ভারতীয় পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়ার ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভ (প্রাধান্যশীল বক্তব্য) হলো, এ বছর আগস্টে গণ–অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার পলায়ন পুরোপুরি একটি সাজানো ঘটনা। এটা একটি ক্যু বা সামরিক অভ্যুত্থান।
ক্ষমতার পালাবদলের জন্য যুক্তরাষ্ট্র গত পাঁচ-ছয় বছর বা তারও আগে থেকে কাজ করছে। এর জন্য কয়েক মিলিয়ন ডলারও ঢেলেছে। ভারতীয় মিডিয়ার ভাষ্যে, আমেরিকার আসল লক্ষ্য বাংলাদেশ নয়, ভারত। তারা চায়, ভারতকে নিজের তালুর নিচে নিয়ে আসতে। বাংলাদেশ সেই লক্ষ্যে ঘুঁটির প্রথম চাল।
কোথায়, কোন গোপন তথ্যের ভিত্তিতে তারা এমন চমৎকার কল্পকাহিনি ফেঁদে বসল? তারা দুটি উৎসের কথা বলেছে। এক, নিউইয়র্ক সফরকালে অধ্যাপক ইউনূসের মুখ ফসকে বলা একটা কথা। দুই, ‘গ্রেজোন’ নামে একটি বিতর্কিত ওয়েব পোর্টাল, যা ডিজিটাল ক্ষেত্র নিয়ে নানা ষড়যন্ত্রতত্ত্বের জন্য খ্যাত।
ভেঙে বলি। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সফরকালে অধ্যাপক ইউনূস তাঁর বিশেষ সহকারী, ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা মাহফুজ আলমকে দেখিয়ে বলেছিলেন, এই হচ্ছে আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’। আর আন্দোলনটা ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও সাজানো-গোছানো।
ভারতীয় মিডিয়ার ব্যাখ্যায়, এটা মোটেই স্বতঃস্ফূর্ত কোনো আন্দোলন নয়। এটি একটি পরিকল্পিত চক্রান্ত। অধ্যাপক ইউনূসের কথা ব্যবহার করে কলকাতার রিপাবলিকান বাংলা টিভির এক অতি নাটুকে টক শো হোস্ট জানালেন, ইউনূস আমেরিকার একজন ক্রীড়নক মাত্র। আমেরিকার চক্রান্ত বাস্তবায়নের জন্যই তাঁকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে।
তাঁদের কথা যে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যনির্ভর, সে কথা প্রমাণের জন্য এই মিডিয়া পণ্ডিতেরা গ্রেজোন নামে ওয়েব পোর্টালে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের একটি ‘গোপনীয়’ দলিল প্রকাশ করেছে। এই দলিল উদ্ধৃত করে গ্রেজোন বলেছে, পাঁচ-ছয় বছর আগে থেকেই গণতন্ত্র বিকাশের নামে হাসিনা সরকারকে হটিয়ে একটি মার্কিনপন্থী সরকার গঠনের চক্রান্তে রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট যুক্ত।
এই উদ্দেশ্যে তারা ছাত্রদের, সাংস্কৃতিক কর্মীদের, এমনকি বিহারি ও হিজড়া সম্প্রদায়ের কাউকে কাউকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে কীভাবে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে হয়, কীভাবে আন্দোলন গড়া যায়। তৌফিক নামের একজন র্যাপশিল্পীকে দিয়ে দুটি গানও গাওয়ানো হয়েছে, তা–ও ওই একই লক্ষ্যে। এই কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে, যখন ছাত্ররা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে নেমেছিলেন। সেটাও রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের ‘গ্র্যান্ড প্ল্যানের’ অংশ।
ভারতীয় বিশ্লেষকদের ষড়যন্ত্রতত্ত্বে আরেকটি বড় সমস্যা রয়েছে। তাঁদের দাবি, আগস্ট বিপ্লবের পুরোটাই হয়েছে পেছন থেকে ওই শ তিনেক অ্যাকটিভিস্টের সুবাদে। এর জন্য তারা নাকি ২০০৩ সাল থেকে চেষ্টা করে আসছে। সমস্যা হলো যুক্তরাষ্ট্র আর যা–ই করুক, ক্ষমতা থেকে কাউকে সরাতে দেশের মানুষের সঙ্গে হাত মেলাবে না। তারা সবচেয়ে বেশি ভয় করে জনতাকে। বরং পেছন থেকে ঘুঁটি নাড়তে তারা অনেক স্বস্তিবোধ করে সেই দেশের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে।
ঠিক কতজন ছেলেমেয়েকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে? যে গোপন নথির ভিত্তিতে গ্রেজোন এই দাবি করেছে, তাতে বলা হচ্ছে, তারা মোট ৭৭ জনকে প্রশিক্ষিত করার পাশাপাশি ৩২৬ জন নাগরিকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। মোট ৪৩টি পলিসি পরিবর্তনের দাবি নিয়ে তারা ৬৫ জন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে দেনদরবার করেছে।
শুধু তা–ই নয়, তারা হিজড়াসহ বিভিন্ন কমিউনিটির ওপর গবেষণা ও সমীক্ষাও প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া ২২৫টি ‘আর্ট অবজেক্ট’ বানানো হয়েছে, যা ইন্টারনেটে লোকজন চার লাখবার দেখেছে।
২০ কোটি লোকের দেশে ৪ লাখ ‘ভিউ’ যে মোটেই ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা নয়, তা হয়তো পাঠকদের বুঝিয়ে বলতে হবে না। কোক স্টুডিও বাংলার ‘দেওরা’ বা ‘মা লো মা’ দেখেছে সাত কোটি মানুষ। এটাকেই বলে ‘ভিউ’। তৌফিকের গান খুবই প্রেরণাদায়ী। কিন্তু সেই গান শুনে হাসিনা ও তাঁর দলবল দেশ ছেড়ে পালাবে, কোনো আহাম্মকও সে কথা বিশ্বাস করে না। ৭৭ জন অ্যাকটিভিস্ট, তা তাঁরা যত প্রশিক্ষিত হন না কেন, হাসিনার মতো স্বৈরশাসককে গোপনে ষড়যন্ত্র করে তাড়াবে, তা–ই বা কোন আহাম্মকে বিশ্বাস করে!
রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের যে প্রতিবেদনটি গ্রেজোন উদ্ধৃত করেছে, তা আসলে অতিসাধারণ একটি বার্ষিক প্রতিবেদন ছাড়া কিছু নয়। তাতে এমন কোনো কথাই নেই, যা পড়ে মনে হয় আমেরিকা এসব ছেলেপেলেকে সরকার হেলানোর কাজে ট্রেনিং দিচ্ছে। প্রতিবেদনে শুধু এক জায়গায় বলা হয়েছে, এই সংস্থারকাজের একটা লক্ষ্য বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি (টু ডিস্ট্যাবিলাইজ বাংলাদেশ পলিটিকস)। শোনা যাচ্ছে, মূল নথিতে এই কথাটি লেখা নেই, গ্রেজোন তা নিজেরাই যুক্ত করেছে। নিজস্ব তদন্ত শেষে দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকাটিও পুরো প্রতিবেদনটিকে মিথ্যা ও বানোয়াট বলে জানিয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) কী
রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট এবং তার সহযোগী ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট মার্কিন সরকারের অর্থপুষ্ট দুটি সংস্থা। এর প্রথমটি প্রধানত রিপাবলিকান ও দ্বিতীয়টি ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে একযোগে কাজ করে। এদের ঘোষিত লক্ষ্য, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের পথ প্রশস্ত করা। গণতন্ত্রের প্রসার বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের ঘোষিত একটি রাজনৈতিক লক্ষ্য। এ উদ্দেশ্যে বাইডেন প্রশাসন প্রতিবছর ‘গণতন্ত্র শীর্ষ বৈঠক’ নামে একটি বৈঠকেরও আয়োজন করে থাকে। আসলে এটা লোকদেখানো একটা ব্যাপার, প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তার লক্ষ্য নয়।
শুধু বাংলাদেশে নয়, তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই আইআরআই কাজ করে থাকে। সব দেশেই তাদের কাজের পদ্ধতি কার্যত একই রকম। সংযুক্ত সংস্থাগুলোকে তারা থোক গ্রান্ট বা অনুদান দিয়ে থাকে। তৌফিকও তাঁর গানের জন্য অনুদান পেয়েছেন। আইআরআইয়ের ওয়েবসাইটে গেলে যে কেউ এই সংস্থা বাংলাদেশে কী করছে তার বিবরণ পাবেন।
বাংলাদেশ নিয়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মতবিরোধ
ভারতীয় মিডিয়ার ষড়যন্ত্রতত্ত্ব অবশ্য এখানেই থেমে নেই। শেখ হাসিনা অনেক দিন থেকেই সেন্ট মার্টিন দ্বীপে আমেরিকা সামরিক ঘাঁটি বানাতে চায় বলে দাবি করে আসছিলেন। তিনি এমন কথাও বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র পার্বত্য চট্টগ্রামের ও মিয়ানমারের খ্রিষ্টানদের নিয়ে নতুন একটি দেশ বানাতে আগ্রহী। তিনি এই দুই প্রকল্পের বিরোধী, আর সে কারণেই যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে উৎখাতে আগ্রহী। ভারতীয় মিডিয়া অবশ্য আগবাড়িয়ে বলছে, এই যে নতুন খ্রিষ্টান রাষ্ট্র তার লক্ষ্য হবে ভারতকে বাড়তে না দেওয়া।
কোথায় কোন তথ্যের ভিত্তিতে শেখ হাসিনা এমন দাবি করেছিলেন, আমরা জানি না। বাংলাদেশের ২০১১ সালের জনশুমারি থেকে আমরা জানি, পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট ১৬ লাখ মানুষের বাস, যার বড়জোর ২০ শতাংশ খ্রিষ্টান। অর্থাৎ লাখ দুয়েক খ্রিষ্টান। অন্যদিকে মিয়ানমারে বেশ ভালোসংখ্যক খ্রিষ্টানের বাস হলেও তাদের অধিকাংশই চীন, কাচিন ও কারেন রাজ্যে বাস করে। এগুলোর কোনোটাই ঠিক বাংলাদেশের লাগোয়া নয়। লাগোয়া যে আরাকান বা রাখাইন রাজ্য, সেখানে হাতে গোনা কয়েক হাজার খ্রিষ্টানের বাস। তো, এই কয়েক লাখ মানুষ নিয়ে দেশ হবে, আর তা পাল্লা দেবে ভারতের সঙ্গে? বালখিল্য হয়ে গেল না কথাটা?
এই ষড়যন্ত্রতাত্ত্বিকেরা একটি জিনিস উপেক্ষা করে গেছেন। আর তা হলো ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং তারা একে অপরের কৌশলগত মিত্র। চীনকে ঠেকাতে আমেরিকার রণকৌশলের কেন্দ্রে ভারত। সে কারণেই ওয়াশিংটনের উৎসাহে দিল্লিকে চীনবিরোধী জোট কোয়াডে যুক্ত করা হয়েছে। অনেকে এমন কথাও বলে থাকেন, বাংলাদেশকে ‘ম্যানেজ’ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তার ‘লোকাল এজেন্ট’ হিসেবে ভারতকে দায়িত্ব দিয়েছে।
তবে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটা মতবিরোধ হয়েছে, তা কোনো গোপন ব্যাপার নয়। আমরা জানি, ভারতের মোদি সরকার গত ১৬ বছর হাসিনাকে অনুগত মিত্র বানাতে বিস্তর বিনিয়োগ করেছে। তাঁর অগণতান্ত্রিক ব্যবহার সত্ত্বেও হাসিনাকেই ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে মোদি সরকার ছিল অনমনীয়—এ কথাও এখন প্রমাণিত।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই দেশটিকে তার ‘গণতন্ত্র প্রসার’ প্রকল্পের একটি সদস্য বানাতে চায়। দেশটি দুর্বল, নানাভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। তাকে ‘টেস্ট কেস’ বানালে সহজেই ফল মিলবে, ওয়াশিংটনের কর্তাব্যক্তিরা হয়তো এমনটা ভেবে থাকবেন। ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যানও সে কথা মনে করেন। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রথম আলোকে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ অনেক দিন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে একটি ‘টেস্ট কেস’। (প্রথম আলো, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)
বাইডেন প্রশাসন যেভাবে বাংলাদেশকে ‘গণতান্ত্রিক’ বানাতে উঠেপড়ে লেগেছে, তাতে মোদি সরকার ভীষণ অস্বস্তিতে ছিল। গণতন্ত্র গোল্লায় যাক, হাসিনা আমার কথায় ওঠে-বসে, সেটাই আসল। সফল গণ–অভ্যুত্থানের ১০ দিন পর, ১৫ আগস্ট ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা এক দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। জানায় যে গত বছর নভেম্বরে দিল্লিতে এক মুখোমুখি বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনকে অনুরোধ করেছিলেন মার্কিন সরকার যেন হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের নামে কোনো অতিরিক্ত চাপ না দেয়। মৌলবাদ ও ইসলামি সন্ত্রাস ঠেকাতে তাদের হাসিনাকে প্রয়োজন। পোস্টের তথ্যানুসারে, ভারতের সেই চাপে কাজ দিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র হাসিনার ওপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ না করতে সম্মত হয়।
সেন্ট মার্টিনে মার্কিন ঘাঁটি
বাকি থাকল সেন্ট মার্টিনের প্রসঙ্গ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই শুনে আসছি, যুক্তরাষ্ট্র দ্বীপটির ওপর নজর দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু থেকে হাসিনা পর্যন্ত অনেকেই সেই কথা বলেছেন, কিন্তু কোনো প্রমাণপত্র দেননি। আমি বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন তিনজন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে এই দাবির সত্যতা সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছি। তাঁরা সবাই অস্বীকার করেছেন।
এসব মার্কিন কর্মকর্তার কথা আমাদের আমলে আনার দরকার নেই। আমরা জানি, তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দ্বীপটির কৌশলগত গুরুত্ব আছে, বিশেষত বঙ্গোপসাগরে চীনের ওপর নজরদারির জন্য। কিন্তু অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই বলেছেন, নৌঘাঁটি করার জন্য এই দ্বীপটি মোটেই উপযুক্ত নয়। এটি আয়তনে মাত্র ছয় বর্গমাইল। আমেরিকার সবচেয়ে ক্ষুদ্র ঘাঁটি ভারত মহাসাগরে দিয়েগো গার্সিয়া, সেটির আয়তন ৬ হাজার ৭২০ একর বা প্রায় ১১ বর্গমাইল।
ক্ষুদ্র আয়তন ছাড়াও সেন্ট মার্টিনের অন্য বড় সমস্যা হলো এর অগভীর জলসীমা বড় কোনো জাহাজ ভেড়ানোর জন্য উপযোগী নয়। তদুপরি দ্বীপটি মূলত কোরাল বা প্রবাল দ্বীপ। এখানে অতিমাত্রায় মানুষ ও নৌযানের চলাচল মারাত্মক পরিবেশগত সংকটের সৃষ্টি করবে।
এসবের চেয়েও বড় কথা, সেন্ট মার্টিনে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি হলে সারা বাংলাদেশে যে পরিমাণ মার্কিনবিরোধী মনোভাবের জন্ম দেবে, তা সামাল দেওয়া অসম্ভব হবে। ভারত মহাসাগরে, চীনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে প্রায় ৩০০টি নৌঘাঁটি নির্মাণ করেছে। রাজনৈতিক প্রতিবাদ উপেক্ষা করে তারা সেন্ট মার্টিনে আরেকটি ঘাঁটি করবে, এমন তো মনে হয় না।
ভারতীয় বিশ্লেষকদের ষড়যন্ত্রতত্ত্বে আরেকটি বড় সমস্যা রয়েছে। তাঁদের দাবি, আগস্ট বিপ্লবের পুরোটাই হয়েছে পেছন থেকে ওই শ তিনেক অ্যাকটিভিস্টের সুবাদে। এর জন্য তারা নাকি ২০০৩ সাল থেকে চেষ্টা করে আসছে। সমস্যা হলো যুক্তরাষ্ট্র আর যা–ই করুক, ক্ষমতা থেকে কাউকে সরাতে দেশের মানুষের সঙ্গে হাত মেলাবে না। তারা সবচেয়ে বেশি ভয় করে জনতাকে। বরং পেছন থেকে ঘুঁটি নাড়তে তারা অনেক স্বস্তিবোধ করে সেই দেশের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে।
পৃথিবীর যেখানেই যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে ‘রেজিম চেঞ্জ’ ঘটেছে, তা সম্ভব হয়েছে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে। ইরানে মোসাদ্দেগ সরকার, চিলিতে আলেন্দে (আইয়েন্দে) সরকার বা অতি সম্প্রতি পাকিস্তানে ইমরান খান সরকার সেই ষড়যন্ত্রের কিছু স্মরণীয় উদাহরণ।
বাংলাদেশে স্বৈরাচার পতন কোনো বহিঃশক্তির সরাসরি হস্তক্ষেপে ও গোপন ষড়যন্ত্রের ফল নয়। এটি ছিল বাংলাদেশের সব স্তরের মানুষের দুর্নীতিপরায়ণ ও অপরাধপ্রবণ একটি অলিগার্কিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভের ফল। সরকারপ্রধানের নির্দেশ উপেক্ষা করে দেশের সামরিক বাহিনীও এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। এর পেছনে কোনো ক্যুর চক্রান্ত তারা করেছিল, সে কথা ভাবার কোনোই কারণ নেই। বস্তুত সেনাবাহিনীর সদস্যরাও এই বিপ্লবের অংশীদার। যারা এই বিপ্লবের গুরুত্ব অস্বীকার করে, একমাত্র তারাই এই ষড়যন্ত্রতত্ত্বে স্বস্তিবোধ করতে পারে, তার বেশি কিছু নয়।
হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক