তারুণ্যের জয়গাথা দেশে দেশে, যুগে যুগে মানুষকে আশার বাণী শুনিয়েছে, খুলে দিয়েছে স্বপ্ন আর সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। তারুণ্যের কাছে এটাই তো প্রত্যাশিত। আর এটাই অবধারিত। কিন্তু অবধারিত জেনেও কেন জানি না, তরুণদের বিজয়গাথা রচনার পথটি মসৃণ হয়নি কখনোই।
তাঁদের অপ্রতিরোধ্য শক্তিকে বারবার অবদমিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, তরুণদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে, তাঁদের পথে কাঁটা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। কণ্টকাকীর্ণ সেই পথে বারবার একমাত্র তরুণেরাই হাঁটার সাহস দেখিয়েছেন। কাঁটার আঘাতে জর্জরিত হয়েও শেষ হাসিটা কিন্তু তাঁরাই হেসেছেন। অন্তত ইতিহাস তা–ই বলে।
ছাত্রদের সাম্প্রতিক কোটাবিরোধী আন্দোলনকে বিচ্ছিন্ন একটি ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন বললে ভুল হবে। কবি হেলাল হাফিজ তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’তে বলেছিলেন, ‘শাশ্বত শান্তির যারা তারাও যুদ্ধে আসে/অবশ্য আসতে হয়ে মাঝে মধ্যে/অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে।’
আমার মতে, আজকের তরুণদের এই আন্দোলন রচিত হয়েছে তরুণসমাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রগাঢ় আহ্বানে উদ্দীপ্ত হয়ে। আর তাঁদের অস্তিত্বের এই সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে; রাষ্ট্রের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার অন্তরালে।
এবার একটু পেছনে ফিরে তাকাই। মনে পড়ে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে প্রথম আলোর উদ্যোগে ওআরজি-কোয়েস্ট সারা বাংলাদেশে তরুণদের নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপটি করা হয়েছিল ১ হাজার ২০০ তরুণের মধ্যে। সেখানে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৮২ শতাংশ তরুণই উদ্বিগ্ন তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
ওই জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের ৬৩ শতাংশই বলেছিলেন, তাঁরা জানেন না তাঁদের জীবনের লক্ষ্য কী। ৫৬ শতাংশ তরুণ উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেন তাঁদের নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে। দেশের রাজনীতি নিয়ে অধিকাংশ তরুণ তাঁদের অনাগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন।
একই বছর সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ (সিডার) ‘কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা ২০১৭’ শিরোনামে যে সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতেও বেরিয়ে এসেছিল, যে তরুণদের শিক্ষাগত যোগ্যতা যত বেশি, তাঁদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা তত কম।
দুই বছর পর জরিপটি আবার পরিচালিত হয়। সেখানে আরও ভয়াবহ চিত্র প্রতিফলিত হয়। ২০১৭ সালে যেখানে ৬৩ শতাংশ তরুণ জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে না জানার কথা বলেছিলেন, সেখানে ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশে। অর্থাৎ প্রতি পাঁচ তরুণের চারজনই জীবনের লক্ষ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ।
২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে তরুণদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছিল, যার মধ্যে অন্যতম ছিল কর্মসংস্থান এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। শিক্ষার মান ও শিক্ষা খাতের অব্যবস্থাপনা নিয়ে তরুণদের উদ্বেগ ছিল অনেক বেশি। নিয়মিত প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় তাঁরা বিপর্যস্ত ছিলেন। তাঁরা উদ্বেগ জানিয়েছিলেন চাকরির সুযোগ ও বেকারত্ব নিয়ে।
এ ২০১৮ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) তরুণদের নিয়ে একটি জরিপ প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৮২ শতাংশ তরুণ নিজের দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের জরিপে ৪৭ শতাংশ তরুণ জানিয়েছিলেন, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সুযোগের অসমতা তাঁদের সবচেয়ে বড় সমস্যা।
এবার আসি সাম্প্রতিক জরিপগুলোর দিকে। সাম্প্রতিক সময়ে তরুণদের নিয়ে দুটি জরিপের একটি হলো বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘শ্রমশক্তি জরিপ-২০২২’ এবং অন্যটি হলো এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত ‘যুব জরিপ-২০২৩’। বর্তমানে দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পাস বেকারের সংখ্যা মোট আট লাখ।
বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, যেখানে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, এমন ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১ শতাংশের কিছু বেশি, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় বা সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিধারী উচ্চশিক্ষিতের মধ্যে বেকারত্বের হার ১২ শতাংশ। এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত ‘যুব জরিপ-২০২৩’-এ উঠে এসেছে তরুণদের অপ্রাপ্তি ও হতাশার কথা।
সেখানে দেখা গেছে, মতামত প্রকাশ নিয়ে দ্বিধা, সংকোচ ও অস্বস্তিতে থাকেন বাংলাদেশের ৪৩ শতাংশ তরুণ এবং মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হন ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এমনকি ১২ শতাংশ তরুণ স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশবিরোধী বিভিন্ন আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা বাতিলেরও দাবি জানিয়েছিলেন।
অনেক তথ্য–উপাত্তের ভারে জর্জরিত আমার এ লেখাটি হয়তো পাঠকের জন্য সুখপাঠ্য নয়। তবে জরিপের ফলাফলগুলো যদি নীতিনির্ধারকেরা সে সময়েই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতেন, তাহলে হয়তো আজকের এ দিনটি দেখতে হতো না। যেকোনো জরিপ পরিচালিত হয় মূলত নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে, যেন তাঁরা সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তরুণদের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে জমতে থাকা এই হতাশা কেউ তলিয়ে দেখার প্রয়োজন অনুভব করেননি।
তরুণেরা চোখের সামনে শুধু দেখেছেন অর্থের লুটপাট আর ক্ষমতাধরদের ক্ষমতার প্রদর্শনী, দুর্নীতি, সুবিধাবাদী আদর্শের অনুসারী রাজনীতির চর্চা, সামাজিক অবক্ষয়, সম্পদের অসম বণ্টন, নানা অরাজকতা আর ট্রাফিকে আটকা স্থবির নগরজীবন।
ওদের সামনে নেই কোনো স্বপ্ন আর সম্ভাবনা, নেই বিনোদন, নেই কোনো রোল মডেল। উচ্চবিত্তের সন্তান কম মেধাসম্পন্ন হলেও দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান আকাশপথে আর নিম্নবিত্তের সন্তান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দালালের নৌকার পাটাতনে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেন। আর মধ্যবিত্তের মেধাবী সন্তানটির জন্য অবশিষ্ট থাকে শুধুই সরকারি চাকরি নামের সোনার হরিণ।
বছরের পর বছর ধরে জমতে থাকা এই হতাশা সবার অলক্ষ্যে একসময় বারুদে পরিণত হয়েছে। শুধু প্রয়োজন ছিল সামান্য আগুনটুকুর। আগুনের হলকা কিন্তু আমরা আরও দুবার টের পেয়েছিলাম ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন আর কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময়। কিন্তু সেই আন্দোলনগুলোর উত্তাপ কেন জানি না খুব দ্রুতই ভুলে গেল সরকার। সেই আগুন কিন্তু সেদিন নেভেনি। বরং তা ধিকিধিকি জ্বলেছে। আজ সেই আগুনের চরম প্রকাশ দেখছি আমরা। সেই আগুন আজ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে।
মনে পড়ে ২০১৮ সালের মার্চ মাসে ‘তরুণ তুমি বাংলাদেশেই থাকো’ শিরোনামে লেখাটি আমি শেষ করেছিলাম এভাবে, ‘আজ নিশ্চিতভাবেই রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের তরুণদের নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। তরুণসমাজ ও তাদের চাহিদা মাথায় রেখে একদিকে যেমন নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে, অন্যদিকে তাদের দেশে ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নিতে হবে। নতুবা এক হতাশাজনক সময় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।’ যখন সময় ছিল, তখন তরুণদের হতাশা নিয়ে কেউ ভাবেনি। আজ সেই হতাশার আগুন সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। এ আগুন নেভাতে হবে। খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে আমাদের।
নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী