২০১৭ সালে কিছু নিরাপত্তাচৌকিতে আরসার কথিত হামলার অজুহাতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা শুরু করে এবং ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তাদের ফেরাতে মিয়ানমারের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ–আলোচনা হয়েছে। একটি চুক্তিও সই হয়েছিল। মাঝখানে একবার চীনও সহায়তাকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
২০২১ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেশটির সর্বময় ক্ষমতা দখল করে নিলে কারাবন্দী নেত্রী অং সান সু চির দলের নেতৃত্বে দেশটিতে জান্তাবিরোধী জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠিত হয় এবং শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।
এই যুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাদের দৃশ্যমান পরাজয়ের সূত্রপাত হয় গত অক্টোবরে শান রাজ্যে অপারেশন–১০২৭ শুরুর মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে হটিয়ে আরাকানের বুথিডং শহরের দখল নিয়েছে গৃহযুদ্ধের অন্যতম শক্তিশালী নন-স্টেট অ্যাক্টর বা রাষ্ট্রবহির্ভূত শক্তি আরাকান আর্মি। মংডুর পতনও এখন সময়ের ব্যাপার। দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহরই বাংলাদেশ সীমান্তের নিকটবর্তী এবং রোহিঙ্গা–অধ্যুষিত।
আরাকান আর্মির সঙ্গে সেনাদের চলমান যুদ্ধের ফলে গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দে নাফ নদীর এপারে বাংলাদেশি জনপদে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। এর মধ্যে ৫ জুন সেন্ট মার্টিন থেকে নির্বাচনী সরঞ্জাম ও কর্মকর্তাদের বহনকারী নৌযানে গুলিবর্ষণ করা হয় মিয়ানমার থেকে। গুলিতে ট্রলারটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কেউ হতাহত হয়নি। এরপর পণ্যবাহী ট্রলারেও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে।
এগুলোকে ঠিক চলমান সংঘাত থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আসা গুলি বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না; বরং বাংলাদেশের নৌযানগুলোকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে বলেই স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। এরপর টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে যাতায়াত, যাত্রী বা পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। দ্বীপে খাদ্যসংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কায় সরকারি ব্যবস্থায় সাগরপথে জাহাজে করে সেখানে খাদ্যপণ্য পাঠানো হয়।
এই গোলাগুলি মিয়ানমার বাহিনী করছে নাকি আরাকান আর্মি, এ নিয়ে কিছু অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। তবে নাফ নদীতে মিয়ানমার নৌবাহিনীর একটি জাহাজের ছবি প্রকাশিত হয়েছে। এই অপকর্মের হোতা যে–ই হোক না কেন, বাংলাদেশের দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ ১০ দিন ধরে বিচ্ছিন্ন ছিল এবং এ নিয়ে তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেন্ট মার্টিন হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, এমনটা চাউর হয়ে পড়েছিল। অবশেষে ১৫ জুন মিয়ানমারের জাহাজটি সরে যায় এবং আমাদের নৌবাহিনীর কিছু নৌযানও বাংলাদেশ জলসীমায় টহল শুরু করে। কাজটি আরও এক সপ্তাহ আগে করা গেলে ঘটনা এত দূর গড়াত না এবং প্রতিপক্ষ উপলব্ধি করত যে বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব ও নাগরিকদের নিরাপত্তাকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়।
এটা বলা যায় যে কেন্দ্রে সেনাশাসন টিকে গেলেও ভবিষ্যতে রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। ফলে গৃহযুদ্ধ-উত্তর কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ কোনো বাস্তব চুক্তিতে উপনীত হলেও রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো আরাকান আর্মির সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব হয়ে উঠবে না। আরাকান আর্মির সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ এবং অর্থবহ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা তাই বাংলাদেশের স্বার্থে অপরিহার্য। এ কথা ঠিক যে বাংলাদেশ সরকার একটি রাষ্ট্রবহির্ভূত সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে পারে না।
আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে এর মধ্যে। প্রথমটি—বুথিডং ও মংডুতে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ কাজের জন্য আরাকান আর্মি ও সেনারা পরস্পরকে দোষারোপ করেছে। তবে অপকর্মটি আরাকান আর্মির বলেই প্রতিভাত হয়।
দ্বিতীয়টি—বাংলাদেশের আশ্রয়শিবির থেকে বেরিয়ে বেশ কিছু রোহিঙ্গা তরুণ মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে, বিশ্বাসযোগ্য সূত্রে এমন খবর আছে। অভিযোগ আছে যে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সহায়তায় বিষয়টি ঘটেছে। যদি তা সত্য হয়ে থাকে, তবে এই ভুল সিদ্ধান্তের মাশুল গুনতে হবে আমাদের ভবিষ্যতে। অন্যদিকে আরসা ও আরএসও মিয়ানমার সেনাদের হয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়ছে, এমন অভিযোগও আছে। এমনিতে আরাকান আর্মি কখনোই রোহিঙ্গাবান্ধব ছিল না। সেনাদের হয়ে তাদের বিরুদ্ধে কিছু রোহিঙ্গার যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া সেই বৈরিতার আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ তার একটি প্রতিক্রিয়া হওয়া অসম্ভব নয়।
মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধে বাংলাদেশের মূল স্বার্থ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি। এই যুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনী নিরঙ্কুশ বিজয়ের মাধ্যমে দেশটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারবে, এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। তারপরও মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ এই মহা ঝুঁকিপূর্ণ ঝুড়িতেই তার সব ডিম রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এটা বলা যায় যে কেন্দ্রে সেনাশাসন টিকে গেলেও ভবিষ্যতে রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। ফলে গৃহযুদ্ধ-উত্তর কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ কোনো বাস্তব চুক্তিতে উপনীত হলেও রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো আরাকান আর্মির সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব হয়ে উঠবে না। আরাকান আর্মির সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ এবং অর্থবহ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা তাই বাংলাদেশের স্বার্থে অপরিহার্য। এ কথা ঠিক যে বাংলাদেশ সরকার একটি রাষ্ট্রবহির্ভূত সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে পারে না।
আবার এটাও একটা প্রচলিত পদ্ধতি যে নিজ স্বার্থে কোনো সরকার রাষ্ট্রবহির্ভূত সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ তো বটেই, প্রয়োজনে আর্থিক বা সামরিক সহায়তাও দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থে অবিলম্বে অনানুষ্ঠানিকভাবে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, যদি না ইতিমধ্যে তা করা হয়ে থাকে।
কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বাংলাদেশকে তো আবার দশবার চিন্তা করতে হয় ভারত ও চীন এটাকে কীভাবে নেবে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সবচেয়ে শক্ত খুঁটি চীন, আবার আরাকান আর্মির সঙ্গেও চীনের সুসম্পর্ক বিদ্যমান। পাশাপাশি ভারত সামরিক জান্তার সব অপকর্মকে বরাবর সমর্থন দিয়ে গেছে।
আরাকান আর্মির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো ছিল না; কিন্তু চিন রাজ্যের পালেতোয়া দখলে নেওয়ার পর এবং তাদের অব্যাহত অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে তারাও আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। দুই দেশই এসব করছে তাদের নিজ নিজ দেশের স্বার্থের বিবেচনায়। এ অবস্থায় নিজ স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশ যদি আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে, তাতে ভারত বা চীনের মর্মাহত হওয়ার কোনো কারণ দেখি না।
● মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব