাধারণ জনগণ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং এই মূল্যবোধগুলোর প্রতি আনুগত্য বজায় রেখেছেন।
মোদির প্রত্যাশিত ভূমিধসের পরিবর্তে দলটি এই নির্বাচনে ৬৩টি আসন হারিয়েছে, যে কারণে মোদি এ বছর সরকার গঠনের জন্য তাঁর মিত্রদের কাছ থেকে সমর্থন চাইতে বাধ্য হয়েছেন। বিজেপি অনেক রাজ্যে ঝামেলার সম্মুখীন হয়েছিল, যেখানে আগে ভালো করেছে। বিজেপির জন্য সবচেয়ে চমকপ্রদ পরাজয় ছিল অযোধ্যা, যেখানে নরেন্দ্র মোদি এ বছরের শুরুতে বহু বিতর্কিত রামমন্দিরটি মহা ধুমধামের সঙ্গে উদ্বোধন করেছিলেন।
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ান থটের ডিরেক্টর রাজীব ভার্গব বলেন, ‘এটা ঘৃণার রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করা।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণ হিন্দু ও মুসলমানরা শান্তিপূর্ণভাবে একসঙ্গে বসবাস করেছে এবং তারা বিভেদ তৈরি করা পছন্দ করে না।’
ভারত একটি বিশাল দেশ, যা বহু বিশ্বাসের বহুত্ব এবং তার বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কারণে বিদেশি ও দেশীয় অনেক আক্রমণ থেকে বেঁচে গেছে। এটি টিকে আছে, কারণ ধর্ম, বর্ণ বা জাতিগত ভিত্তিতে তার জনগণের মধ্যে বিভাজন তৈরি করার চেষ্টা সত্ত্বেও ভারতের সাধারণ জনগণ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং এই মূল্যবোধগুলোর প্রতি আনুগত্য বজায় রেখেছেন।
নরেন্দ্র মোদি আর তাঁর দল ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা–ভিত্তিক রাজনীতি পরিহার করে দুই যুগ ধরে আন্দোলন করেছেন ভারতকে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে। তাই তিনি ও তাঁর দল হিন্দুত্ব স্লোগানে দেশকে ভাসিয়ে দিতে চাচ্ছে।
সুখের বিষয় এই যে, ২০২৪ নির্বাচন প্রমাণ করল যে ভারতের সব জনগণ বিজেপি আর তাদের দলনেতার হিন্দুত্ব স্লোগান আর ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র স্থাপনের চেষ্টাকে সমর্থন করেন না। তাই বিজেপি এবার নিরঙ্কুশভাবে লোকসভায় জয়লাভ তো দূরের কথা, নরেন্দ্র মোদির তৃতীয়বার সরকার গঠনে শরিক দলের সমর্থন নিতে হয়েছে। এ ধারা চলতে থাকলে আগামী নির্বাচনে বিজেপি আরও বড় ধাক্কা খেতে পারে বলে আমার মত।
নরেন্দ্র মোদি আর তাঁর দল ভারত শাসন করবে আরও পাঁচ বছর। এই পাঁচ বছরে ভারতে মুসলমানের সংখ্যা আরও বাড়বে বৈ কমবে না। ভারতে মুসলমানরা বেঁচে থাকবে তাদের সংখ্যায় শক্তি ও তাদের ওপর অনেক আক্রমণ সত্ত্বেও গণতন্ত্রের প্রতি আনুগত্যের কারণে। ভারতে তাদের অবস্থানের জন্য বাহ্যিক সহায়তার প্রয়োজন নেই।
বিজেপি মুসলমানদের দলে স্বাগত নাও জানাতে পারে, কিন্তু ভারতীয় হিসেবে তাদের উন্নতি ও বেঁচে থাকার জন্য কোনো নির্দিষ্ট দলের পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন নেই।
আজ আমরা যে উদ্ধত কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি, যারা জনসংখ্যার এই বিশাল অংশকে দমন করতে চায়, তা দমন হবে, যখন ভারত সামগ্রিকভাবে এর বিরোধিতা করার জন্য জেগে উঠবে, যেমনটি এবারের নির্বাচনে অনেকটা দেখা গেল।
ধর্ম বা বর্ণের ভিত্তিতে ঘৃণার রাজনীতি এবং সম্প্রদায়গুলোকে অবজ্ঞা করার সব প্রচেষ্টার বিরোধিতা করার জন্য সব কণ্ঠস্বর একত্র হলে গণতন্ত্র সর্বোত্তম কাজ করে। আমরা আশা করি, ঘৃণা ও বিশ্বাসভিত্তিক বৈষম্য থেকে দূরে থেকে ভবিষ্যতে ভারতের রাজনীতি সঠিক পথে চলবে।
জিয়াউদ্দিন চৌধুরী সাবেক বিশ্বব্যাংক ও সরকারি কর্মকর্তা।