ভবিষ্যতে কর্তৃত্ববাদ ঠেকানোর জন্য সংস্কার জরুরি

স্বাধীনতার পর থেকে দেশের জনগণ বারবার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকারগুলোর কর্তৃত্ববাদী রূপান্তর। নব্বই ও চব্বিশে ছাত্র-জনতা জীবন দিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়বদ্ধ রাখতে উদ্ভাবন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিবার ক্ষমতায় এসে সংবিধান বদলে অথবা লঙ্ঘন করে সারা জীবন ক্ষমতায় থাকার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করতে চেয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নের নামে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংসদে আইন পাস করে। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে তিন-তিনটি একতরফা নির্বাচন করে প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় টিকে থাকে।

এবারের গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রাণ দিতে হয়েছে সাড়ে তিন শর বেশি ছাত্র-জনতার। পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ববরণ করেছে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী। প্রাণনাশের তালিকা থেকে বাদ যায়নি শিশুও।

এবার আমরা যদি আগের সরকারগুলোর ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ কার্যক্রমের পুনরাবৃত্তি না চাই, তবে শাসনব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতায় এসে স্বৈরাচারী রূপান্তর ঠেকাতে হলে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন, যার অনেকগুলো আনতে হবে এখনই। এখানে পরিবর্তনের জন্য বেশ কিছু ইস্যু আমি উল্লেখ করেছি, তবে এগুলোই সব নয়।

১. বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানটি মোটামুটিভাবে সুপরিবর্তনীয়, যার ফলে ক্ষমতাসীন দল খুব সহজে সংবিধান পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের সংবিধানটিকেও দুষ্পরিবর্তনীয় করতে হবে।

২. বাংলাদেশ একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দেশ। এ দেশে দুই কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা এখন সময়ের দাবি। একটি কক্ষ হতে হবে পেশাভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচিত এবং আরেকটি জনপ্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচিত। জনপ্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচিত কক্ষে ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের মনোনয়ন লাভের নির্দিষ্ট অনুপাত নির্ধারণ করে দেওয়া প্রয়োজন। পেশাভিত্তিক কক্ষে কৃষক, শ্রমিক, অভিবাসী কর্মীসহ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, সামাজিক বিজ্ঞান গবেষক এবং বৈজ্ঞানিক সবার নির্ধারিত সংখ্যক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। সংবিধান সংশোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংসদের দুটো কক্ষেই পাস হতে হবে।

৩. অনুচ্ছেদ ৭০ সংস্কার করে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে ফ্লোর ক্রস করার সুযোগ ফেরত আনা। নতুন নেতৃত্বের বিকাশে এটি খুবই প্রয়োজনীয়।

৪. প্রধান বিরোধী দলের ছায়া মন্ত্রিসভা থাকা বাধ্যতামূলক করা এবং এ জন্য নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় বাজেট বরাদ্দ রাখা।

৫. মনোনয়ন-বাণিজ্য বন্ধ করতে মাঠপর্যায় থেকে নেতৃত্ব তুলে আনার একটি নির্ধারিত রূপরেখা তৈরি করে তা মানতে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোকে বাধ্য করা।

আরও পড়ুন

৬. সংসদে নারী প্রতিনিধিদের সংরক্ষিত আসন বাতিল করে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে সাধারণ নির্বাচনে ৩০ শতাংশ আসনে নারী প্রার্থী মনোনয়ন প্রদানকে বাধ্যতামূলক করা। একই সঙ্গে সাধারণ সিটগুলো নারীদের নির্বাচনী প্রতিযোগিতার জন্য উন্মুক্ত রাখা।

৭. পরিবারতন্ত্র বন্ধ করার লক্ষ্যে এবং নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টিকে উৎসাহিত করতে, কোনো নেতার অধীনে দল পরাজিত হলে তাঁকে নেমে দাঁড়িয়ে নতুন নেতৃত্বকে জায়গা করে দেওয়া অথবা যেকোনো নেতা পার্লামেন্টে দুবারের বেশি নেতৃত্ব দিতে পারবেন না—এই নিয়ম চালু করা।

৮. পার্লামেন্টারি কমিটিগুলোকে কার্যকর করা এবং বিরোধী দল থেকে পার্লামেন্টারি কমিটির চেয়ার নিযুক্ত করা।

৯. সংবিধানের ৭৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ন্যায়পাল নিয়োগ করা।

১০. আমলাতন্ত্রে ক্ষমতার সার্বিক বিকেন্দ্রীকরণের রূপরেখা প্রণয়ন করা। শহরগুলো পরিচালনায় নগরপিতাদের কার্যপরিধি পুনর্নির্ধারণ করা এবং সে অনুযায়ী বাজেট বরাদ্দ রাখা।

১১. আমলাতন্ত্রে নিয়োগের ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে নৈর্ব্যক্তিক করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার মতো নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণের সিস্টেমটিকে যথাসম্ভব প্রযুক্তিনির্ভর করে ফেলা। শুধু ফলাফলের ভিত্তিতে নিয়োগ দান, অর্থাৎ সাক্ষাৎকার গ্রহণের বর্তমান ব্যবস্থা বাতিল করা।

১২. স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে আইনপ্রণেতাদের কাজ শুধু আইন প্রণয়নের মধ্যেই সীমিত রাখা। নির্বাহী ও উন্নয়ন কার্যক্রমে তাঁদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা।

আরও পড়ুন

১৩. বাংলাদেশের মতো একটি স্বল্প আয়ের দেশে আইনপ্রণেতাদের পেছনে যে বিশাল অর্থ-সম্পদ ব্যয় করা হয়, তা কমিয়ে আনা। বিলাসবহুল সুযোগ-সুবিধা যেমন ট্যাক্সবিহীন গাড়ি ক্রয় ইত্যাদি সুযোগ রহিত করা। এলাকায় খরচের জন্য যে অর্থ প্রদান করা হয়, তা বন্ধ করা।

বিশ্বজনবিদিত নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হওয়ার দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হয়েছেন। সেনাপ্রধানও বিষয়টি ঘোষণা দিয়েছেন।

আমরা আশা করব, তিনি শুধু অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে নয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এমন কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনবেন, যাতে ভবিষ্যতে ক্ষমতা আর কেন্দ্রীভূত করা না যায়।

এ জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সংবিধান নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও আইনের শিক্ষকদের সঙ্গে বসা। ওপরে উপস্থাপিত অনেক প্রস্তাবনা বাস্তবায়নে সংবিধান পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়বে। আমি আশাবাদী যে অধ্যাপক ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী নির্বাচনের আগে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর কাছ থেকে এই পরিবর্তনগুলো সাধনের অঙ্গীকার নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে গ্রহণ করতে পারবে।

  • তাসনীম সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক