রাষ্ট্র সংস্কারে আর ব্যর্থতা নয়, যা করতে হবে

এখন প্রশ্ন হলো, কী সংস্কারের মাধ্যমে এই বৃহৎ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব?ছবি : প্রথম আলো

‘রাষ্ট্র সংস্কার’ বা ‘রাষ্ট্র মেরামত’-এর কাজ চলছে। আজকের বাংলাদেশে এটি একটি বহুলভাবে ব্যবহৃত ও জনপ্রিয় পরিভাষা। তরুণদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রোফাইলে আপনি যদি এক পলক ঢুঁ মারেন, আপনার চোখে এমন অসংখ্য ভিডিও পড়বে, যেখানে লেখা আছে ‘রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত’।

বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের অনেকেই এখন পরিচ্ছন্নতা, ট্রাফিক সিগন্যাল অথবা নিরাপত্তা বিধানের কাজে আছেন। তাঁদের এ কাজের জন্য যাঁদের কোনো সমস্যা হচ্ছে বা হতে পারে, তাঁদের উদ্দেশ্য করেই সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের সদ্য বিজয়ী তরুণদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রোফাইলে শেয়ার করা নতুন বাক্যটি সাধারণভাবে চোখে পড়ছে।

রাষ্ট্র সংস্কার বা রাষ্ট্র মেরামত অনেক কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ। পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখণ্ডে হাজার বছর ধরেই এই রাষ্ট্র সংস্কারের আহ্বান ছিল। ম্যাগনা কার্টা হলো রাষ্ট্র সংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। ১২১৫ সালের ১৫ জুন স্বৈরাচারী ব্রিটিশ রাজা জন সামন্তদের চাপে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, যার প্রধান শর্ত ছিল স্থানীয় প্রতিনিধিদের অনুমতি ছাড়া রাজা নাগরিকের স্বাধীনতা ও সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না।

ম্যাকিয়াভেলির জাতি-রাষ্ট্র তৈরি হওয়ার পর নাগরিকেরা যে সংস্কারের কথা বলেছেন, তাতে ব্যক্তিস্বাধীনতা কেন্দ্রীয় আলোচনায় থাকলেও এর পরিধি আরও অনেক বিস্তৃত। সীমিত স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নাগরিকের প্রতিনিধিত্বের লক্ষ্যে ব্রিটিশ উপনিবেশ সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন সময়ে সংস্কারের দাবি এসেছে।

১৯০৯, ১৯১৯ ও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ভারত নামে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকে বিভিন্ন সময়ে সংস্কার করা হয়েছে। পাকিস্তানি শাসনামলে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ১৯৫৪, সংবিধান প্রণয়ন ১৯৫৬, শিক্ষা আন্দোলন ১৯৬২, ছয় দফা ১৯৬৬ ও ১৯৭০ সালের নির্বাচন কেন্দ্র করে রাষ্ট্র ও সমাজসংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সংবিধান প্রণয়ন ১৯৭২, চতুর্থ সংশোধনী ১৯৭৫, জিয়া ও এরশাদের শাসনামলে বিভিন্ন সাংবিধানিক সংস্কারও রাষ্ট্র সংস্কার ও মেরামতের উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য। এসব উদ্যোগের সব কটিই জনসমর্থিত নয়।

১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থান ও গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বিভিন্ন রাজনৈতিক জোটের ঘোষণায় ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮-এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রকে তথা নাগরিকের স্বাধীনতা ও প্রতিনিধিত্বকে প্রাধান্য দিয়ে সীমিত পর্যায়ে রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলেছে এবং নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। তা ছাড়া সামরিক বাহিনী-সমর্থিত ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বৃহৎ সংস্কারের উদ্যোগও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

যেকোনো সংস্কারের তিনটি দিক থাকে—সংস্কার আনয়ন, সংস্কার বাস্তবায়ন ও সংস্কার বাস্তবায়ন মনিটর করে এর বাস্তব ফলাফল নাগরিকের কাছে পৌঁছানো। নাগরিকের যথার্থ সচেতনতা ও রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ ও দীক্ষা ছাড়া সংস্কার আনয়নে সফল হলেও সংস্কার বাস্তবায়নে এবং বাস্তবায়নের ফলে আনীত ফল তথা পূর্ণ গণতন্ত্র জনগণের কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়বে।

ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত নেওয়া রাষ্ট্র সংস্কারগুলো নাগরিকের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা রক্ষায় এবং বৈষম্যহীন ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ নির্মাণে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থী আন্দোলন ২০২৪-এর নেতা-কর্মীদের আন্দোলনের সময়ের বিভিন্ন ফেস্টুন, ব্যানার বা প্ল্যাকার্ড এবং আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে তাঁদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওয়ালে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটিই প্রাধান্য পাচ্ছে।

তাহলে প্রশ্ন আসে, স্বাধীনতা শব্দটি কীভাবে রাষ্ট্র সংস্কার ও মেরামতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট? উত্তর-আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের চরম কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসনের পতনের আন্দোলনে এবং এই আন্দোলনের সাফল্য পরবর্তী সময়ে তারুণ্যের কণ্ঠে যে সংস্কারের কথা শোনা যাচ্ছে, তা ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সাংবিধানিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, বিচার বিভাগীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কারের বৃহত্তর পরিসরে উত্থাপিত, যার লক্ষ্য এক মানবিক, সমতাভিত্তিক, বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণ। তাই তাঁরা আওয়াজ তুলেছেন ‘আমরা ন্যায়বিচার চাই।’

এখন প্রশ্ন হলো, কী সংস্কারের মাধ্যমে এই বৃহৎ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব? মোটাদাগে বললে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই সংস্কার হলো রাজনৈতিকভাবে সংসদ দ্বিকক্ষ না এক কক্ষ থাকবে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য থাকবে না রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা প্রাধান্য পাবে, এমপি কীভাবে নিজ দলের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন, রাজনৈতিক দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন কি না, কয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হবেন—এসব বিষয়ে সাংবিধানিক সংস্কার। তা ছাড়া রয়েছে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র, আর্থিক হিসাব, নেতা-কর্মী নিয়োগ ও নির্বাচন, দলের নেতার মেয়াদ ইত্যাদি বিষয়ে সংস্কার।

এ ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনকালীন প্রশাসনের আইনি সংস্কার। প্রশাসনিক দিক থেকে এই সংস্কার অনেক চ্যালেঞ্জিং। সরকারি কর্ম কমিশনসহ সব নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কার্যকর সংস্কার, কর্মকর্তাদের বদলি ও প্রমোশন প্রক্রিয়ার জন্য গণতান্ত্রিক নীতি ও কাঠামো তৈরি, নাগরিক সেবার উপযোগী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রশিক্ষণ, নিরপেক্ষ প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল গঠন ইত্যাদি প্রাধান্য পেতে পারে।

বাজেট, ব্যাংক, শেয়ারবাজারসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনগুলো এবং সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কাঠামোরও সংস্কার প্রয়োজন। বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নের নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষ কে হবে, অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে এবং জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন গঠনের রূপ কী হবে, সে বিষয়গুলোয় অভিজ্ঞ লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে।

শিক্ষার্থীদের বৃহৎ সংস্কার আন্দোলনের একটি ঐতিহাসিক দিকও রয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা তৈরি, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দান ও স্বাধীনতার ঘোষকের বিষয়ে ফয়সালা এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারীদের ও মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের খেটে খাওয়া কৃষক, তাঁতি, মজুর, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ এবং সব জাতিগত সংখ্যালঘুদের অবদানের স্বীকৃতিসহ একটি সত্যিকারের ও নির্ভুল ইতিহাস রচনা করা।

আরও পড়ুন

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সংস্কারের বিষয়ে প্রথমেই গুরুত্ব দিতে হবে কার্যকর, গণমুখী, নাগরিক প্রয়োজনের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা ও বাঙালি মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ এবং সব জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধারণ করে এমন সমাজ নির্মাণে একটি সার্বিক সংস্কার।

আজকের বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে যে বৃহৎ সংস্কারের কথা উঠেছে, সেখানে প্রথমেই আলোচনা প্রয়োজন আগের সংস্কার উদ্যোগগুলো কেন ব্যর্থ হয়েছিল প্রশ্নটি। এখানে দেখা যাবে, অনেক উদ্যোগই সংস্কার আনয়নে সফল হয়েছে, কিন্তু সংস্কারের ফলে লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।

এ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা ছিল অংশীজনের সঙ্গে কথা না বলা বা কথা বললেও সংস্কারে তাদের কথার কোনো প্রতিফলন না থাকা। তা ছাড়া অনেক সংস্কারের লক্ষ্য ছিল শাসকের শাসন টিকিয়ে রাখা, যদিও নাগরিকের স্বাধীনতার নামে। সংস্কারের উদ্যোগ ও তার বাস্তবায়নে ধারাবাহিকতার অভাব ও শাসকের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কারের বিষয় পরিবর্তিত হয়ে যাওয়াও লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হওয়ার কারণ।

চূড়ান্তভাবে, ক্ষমতায় যাওয়ার যে প্রক্রিয়া এবং ক্ষমতাকে টেকসই করার যে স্থানীয় কাঠামো, সেখানে আনীত সংস্কারগুলো বাধা হয়ে দাঁড়ানোর কারণে শাসকেরা ওই সব সংস্কারকে বাস্তবায়নে প্রাধান্য দিয়েছে, যেগুলো তাদের নিজেদের ক্ষমতা কাঠামো ধরে রাখার নিমিত্তে সহায়তা করেছে। ফলে রাষ্ট্র সংস্কার ব্যর্থ হয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের উদ্যোগে যে ব্যাপক সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, তার সাফল্যের জন্য ওপর থেকে চাপিয়ে না দিয়ে রাষ্ট্রের সব অংশীজনের অংশগ্রহণ ও মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। তা ছাড়া বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কারের পরিকল্পনা নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে একটি উপায় হতে পারে রাজনৈতিক সংস্কারগুলো প্রাধান্য দিয়ে রাজনীতিকে নাগরিকের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করার রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি করা।

যেকোনো সংস্কারের তিনটি দিক থাকে—সংস্কার আনয়ন, সংস্কার বাস্তবায়ন ও সংস্কার বাস্তবায়ন মনিটর করে এর বাস্তব ফলাফল নাগরিকের কাছে পৌঁছানো। নাগরিকের যথার্থ সচেতনতা ও রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ ও দীক্ষা ছাড়া সংস্কার আনয়নে সফল হলেও সংস্কার বাস্তবায়নে এবং বাস্তবায়নের ফলে আনীত ফল তথা পূর্ণ গণতন্ত্র জনগণের কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়বে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের তাত্ত্বিক কাঠামোর বৈপ্লবিক পরিবর্তনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম গ্যাব্রিয়েল আলমন্ড, যিনি আমেরিকান সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলের সভাপতি ছিলেন।

তিনি মনে করেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে নাগরিক শ্রেণির মধ্যে গণতান্ত্রিক অভিযোজন প্রয়োজন। তবে একটি কার্যকর অভিযোজন তখনই হবে, যখন রাজনৈতিক দলগুলো এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ফলে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ ও দীক্ষা দানের মাধ্যমে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক মনোভঙ্গির নাগরিক সমাজ তৈরি করবে। তবে এর জন্য দীর্ঘ সময় প্রয়োজন।

বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনে এবং আন্দোলন-পরবর্তী রাষ্ট্র গঠনে শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনতার যে শক্তি ও প্রত্যয় দেখছি, তাদের সংস্কারের এই উদ্যোগ সফল হবে—এটা আমি বিশ্বাস করি।

  • কাজী মোহাম্মাদ মাহবুবুর রাহমান
    সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়