স্বাধীনতার পর কবি আবুল হাসান লিখেছিলেন,
দালান উঠছে তাও রাজনীতি, দালান ভাঙছে তাও রাজনীতি,
দেবদারু কেটে নিচ্ছে নরোম কুঠার তাও রাজনীতি,
গোলাপ ফুটছে তাও রাজনীতি, গোলাপ ঝরছে তাও রাজনীতি!
মানুষ জন্মাচ্ছে তাও রাজনীতি, মানুষ মরছে তাও রাজনীতি!
বোন তার বেণী খুলছে যৌবনের অসহায় রোদে মুখ নত কোরে
বুকের ভ্রমর হাতে রাখছে লুকিয়ে, তাও রাজনীতি…
(কবিতা, অসভ্য দর্শন)
আবুল হাসান যে বাস্তবতায় কবিতাটি লিখেছিলেন, সেই বাস্তবতা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারিনি। আমাদের দেশে ক্ষমতার বদলের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বদলে যায়। কেবল চেয়ার নয়, রাষ্ট্রের নীতি-কৌশলও। কিন্তু এসব কতটা জনগণের কল্যাণে, আর কতটা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে, সেটা ভেবে দেখার বিষয়।
জাতীয় দিবস আমরা পালন করি কেন? এর মাধ্যমে জাতীয় চেতনা তথা জনগণের আবেগ-অনুভূতি ধারণ করার চেষ্টা করা হয়। যেমন আমাদের স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, জাতীয় শহীদ দিবস, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও বাংলা নববর্ষ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। আবার কোনো কোনো মহল যে বিতর্ক করেনি, তা-ও নয়।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর জিয়াউর রহমানের আমলে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস বদলে জাতীয় দিবস করা হয়েছিল। পরে আন্দোলনের মুখে সরকার আপস-রফা হিসেবে জাতীয় ও স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করে। কিন্তু ২৬ মার্চ এখন স্বাধীনতা দিবস হিসেবেই পালিত হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ঐতিহাসিক ৭ মার্চসহ আটটি জাতীয় দিবস হিসেবে উদ্যাপন বা পালন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত বুধবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক আদেশে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। এর আগে প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দিবসগুলো বাতিল হচ্ছে বলে জানানো হয়।
বিগত সরকার অনেক কিছুর মতো জাতীয় দিবসকেও দলীয়করণ করেছিল। অনেকের চোখে যা ছিল দৃষ্টিকটু। সেই সঙ্গে এ কথাও মানতে হবে, উল্লিখিত আটটি দিবসের সবগুলোকে এক পাল্লায় মাপা ঠিক হয়নি। যেমন ৭ মার্চ আমাদের জাতীয় ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন।
যে দিবসগুলো সরকার জাতীয় দিবসের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে, সেগুলো হলো ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মদিবস ও জাতীয় শিশু দিবস, ৫ আগস্ট শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী, ৮ আগস্ট বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকী, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস, ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেল দিবস, ৪ নভেম্বর জাতীয় সংবিধান দিবস এবং ১২ ডিসেম্বর স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস।
বিগত সরকার অনেক কিছুর মতো জাতীয় দিবসকেও দলীয়করণ করেছিল। অনেকের চোখে যা ছিল দৃষ্টিকটু। সেই সঙ্গে এ কথাও মানতে হবে, উল্লিখিত আটটি দিবসের সবগুলোকে এক পাল্লায় মাপা ঠিক হয়নি। যেমন ৭ মার্চ আমাদের জাতীয় ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন।
এই দিনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। এই দিনেই তিনি বলেছিলেন, ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবা না’, যা সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানেরও ঢাকার দেয়ালে শোভা পেয়েছে। অর্থাৎ ৭ মার্চের ভাষণ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। সেই ৭ মার্চকে বাদ দেওয়ার যুক্তি কী?
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালন না করা এবং ছুটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত সরকার আগেই নিয়েছিল। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আদেশে বলা হয়, উচ্চ আদালতের চূড়ান্ত আদেশ সাপেক্ষে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালন না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, উচ্চ আদালত যদি ভবিষ্যতে ভিন্ন আদেশ দেন, তাহলে আবার ১৫ আগস্ট জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হবে। জাতীয় জীবনে এমন কিছু বিষয় আছে, যা আদালতের নির্দেশ-আদেশ দিয়ে হওয়া উচিত নয়। এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক তথা জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমরা সেটা করতে পারেনি। পূর্বাপর সব সরকারই জাতীয় গৌরবকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছে।
উদাহরণ হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা যায়। যে ব্যবস্থা রাজপথে আন্দোলন ও জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে কায়েম করা হলো, আদালতের একটি বিতর্কিত রায়ে তা বাতিল হয়ে গেল । বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক সংকট, তার মূলেও সেই রায় ও সংসদে আওয়ামী লীগের একতরফাভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর অনেক বছর ৪ নভেম্বর সংবিধান দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বরং বলা যায়, দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান-বিশেষজ্ঞরা আন্দোলন করে এ দাবি আদায় করেছেন।
২০২২ সালের নভেম্বরে সমকালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেছিলেন, ‘সংবিধান দিবসের স্বীকৃতি এবং সেটা অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পালন করা উচিত।’ ১৯৯৯ সালে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ জনের মধ্যে জীবিত থাকা ১৯ জনকে সম্মাননা জানিয়ে তাঁরা বড় অনুষ্ঠান করেছিলেন। তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘সব সরকারই মুখে আইনের শাসনের কথা বলে, কিন্তু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সংবিধানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি তাঁরা বোঝেন না।’
শাহদীন মালিকের এই ক্ষুব্ধ মন্তব্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য যেমন, তেমনি বর্তমান সরকারের জন্যও প্রযোজ্য।
স্বাধীনতার আড়াই বছর পর ভারত সংবিধান রচনা করে ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি। পাকিস্তান সংবিধান রচনা করে স্বাধীনতার ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ। ভারত সেই দিনটিকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করে। আর পাকিস্তান করে পাকিস্তান দিবস হিসেবে। দুটিরই অবস্থান স্বাধীনতার দিবসের পর। আর আমাদের এখানে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করে এক বছর আগে আগে যে স্বীকৃতি আদায় করেছে, সেটিও বাতিল করা হলো ফ্যাসিবাদী সরকারের সিদ্ধান্তের দোহাই দিয়ে।
আওয়ামী লীগ সরকার করেছে বলে সবকিছু বাদ দেওয়া যায় না। আওয়ামী লীগ সরকার তো আমাদের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতও ঠিক করেছে। তাই বলে আমরা কি জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকাও বাদ দেব?
আগের সরকারের মতো এই সরকারকেও যদি অতীতের সবকিছু বাদ দেওয়ার মানসিকতায় পেয়ে থাকে, আখেরে পস্তাতে হবে।
লেখাটি শেষ করছি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মেঘমাল্লার বসুর ফেসবুক বার্তা দিয়ে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের দুই কর্মীও জীবন দিয়েছেন।
মেঘমাল্লার লিখেছেন, ‘৭ই মার্চ মুছতে নিলে মুজিববাদ মরে না, মুক্তিযুদ্ধ ডিলিট হওয়ার দিকে যায়।’
“আর দাবায়ে রাখতে পারবা না” মুছলে “উই রিভোল্ট’’-এর মর্মও মুছে যায়।
ইসলামিস্টদের বাদ দিলে বাংলাদেশে যত রাজনীতি আছে, সবই মুক্তিযুদ্ধের ওপর দাঁড়িয়ে। সিরাজ শিকদার থেকে জিয়াউর রহমান, কর্নেল তাহের থেকে মাওলানা ভাসানী—মুক্তিযুদ্ধ বাদ দিলে কেউই কিংবদন্তি থাকেন না। আওয়ামী লীগ হেভিলি ইনভলভড দেখে আপনি কি মুক্তিযুদ্ধ মুছতে যাবেন নাকি? এগুলা শিশুতোষপনা।’
‘গ্রো আপ। শেখ মুজিব বাংলাদেশের প্রথম স্বৈরাচার, কিন্তু সে আবার বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ের প্রধান ক্যারেক্টার—এই কন্ট্রাডিকশন অ্যাড্রেস করতে না পারলে আপনারা দেশে ৭১-এর বিরোধী শক্তির ন্যারেটিভকে প্রধান করে তুলবেন।’
‘কোনটা শেখ পরিবারের পারিবারিক দিবস আর কোনটা জাতীয় সিগনিফিকেন্সওয়ালা, এই ফারাক করতে পারতে হবে।’
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, এটা ইতিহাসের ফ্যাসিবাদী বয়ান নয়।
সোহরাব হাসান কবি ও প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক