আবারও ফ্যাসিবাদী শাসন না চাইলে...

৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন পুরো বাংলাদেশের মানুষ দেখেছিল, সেই স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ ছিল অন্তর্বর্তী সরকার গঠন। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেওয়ার পর ১০০ দিন ইতিমধ্যে পার হয়েছে। বিশ্লেষকেরা এর মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনের কর্মকাণ্ড নিয়ে নিজেদের মতো করে বিশ্লেষণ করছেন।

কেউ হয়তো সংস্কার কমিশনগুলোকে সরকারের সাফল্য হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ কেউ দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি কিংবা চাঁদাবাজি পুরোপুরি বন্ধ না হওয়াকে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতিবাচক দিক হিসেবে তুলে ধরছেন। তবে সাড়ে তিন মাসে যে বিষয় খুব একটা আলোচনার কেন্দ্রে থাকেনি, সেটা হচ্ছে জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া বিভিন্ন অংশীপক্ষ এবং তাদের বর্তমান অবস্থান আসলে কোথায়?

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আন্দোলনটি শুরু হয়েছিল শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে, যা পরবর্তী সময়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিয়ে সরকার পতনের এক দফায় গিয়ে শেষ হয়। যখন শিক্ষার্থীরা এক দফা দাবি পেশ করেছিলেন, তখন তাঁরা পরিষ্কার করে বলেছিলেন, ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ও ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বিলোপের জন্যই তাঁরা আন্দোলন করছেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কত সময় লাগতে পারে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক কাঠামো সংস্কার করার জন্য? এ নিয়ে আলোচনা চলতে পারে। কিন্তু নির্বাচনের আগে অন্তত এই সংস্কারটুকু যেন হয়। নইলে এ দেশের মানুষকে হয়তো আবারও কোনো না কোনো ফ্যাসিবাদীর বিরুদ্ধে রক্ত দিতে হতে পারে।

সে হিসাবে বলা যেতে পারে, বর্তমান সরকার ফ্যাসিবাদী কাঠামো বিলোপের জন্য নিশ্চিতভাবেই কাজ করছে কিংবা ভবিষ্যতে করবে। কারণ, সরকারপ্রধান পরিষ্কারভাবে বলেছেন, ছাত্ররা তাঁকে চাকরি দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে ছাত্ররা যে আশা কিংবা আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করছেন, সরকার নিশ্চয় সেদিক বিবেচনা করেই কাজ করবে। কিংবা এভাবেও বলা যেতে পারে, সরকার যদি ব্যর্থ হয়, এর দায়ভার ছাত্রদের কাঁধেও পড়বে।

কিন্তু দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোরও ভূমিকা ছিল, যারা এর আগে শত চেষ্টার পরও স্বৈরাচারী সরকার পতনে ব্যর্থ হয়। ফ্যাসিবাদী শক্তির সঙ্গে তারা কুলিয়েও উঠতে পারেনি। এই গণ-অভ্যুত্থানে দলীয়ভাবে না হলেও তাদের অংশগ্রহণ ছিল। এখন তারাও নিজেদের মতো করে কৃতিত্ব নিতে চাইছে এই অভ্যুত্থানের।

এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে রাজনৈতিক দলগুলোর বিশাল একটা ভূমিকা ছিল এই আন্দোলনকে সফল করতে। সে ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারকে অবশ্যই বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখানেই বোধ করি বর্তমান রাজনীতিতে কিছুটা সংশয় দেখা দিয়েছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি চাইছে, সরকার যেন নির্বাচনের একটা রূপরেখা ঘোষণা করে। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে—পুরো রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন হওয়ার আগপর্যন্ত কোনো নির্বাচন নয়। সে ক্ষেত্রে যেকোনো দলেরই ফ্যাসিবাদী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

এটি তো অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৩ বছর পরও আমরা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেখিনি। যার ফলে যখন যে দল ক্ষমতায় গিয়েছে, নিজেদের মতো করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করেছে। এবার একটা সুযোগ এসেছে এই ফ্যাসিবাদী কাঠামো ভাঙার।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কত সময় লাগতে পারে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক কাঠামো সংস্কার করার জন্য? এ নিয়ে আলোচনা চলতে পারে। কিন্তু নির্বাচনের আগে অন্তত এই সংস্কারটুকু যেন হয়। নইলে এ দেশের মানুষকে হয়তো আবারও কোনো না কোনো ফ্যাসিবাদীর বিরুদ্ধে রক্ত দিতে হতে পারে।

একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই আন্দোলনে বিশাল ভূমিকা হয়তো রেখেছে; কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলই নিজেদের পরিচয়ে রাস্তায় নামেনি। কেন নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয়ে রাস্তায় নামেনি?

উত্তরটা খুব সহজ। সে ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সমর্থন হয়তো তুলনামূলক কম পাওয়া যেত। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, সাধারণ মানুষও বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন চায়। সে ক্ষেত্রে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে তরুণদের কথা শোনা, ধৈর্য ধারণ করা এবং তাঁদের সহায়তা করা।

পশ্চিম ইউরোপের দেশ জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকেও কিন্তু তারা খুব দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে এখন শক্তিশালী অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। কী করে সেটা সম্ভব হলো?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তারুণ্যকে প্রাধান্য দেবে। সেই তরুণেরাই কিন্তু জার্মানিকে এগিয়ে নিয়েছেন। বাংলাদেশেরও সময় এসেছে তরুণদের প্রাধান্য দেওয়া। সেই সঙ্গে শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষসাধন। একদিন তরুণেরাই আমাদের এগিয়ে নেবেন; ঠিক যেমনটা করে দেখিয়েছেন স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে।

  • আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি

[email protected]