১৭ জুলাই ২০২৪ বুধবার রাতে মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। বৃহস্পতিবার, ১৮ জুলাই, বন্ধ হয় ব্রডব্যান্ডও। কেন বন্ধ হয়েছে, সবাই জানেন।
সরকারের মন্ত্রী ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার জন্য অগ্নিসন্ত্রাসীদের দায়ী করেছেন। কারিগরি অক্ষমতার কথা বলেছেন।
নরওয়ে থেকে একটি টেলিকম যে কারণ দেখিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছে, তা ভিন্ন কথা বলে। অবশ্য ২৩ জুলাই রাত থেকে শুধু ব্রডব্যান্ড চালু হচ্ছে, মোবাইল নেট নয়, এর কারণও কি কারিগরি? নাকি সরকারের সিদ্ধান্ত? সে যাহোক, আমরা বেশ কদিন অ্যানালগ থাকলাম। ডিজিটাল ছিলাম না, স্মার্টও নয়, ছিলাম ‘আনস্মার্ট’।
বাংলাদেশ যে সত্যি ডিজিটাল হয়ে গিয়েছিল, ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ায় তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেছে। বহু বাসায় বিদ্যুতের মিটার প্রিপেইড, টাকা ফুরিয়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ গেল চলে, সেই মিটার চালু করতে না পেরে এই গরমের দিনে মানুষের জীবন জেরবার হয়ে গেল।
মানুষ বিদ্যুৎ অফিসে গিয়ে লাইনে দাঁড়াল, ঢাকাতেই প্রিপেইড মিটার ১২ লাখ। এ কি একটা একটা করে চালু রাখা সম্ভব?
অনলাইনে টাকা লেনদেন, মোবাইল রিচার্জ, ই-কমার্স, এফ-কমার্স, বিমানের টিকিট কেনাবেচা, ফ্রিল্যান্সিং, ওটিটি, ই-লার্নিং—সব বন্ধ।
পোশাক কারখানার মালিকেরা হায় হায় করছেন, কোটি কোটি ডলারের অর্ডার থেকে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন, ওদিকে বন্দরে আমদানি কি রপ্তানিও মুখ থুবড়ে পড়ল, সিস্টেমটা যে ডিজিটাল।
বাংলাদেশে আমরা না পড়তে পারলাম অনলাইন নিউজ পোর্টালের খবর, না প্রকাশ করতে পারলাম বস্তুনিষ্ঠ কনটেন্ট। ফেসবুক বন্ধ, ইউটিউব বন্ধ। কিন্তু সারা পৃথিবীতে কোটির অধিক বাংলাদেশি একযোগে পোস্ট আর শেয়ার করতে লাগল তা-ই, যা তাদের মনমতো হলো।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন, এই কথা যে ছড়িয়েছিল, তা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীই বলেছেন; জানিয়ে দিয়েছেন, শেখ হাসিনা পালান না। ফেইক নিউজে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছেয়ে গেল।
১৯৬৬ সালের ১০ জুন কারাগারের রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন (পৃষ্ঠা ৭৯), ‘দৈনিক খবরের কাগজ এল, দেখলাম কাগজগুলিকে সরকার সংবাদ সরবরাহ করা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রায়ই প্যামফ্লেট করে রেখেছে। কোনো সংবাদই নাই আন্দোলনের।
‘জেলের কয়েদিদের খবর হলো, হাজার লোকের উপর মারা গেছে পুলিশের গুলিতে—এমন অনেক খবর রটেছে। সত্য খবর বন্ধ হলে অনেক আজগুবি খবর গ্রামে গ্রামে ছড়াইয়া পড়ে, এতে সরকারের অপকার ছাড়া উপকার হয় না।’
এখন প্রথম আলো ডটকম থাকায় আমরা মানুষকে বলতে পারব, আপনারা দয়া করে প্রথম আলো ডটকমের খবর পড়ুন। প্রথম আলো যাচাই না করে খবর দেবে না।
মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট না থাকায় দেশের বেশির ভাগ মানুষ প্রথম আলো ডটকম পড়তে পারবেন না বটে, কিন্তু দেশের বাইরের বাঙালি পাঠকেরা তো পড়তে পারবেন। অন্তত গুজবের বদলে খবর পড়তে পারবেন।
১৫ জুলাই ২০২৪-এর পর থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত যা ঘটেছে বাংলাদেশে, তা হৃদয়বিদারক, মর্মন্তুদ, ভয়াবহ। এটুকু বললেও কিছুই বলা হয় না।
১৫ জুলাই, ১৬ জুলাইও আমরা বলার চেষ্টা করেছিলাম, শক্তি প্রয়োগ করে ছাত্র আন্দোলন বন্ধ করার চেষ্টা আত্মঘাতী হবে। এটা হবে মারাত্মক ভুল। শাসকেরা সেই ভুলই করে বসল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে লিখেছিলেন, ‘জনাব নুরুল আমিন কত বড় অপরিণামদর্শী কাজ করলেন। গুলি ছুড়লেন তাও ছাত্রদের উপর। মানুষের যখন পতন আসে, তখন পদে পদে ভুল করতে থাকে।’
তারপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। যাঁরা বলেছিলেন, আন্দোলন দমনের জন্য ‘ছাত্রলীগই যথেষ্ট’, তাঁরা যুবলীগ, আওয়ামী লীগ, পুলিশ-বিজিবি-আনসার-র্যাব-সোয়াট দিয়েও পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে শেষে কারফিউ দিলেন, সেনাবাহিনী ডাকতে বাধ্য হলেন।
রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা–আবিষ্কার’ কবিতায় আছে, ‘এমনি সব গাধা/ ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা!’
যে কোটা উচ্চ আদালতের নির্দেশে দেশে ছিলই না, যে সংস্কার ছাত্ররা চায়, সরকার চায়, এমনকি আদালতও চান, তার জন্য কেন এই রকম ভয়াবহ পরিস্থিতি হলো, মাথা ঠান্ডা করে হিসাব করে বের করতে হবে। ভবিষ্যতে একই ভুল যেন আর না হয়।
জামায়াত-শিবির জঙ্গিরা মাঠে নেমেছিল! অবশ্যই নেমেছিল। বিএনপি তো ঘোষণা দিয়েই নেমেছিল। আপনারা সামলাতে পারলেন না কেন? গোয়েন্দারা তো আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল।
প্রথম আলোতেই গোয়েন্দা সতর্কতার খবর ছাপা হয়েছিল।
একটামাত্র ভবনে আগুন লাগলে পুরো দেশের ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়? আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের নিরাপত্তা এত নাজুক? কোনো ব্যাকআপ থাকবে না?
বিটিভির মতো কি-পয়েন্ট ইনস্টলেশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হামলা চলে? তিনবার নাকি অনুপ্রবেশকারীরা এর দখল নিয়েছিল! প্রচার বন্ধ ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা! আমরা এত বিপন্ন, আক্রমণের মুখে এত অসহায়!
কতজন মানুষ মারা গেছেন, আমরা জানি না। প্রথম আলো মৃত্যুর সংখ্যা দিয়ে যাচ্ছে। ২৪ জুলাইয়ের প্রথম আলো ছাপা পত্রিকার খবর, ১৯৭ জনকে আমরা হারিয়েছি এই কদিনে।
শিশু মারা গেছে নিজ বাড়িতে খেলতে খেলতে গুলিবিদ্ধ হয়ে, ছাত্র মারা গেছে, স্কুলের, কলেজের, বিশ্ববিদ্যালয়ের। ছাত্র আন্দোলন আর ছাত্র আন্দোলনে সীমিত থাকেনি।
সরকারের ভাষায় জামায়াত-শিবির জঙ্গিরা ছিনতাই করেছিল সে আন্দোলন। মির্জা ফখরুলের ভাষায়, এটা হচ্ছে ছাত্র-জনতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
শামসুর রাহমানের কবিতা আছে, আবার স্বাভাবিক হবে সবকিছু।
হয়তো আবার সবকিছু স্বাভাবিক হবে। স্বাভাবিক হোক, আমরা তা-ই চাই। কিন্তু শত মায়ের শূন্য কোল আর ভরবে না।
পড়ুন প্রথম আলোর খবর:
জানালার পাশেই সামিরের পড়ার টেবিল। পড়ার বই, প্লাস্টিকের খেলনা, ঘরের মেঝেতে এখনো ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। গত শুক্রবার জানালা দিয়ে আসা একটি বুলেট সামিরের চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার খুলি ভেদ করে বেরিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ১১ বছরের সাফকাত সামির।
ওই দিন (১৯ জুলাই) কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে মিরপুরে কাফরুল থানার সামনের সড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া ঢুকছিল সামিরের ঘরে।
জানালা বন্ধ করতে গেলে বাইরে থেকে গুলি এসে বিদ্ধ করে শিশুটিকে। গুলিটি তার চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। ঘরে ছিল তার চাচা মশিউর রহমান (১৭)। তার কাঁধেও গুলি লাগে। (প্রথম আলো, ২৪ জুলাই ২০২৪)
এই কদিন একেবারে অ্যানালগ ছিলাম। আবার লোকে হাতে খবরের কাগজ নিয়ে পড়েছে। প্রথম আলো কুড়ি টাকায় বিক্রি হয়েছে। কারও চোখ আর মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে আঠার মতো লেগে ছিল না। এসএমএস বলতে যে একটা জিনিস ছিল, যার ব্যবহার আমরা ভুলে গিয়েছিলাম, তা আবার চালু হয়ে গিয়েছিল। ২৪ ঘণ্টার দিন যে এত লম্বা, তা আবারও জানা গেল। আর মোবাইল ফোনের চার্জও এতক্ষণ থাকে, তা-ও আমরা নতুন করে আবিষ্কার করলাম।
‘ছিন্নমুকুল’ কবিতায় পড়েছিলাম:
সবচেয়ে যে ছোট কাপড়গুলি
সেইগুলি কেউ দেয় না মেলে ছাদে,
যে শয্যাটি সবার চেয়ে ছোট,
আজকে সেটি শূন্য পড়ে কাঁদে।
সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল
সেই গিয়েছে সবার আগে সরে।
ছোট্ট যে জন ছিল রে সবচেয়ে,
সেই দিয়েছে সকল শূন্য করে।
বহু বাড়ির বহু মানুষের সবকিছু শূন্য হয়ে থাকবে। এই শূন্যতা পূরণ হবে না।
আর আমরা যখন দেখি, আমাদের গর্বের মেট্রোর দুটো স্টেশন ক্ষতিগ্রস্ত, এর বিদ্যুৎ উৎপাদন উপকেন্দ্র পুড়িয়ে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে, মন্ত্রী বলছেন, ক্ষতি এখানেই এক হাজার কোটি টাকা, বহু সরকারি স্থাপনা, গাড়ি ধ্বংসস্তূপ, তখন রাগে-দুঃখে চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করে। ‘এ আমার পাপ, এ তোমার পাপ’। কার পাপ কতটা, সে হিসাব জনতা চাইবে।
কেউ বলছেন, এত আত্মদান বৃথা যাবে না। কেউ বলছেন, এই আন্দোলন থেকে শাসকেরা বড় শিক্ষা পাবে। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না।
সরকার বলছে, এই অগ্নিসন্ত্রাসী, জঙ্গি, সম্পদ ধ্বংসকারীকে আর ছাড় দেওয়া হবে না।
কী হবে, তা কে বলতে পারে। আমরা বলতে পারি, শুভবুদ্ধি যেন বজায় থাকে। লেট গুড সেন্স প্রিভেইল।
এই কদিন একেবারে অ্যানালগ ছিলাম। আবার লোকে হাতে খবরের কাগজ নিয়ে পড়েছে। প্রথম আলো কুড়ি টাকায় বিক্রি হয়েছে। কারও চোখ আর মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে আঠার মতো লেগে ছিল না।
এসএমএস বলতে যে একটা জিনিস ছিল, যার ব্যবহার আমরা ভুলে গিয়েছিলাম, তা আবার চালু হয়ে গিয়েছিল। ২৪ ঘণ্টার দিন যে এত লম্বা, তা আবারও জানা গেল। আর মোবাইল ফোনের চার্জও এতক্ষণ থাকে, তা-ও আমরা নতুন করে আবিষ্কার করলাম।
দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে মানুষ ক্ষুদ্র ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি। কিন্তু সব মিলিয়ে যে বৃহত্তর ক্ষতি হলো, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হলো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ।
গরিব মানুষ কষ্ট পাচ্ছে, বাজারে জিনিসপাতির অগ্নিমূল্য, আর হাসপাতালগুলোতে আহতদের ভিড়।
এই ক্ষত সহজে মুছবে না। জানি না, কত বড় মূল্য এ জন্য দিতে হবে!
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক