বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন, সে প্রশ্নে আমরা অন্তত দুটি পক্ষ দেখতে পাই। একদিকে সরকার, অন্যদিকে নাগরিক ও মানবাধিকার সংগঠন এবং গণমাধ্যম। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি আপনার দৃষ্টিতে এখন কেমন?
জেড আই খান পান্না: জনগণের সরকার হলে অবশ্যই জনগণের স্বার্থ দেখতে হবে। একদিকে সংবিধানে বলা হচ্ছে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করব। অন্যদিকে আইন প্রয়োগের বেলায় আমাদের মাথায় রয়েছে ব্রিটিশ আমলের মানসিকতা। জনগণকে আমরা প্রজা মনে করছি। ’৭২-এর সংবিধানে মানুষের মৌলিক অধিকারের কথা পরিষ্কারভাবে বলা আছে। অথচ আমাদের দেশ চলছে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি ও ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনে। সিপাহি বিদ্রোহ দমনের প্রেক্ষাপটে এই দণ্ডবিধি ও পুলিশ আইন হয়েছে। ব্রিটিশরা, পাকিস্তানিরা যেভাবে শাসন ও শোষণ করেছে, সেভাবে এই দেশ চালানোর অধিকার কারও নেই।
সব পুলিশ নিশ্চয়ই খারাপ নয়। কিন্তু তাদের বড় অংশই নাগরিকের মৌলিক অধিকার কী, সে সম্পর্কে ঠিকমতো জানে বলে মনে হয় না। কাউকে গালিগালাজ করা যাবে না, কারও কলার ধরা যাবে না—এই প্রশিক্ষণ তাদের দেওয়া হয় না। তারা শেখে, পুলিশের পোশাক পরার পর তুমি যা খুশি তাই করতে পারো। এখানেই সমস্যা।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উঠলেই সেটিকে মিথ্যা, দুরভিসন্ধিমূলক বা বিদেশিদের কাছে নালিশ দেওয়া—এমন সব তকমা দেওয়া হয়...
জেড আই খান পান্না: সরকারে যাঁরা থাকেন, তাঁরা এটা কোন যুক্তিতে বলেন, আমি জানি না। কিন্তু একই কথা বিএনপি বলেছে, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও বলেছেন। এখন সেটা আওয়ামী লীগ সরকার বলছে। আমার মনে হয়, চেয়ার স্পিকস দ্য সেম।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু তারা কি বছরের বছর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় দায়মুক্তি পেয়ে আসছে না?
জেড আই খান পান্না: অপারেশন ক্লিন হার্ট অভিযানে জড়িতদেরও দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। দায়মুক্তি দিয়ে করা আইনকে আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছেন। ফলে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের পরিবার বা যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁরা এখন আদালতের কাছে প্রতিকার চাইতে পারেন। বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীরা কখনোই দায়মুক্তি পাবে না। এখন যদি তারা সংবিধান পরিবর্তন করে আইয়ুব খানের মতো তাহলে অন্য কথা। হেফাজতে রুবেল হত্যার প্রেক্ষাপটে আমরা আদালতে গিয়েছিলাম। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা ও ১৬৭ ধারা (বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও রিমান্ড) নিয়ে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেছে তো এই সরকারই।
আপনি বহু বছর ধরে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। অনেকেই বলেন বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। আপনার কী মত?
জেড আই খান পান্না: উন্নতি-অবনতি দুটিই হয়েছে। অনেকগুলো ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে। যেমন পারিবারিক সহিংসতা কমেছে। নারীরা এখন প্রতিবাদ করতে শিখেছে। লিঙ্গবৈষম্য কিছুটা কমেছে। ২০০৪ সালে যেখানে চার শ নারী আইনজীবীও ছিলেন না, সেখানে এখন ১০ হাজারের মতো নারী আইনজীবী রয়েছেন। বড় অবনতি হয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং নির্বাচনী ব্যবস্থায়।
যেমন সংবিধানে লেখা আছে, আপনি যদি প্রাপ্তবয়স্ক হন, আপনার যদি যোগ্যতা থাকে, আপনি নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন। কিন্তু অলিখিত সত্য হলো, আপনার যদি কোটি কোটি টাকা খরচ করার ক্ষমতা না থাকে, তাহলে নির্বাচন করতে পারবেন না। আরেকটি বিষয় হলো, আইন করে দুই পার্টি ব্যবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সংসদে যে প্রস্তাবই আসুক, দলীয় সংসদ সদস্যরা তাতেই ইয়েস বলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আইন করা হলো, স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড়াতে হলে তাঁকে ২ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর আনতে হবে। কিন্তু অনেকে তো ২ শতাংশ ভোটই পান না। এর মানে হচ্ছে প্রার্থী হতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
মানুষের নিরাপদ খাদ্য ও নিরাপত্তা কোনোটাই নিশ্চিত করতে পারিনি। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন সিন্ডিকেটের গায়ে হাত দিতে গেলে পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়তে পারে। সরকার কি এত নড়বড়ে যে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না? আবার এসব নিয়ে প্রশ্ন তুললে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো মানবাধিকার রক্ষায় কতটা সক্রিয় ভূমিকা রাখছে? অভিযোগ আছে, বাছাই করা ইস্যুতে মানবাধিকারকর্মীরা সাড়া দেন, সমাজের সব অংশের জন্য কাজ করেন না। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
জেড আই খান পান্না: বাংলাদেশের মানুষের মানবাধিকার রক্ষায় মানবাধিকার সংগঠনগুলোর চেষ্টার কমতি নেই। নানা চ্যালেঞ্জ থাকার পরও সমাজের সব অংশের মানুষের কাছে পৌঁছাতে তারা চেষ্টা করে চলেছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কথা বলা যায়। তাদের জীবনমান উন্নয়নে মানবাধিকারকর্মীরা কাজ করছেন। কয়েক বছর আগে একটা বারে নিম্নবর্ণের একটা ছেলে আইনজীবী হলেন। তাঁর চেয়ার-টেবিল, খাবার থালা, চায়ের কাপ আলাদা করা দেওয়া হলো। আমরা সেখানে গেলাম, আইনজীবীদের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন এটা তাঁরা করছেন? একজন উত্তর দিলেন, ‘ওর বাবা মুচি, আমাদের জুতা পরিষ্কার করে।’ আমরা বললাম, মুচির ছেলে আইনজীবী হয়েছেন, এতে তো আপনাদের গর্বিত হওয়া উচিত। আমরা তাঁদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে আসার পর তাঁরা আর কোনো ঝামেলা করেননি।
অন্য জাতিসত্তাগুলোর ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তো বিস্তর...
জেড আই খান পান্না: এ দেশে আমরা সবাই তো আর বাঙালি নই। অন্য জাতিসত্তার মানুষও আছেন। আমরা আদিবাসীদের স্বীকৃতি দিতে চাই না। শুধু বিদেশিদের জন্য আমরা তাদের দিয়ে নাচ-গানের অনুষ্ঠান করাই। অথচ ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আছে, আদিবাসীদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই বলল, বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। আমার ধারণা, আদিবাসী ঘোষণা করলে তাদের যে বিশেষ অধিকারগুলো আছে, সেগুলো বাস্তবায়নের একটা বাধ্যবাধকতা থাকে।
মানবাধিকারকর্মীদের সীমাবদ্ধতাও তো অনেক...
জেড আই খান পান্না: আমাদের একটা সীমাবদ্ধতার জায়গা হলো তহবিলের। আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো সব জায়গায় আমাদের যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় না। যেমন কারাগারের ভেতর তো মানবাধিকারকর্মীরা যেতে পারেন না। আমি বারবার আদালতকে বলেছি, আপনারা গিয়ে থানাহাজতে গিয়ে সাত দিন থাকেন। আসামিদের রিমান্ডে পাঠানো হয়, পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে তাঁদের পেটায়। এরপর তাঁরা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্বীকারোক্তি দেন, আমি সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিচ্ছি...। আমার প্রশ্ন হলো, যদি তাঁরা সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দেবেন, তাহলে রিমান্ডে নিতে হবে কেন। প্রকাশ্যেই তো স্বীকারোক্তি দিতে পারেন।
আসামিকে গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারে আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। রুবেল হত্যা মামলার রায়ে আদালত এই নির্দেশনা দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগও সেটা অনুমোদন করেছেন। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো, কারও ক্ষেত্রেই এ নির্দেশনা মেনে চলা হয় না, একমাত্র ব্যতিক্রম যুদ্ধাপরাধীরা। চিকিৎসক, আইনজীবী, পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ৫৪ ও ১৬৭ ধারা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের মধ্যেই অদ্ভুত ঐকমত্য রয়েছে।
এনজিওগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানা পদক্ষেপ আছে। নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। অনেক এনজিও তহবিল ছাড় করাতে পারছে না; বিশেষ করে যারা মানবাধিকার ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করে।
জেড আই খান পান্না: তহবিল ছাড়ের ব্যাপারে এনজিও ব্যুরো সমস্যা তৈরি করছে। ফলে আমাদের কর্মকাণ্ড সংকুচিত করে ফেলতে হচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের অত্যন্ত ফলপ্রসূ কর্মসূচি ছিল প্রতিটি জেলায় নাট্যশিল্পী, বাউল শিল্পীদের দিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতামূলক নাটক প্রদর্শন। এই কর্মসূচি আমাদের বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এনজিও ব্যুরোর বক্তব্য হলো, মানবাধিকারের সঙ্গে নাটকের সম্পর্ক কী?
আগে প্রায় সব জায়গায় ব্লাস্ট এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের স্টাফ আইনজীবী ছিলেন। কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন শুনলে তাঁকে আদালতে তোলার আগপর্যন্ত আইনজীবী তাঁর সঙ্গে থাকতেন। এতে মারধর থেকে তিনি রক্ষা পেতেন। সেই কার্যক্রমও আমাদের অনেকটাই সংকুচিত করে ফেলতে হয়েছে। ঢাকায় থানার সংখ্যা ৫০, আমাদের নিজস্ব আইনজীবী তিনজন। আমাদের যে ডোনার নেই, তা নয়। আমরা চাইলে তহবিল আনতে পারি। কিন্তু এনজিও ব্যুরোর হস্তক্ষেপের কারণে এখানে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ডোনারদের তহবিল ছাড় করতে তারা নানা সমস্যা তৈরি করছে। আমি ঠিক জানি না, তারা কেন এটা করছে। সব ক্ষেত্রেই আমলানির্ভরতার কারণে এই সংকটগুলো সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের দেশে এখন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশ বন্ধ হয়ে গেছে।
এরশাদের সময় থেকে এ পর্যন্ত তুলনা করলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কোন অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে? আগে তো রাজনৈতিক কার্টুন স্বাভাবিক একটা বিষয় ছিল, কিন্তু এখন আমরা সেটা একেবারেই দেখছি না।
জেড আই খান পান্না: এ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ছে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি একবার একটা কার্টুন প্রদর্শনী উদ্বোধন করতে গেছেন। গিয়ে দেখেন সব কার্টুনই তাঁকে নিয়ে। প্রণব মুখার্জি বিষয়টি খুব উপভোগ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমাকে নিয়ে এত কার্টুন হতে পারে, সেটা ভেবে বিস্মিত না হয়ে পারছি না। মানুষ যদি হাসতে ভুলে যায়, তাহলে একটা সমাজ কীভাবে স্বাভাবিকভাবে চলবে?
আমাদের এখানে রাজনৈতিক কার্টুনের ঐতিহ্য একেবারে শেষ হয়ে গেছে। কয়েক বছর আগেও শিশির ভট্টাচার্য্য, রফিকুন নবীদের কার্টুনের মধ্য দিয়ে দিনের সেরা ঘটনাটা পাঠকের কাছে পৌঁছে যেত। কিন্তু এখন সেই সুযোগ আর নেই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শুধু খর্বই হয়নি, এখন রেশন কার্ডের মতো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে। সেন্সরশিপের তো একটা নীতিমালা থাকে, এখানে কোনো নীতিমালা নেই।
শ্রমিকনেতা শহিদুল ইসলাম হত্যার ঘটনায় মালিকপক্ষের যোগসাজশে হামলার অভিযোগ উঠলেও পুলিশ মালিকের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তদন্তের আগেই প্রভাবশালীদের পক্ষ নিলে ন্যায়বিচার কতটা আশা করা যায়?
জেড আই খান পান্না: আমাদের এখানে, বিচারটা গরিবের জন্য নয়, বিচারটা হয়ে গেছে ধনীদের জন্য। পুলিশসহ সবার মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেছে, যার নেই তার জন্য কিসের বিচার, যার আছে তাকে রক্ষার জন্যই তো বিচার। শ্রমিকনেতা শহিদুল ইসলাম হত্যার ঘটনায় পুলিশ কর্মকর্তা কোনোভাবেই কারও পক্ষে সাফাই গাইতে পারেন না। স্বাভাবিক বুদ্ধিতেই তিনি সেটা করতে পারেন না। অবশ্য তাঁর যদি অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা।
ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের (আইটিইউসি) মতে, শ্রমজীবী মানুষের জন্য বিশ্বের ‘সবচেয়ে বাজে’ ১০টি দেশের একটি বাংলাদেশ। এ বিষয়কে কীভাবে দেখেন?
জেড আই খান পান্না: এটা শতভাগ সত্যিই। শ্রম আদালতে যান, এর প্রমাণ পাবেন। বাংলাদেশের শ্রম আইন শ্রমিকের পক্ষে নয়। এই আইন মালিকের পক্ষে।
জেলখানায় একজন কারাবন্দীর ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। জেলখানায় নির্যাতনের ঘটনাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
জেড আই খান পান্না: কারাগারের ভেতরে পাপিয়া ও তার সহযোগীরা কীভাবে অন্য বন্দীর ওপর নির্যাতন চালাতে পারে, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। কারাগারের ভেতরে এই নির্যাতনের দায় কারা কর্তৃপক্ষের সবার। এর আগে আমরা দেখেছি, নিয়ম ভঙ্গ করে কারাগারে এক বন্দীর সঙ্গে নারীর সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ হলো, টাকাপয়সা থাকলে জেলখানা কারও জন্য স্বর্গের মতো। জেলখানার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর। তারা কি ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে?
প্রথম আলোর সঙ্গে এর আগে সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিচার বিভাগ থেকে শুরু করা উচিত। কিন্তু বিচার বিভাগ তো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়।
জেড আই খান পান্না: বিচার বিভাগ যদি দুর্নীতিমুক্ত না হয়, তাহলে কোনো দেশ থেকেই কোনো দিন দুর্নীতি যাবে না। বিচার বিভাগ সমাজের সর্বোচ্চ জায়গা, মানুষের শেষ আশ্রয়। সেখানে দুর্নীতি চললে মানুষ যাবে কোথায়? এ দেশে প্রতিষ্ঠানগুলো যত দিন পর্যন্ত বিকশিত না হবে, তত দিন পর্যন্ত দুর্নীতি কমবে না। বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমি বলি এটা এখনো নির্বাহী বিভাগের অধীন। স্বাধীন হলেও পুরোপুরি স্বাধীন হয়েছে, এটা বলা যাবে না।
রাজনৈতিক দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলছে। কিন্তু এগুলো তো সাময়িক বা তাৎক্ষণিক সমাধান। নির্বাচন কমিশনকে কেউই ক্ষমতা দিতে চায় না; বরং এর ক্ষমতা কীভাবে কমানো যায়, সেই চিন্তা করা হয়। আরেকটা বিষয়ও সত্যি, মনমানসিকতার দিক থেকে স্বাধীন না হলে সেই স্বাধীনতা তো ভোগ করতে পারবে না।
আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের পক্ষে অবস্থান নেয়ে বলে দাবি করে। কিন্তু এ সরকারের আমলেও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটেছে।
জেড আই খান পান্না: এটা দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার। বাংলাদেশে যত জমি দখল হয়, সেগুলো গরিবের জমি। ধনীর জমি দখল হয় না। রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটির বিষয়বস্তু এখনো এখানে বাস্তব। হিন্দু দুর্বল, বৌদ্ধ দুর্বল, খ্রিষ্টান দুর্বল, সাঁওতাল দুর্বল, চাকমা দুর্বল, আহমদিয়ারা দুর্বল। এ কারণেই তাঁদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে।
কয়েক দশক ধরে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছেন। বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির ক্রমে অবনমন হচ্ছে। কখনো কি হতাশ লেগেছে?
জেড আই খান পান্না: হতাশ হব কেন? আমার কাছে মানবাধিকার বিষয়টি ধারাবাহিক একটা বিষয়। একসময় সতীদাহের মতো ব্যবস্থা চালু ছিল। আজকের দিনে কেউ কি সেটা কল্পনা করতে পারবে? বাংলাদেশের মেয়েরা ফুটবলে এখন একটা জায়গায় পৌঁছেছে। মেয়েদের মধ্যে ফুটবল খেলা ঢাকায় আমরা শুরু করেছিলাম। এ জন্য আমার বিরুদ্ধে পোস্টারিং হয়েছিল। কিন্তু আজ মেয়েদের সাফল্য দেখলে গর্বে আমার বুক ভরে ওঠে। ফলে আজকের পরিস্থিতি বদলাবে। আগামী দিনে নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে, সেগুলো মোকাবিলা করেই এগোতে হবে। আশা হারানোর কিছু নেই।
আপনাকে ধন্যবাদ?
জেড আই খান পান্না: আপনাদেরও ধন্যবাদ।