ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমবারের মতো জনপ্রিয় ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জিতেছেন। প্রথমবারের মতো যে তরুণ, কৃষ্ণাঙ্গ আর লাতিন ভোট দিয়েছেন, ট্রাম্প তাঁদের মধ্যে ভোট বাড়িয়েছেন। এক লাখ ডলারের নিচে যাঁদের আয়, তাঁদের মধ্যে ট্রাম্পের ভোট বেশি। ধনী ভোটাররা পছন্দ করেছেন কমলা হ্যারিসকে। রিপাবলিকানদের দিকে ভোট বেড়েছে ডেমোক্র্যাটরা ভোট দেওয়ায় বিরত থাকায়। ট্রাম্প ও তাঁর জোট এখন ভারত থেকে হাঙ্গেরি, ইতালি, ফিলিপাইন, আর্জেন্টিনা, নেদারল্যান্ডস ও ইসরায়েল পর্যন্ত অতি ডানপন্থী সরকারগুলোর এক অলিখিত জোটের নেতৃত্ব দেবে।
ডানপন্থী সাফল্যের এই পালা শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে হাঙ্গেরির পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভিক্টর অরবানের বিপুল বিজয়ের মাধ্যমে। এরপর নরেন্দ্র মোদির বিজয় ২০১৪ সালে। একের পর এক এলো হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের প্রথম আগমন, ব্রেক্সিট ভোট এবং ফিলিপাইনে রদ্রিগো দুতার্তের সাফল্য, সব ২০১৬ সালে। দুই বছর পরে ব্রাজিলে এলেন বলসোনারো। অতিমারির পর ইতালিতে ডানপন্থীরা ক্ষমতায় এলেন ২০২২। ২০২৩ সালে হাভিয়ের মিলেই আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণ করেন। এ সময়ের বেশির ভাগ বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি ইসরায়েলকে শাসন করেছে অতি ডানপন্থী দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে। এমনকি যেসব দেশে ডানপন্থীরা ক্ষমতায় নেই—ফ্রান্স ও জার্মানিতে ডানপন্থীরা ক্রমে পাল্লা ভারী করছে।
কেন ডানপন্থীদের বিজয়ের রথ এগিয়েই যাচ্ছে? প্রচলিত এই ধারণা জনপ্রিয় যে অর্থনৈতিকভাবে যারা বঞ্চিত, তারাই অতি ডানপন্থীদের ভোট দেয়। এ কি কেবল অর্থনীতির কারণেই?
এর মধ্যে সত্য যে নেই এমন নয়। ২০১৪ সালে ট্রাম্প ভোটারদের মধ্যে অর্থনীতির অবস্থার অন্যতম ফ্যাক্টর ছিল। মহামারির আগের তুলনায় দ্রব্যমূল্য এখন ২০ শতাংশ বেশি। খাদ্যের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে ২৮ শতাংশ । গৃহস্থালি ঋণ মানুষের কাছে এক বড় মাথাব্যথার কারণ ছিল। ফলে বেশির ভাগ মানুষ ইতিবাচক পরিসংখ্যান বিশ্বাস করেনি।
তবুও এই আখ্যান কেবল উপরের স্তরের কথা বলছে। প্রথমত, প্রমাণ আছে যে মানুষ সব সময় পকেটের দিকে তাকিয়ে ভোট দেয় না। ২০ শতক থেকে বর্তমান পর্যন্ত গবেষণায় থেকে দেখা যায় যে অর্থনৈতিক স্বার্থ দিয়ে ভোটারদের আচরণ ব্যাখ্যা করলে খুব ভালো ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। অর্থনীতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সামগ্রিকভাবে ভালো থাকার মানদণ্ড হিসেবে একমাত্র নয়। লোকেরা সমাজকে কীভাবে দেখেন, তার ওপর নির্ভর করে তাঁদের ব্যক্তিগত অবস্থান।
ব্যক্তিগত বিপত্তি তখনই রাজনীতির বিষয় হয়, যখন তা বৃহত্তর কোনো সংকটের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দ্বিতীয়ত, যদিও অতি ডানপন্থীরা শ্রমিক শ্রেণির কিছু সমর্থন ছাড়া জিতবে না; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ভারত ও ফিলিপাইনে তারা জিতেছে মধ্যবিত্তের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে। এ ছাড়া সমাজের সবচেয়ে দরিদ্ররা সাধারণত ডানপন্থীদের বার্তার প্রতি খুব বেশি সাড়া দেয়— এমন দেখা যায় না। তৃতীয়ত, বস্তুগত দিক থেকে আজকের অতি ডানপন্থীদের অর্থনৈতিক প্রস্তাবনা উদারদের চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন কিছু নয়।
প্রমাণ আছে যে মানুষ সব সময় পকেটের দিকে তাকিয়ে ভোট দেয় না। গবেষণায় থেকে দেখা যায় যে অর্থনৈতিক স্বার্থ দিয়ে ভোটারদের আচরণ ব্যাখ্যা করলে খুব ভালো ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না।
ভারতে গড় ভোক্তা ব্যয় কমে যাওয়ার পরে মোদি ২০১৯ সালে আবার নির্বাচিত হন। ফিলিপাইনে দরিদ্রের সংখ্যা সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পরও দুতের্তের উত্তরসূরি ২০২২ সালে ৫৮ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। আগের তুলনায় যা ২০ ভাগ বেশি। পূর্বসূরির তুলনায় ট্রাম্পের অধীন গড় আয় তার আরও ধীরে। তবুও তিনি ২০২০ সালে আগের তুলনায় এক কোটি ভোট বেশি পেয়েছেন। পকেটের দিকে তাকিয়ে যদি মানুষ তাঁদের ভোট দেন, তবে কেন অনেক শ্রমজীবী আমেরিকান সেই প্রার্থীকে ভোট দিলেন যে ধনীদের কর মাফ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়?
অর্থনৈতিক দুর্দশার প্রভাব রাজনীতিতে পড়ে। অর্থনৈতিক ধাক্কা সমাজে বিদ্যমান মানসিক ভাবনার প্রবাহের মধ্য দিয়ে আসে। মধ্যবিত্ত এবং সচ্ছল খেটে খাওয়া মানুষ নিজেকে ধনীদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন। অপছন্দ করেন দরিদ্র ও অভিবাসীদের, যাঁদের তাঁরা মনে করেন নিজের জন্য হুমকি হিসেবে।’
আজকের অতি ডানপন্থীরা ভিন্ন কৌশল নিয়েছেন। এখানে বাস্তব বিপর্যয় প্রতিস্থাপিত হয়ে যায় কাল্পনিক বিপর্যয়ের সঙ্গে। ট্রাম্প যখন সতর্ক করেন যে ‘কমিউনিস্ট’রা আমেরিকা দখল করে ফেলবেন, তখন তা বাস্তব অন্যায়ের বিরোধিতা করার আহ্বানের চেয়ে বেশি কাজে দেয়। যাঁরা শ্রেণি, জাতি ও লিঙ্গের মতো সামাজিক স্তরবিন্যাসকে মোকাবিলা করতে চান, ট্রাম্পের ভোটাররা তাঁদেরকেই নিজের জন্য হুমকি মনে করেন।
এই কৌশল নির্বাচনের চেয়ে গভীর। দিল্লি, পশ্চিম তীর ও যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তি প্রতিবাদকারীদের শায়েস্তা করার হার বেড়েছে। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারের প্রতিবাদকারীদের ওপর আক্রমণ সে কথাই বলছে। বর্ণবাদের দাঙ্গায় কেঁপে উঠেছে ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ড। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ট্রাম্প–সমর্থকদের ক্যাপিটলে হামলা এবং ব্রাজিলে লুলার ক্ষমতায় যোগদানকে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে অবরোধের মতো ঘটনা এখন সাধারণ হয়ে গেছে।
বিশ্বব্যাপী সহিংসতা এক সামাজিক ব্যাধির মতো সংক্রামক হয়ে উঠেছে। ডানপন্থীরা এখন বড় কোনো সহিংস ঘটনা ঘটায় না। মোদির ক্ষমতার উত্থান শুরু হয়েছিল তাঁর নিজ রাজ্য গুজরাটে মুসলিমবিরোধী গণহত্যার মাধ্যমে। ট্রাম্পের ২০২০ প্রচারাভিযান বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতা দিয়ে উদ্দীপনা পেয়েছে। মারাত্মক সহিংসতার মধ্য দিয়ে ২০ শতাংশ ভোটে পিছিয়ে থেকেও প্রায় জিতে গিয়েছিলেন বলসোনারো ।
অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে পারলে এসব ঘটনা কিছুটা কমবে। ডেভিড ব্রুকস নিউইয়র্ক টাইমস-এ স্বীকার করেছেন, কমলা হ্যারিসের কৌশল কাজ করেনি, ডেমোক্র্যাটদের উচিত বার্নি স্যান্ডার্স কৌশল গ্রহণ করা।
মানুষের আকাঙ্ক্ষা করার মতো কিছু দরকার। দরকার উত্তেজনা পাওয়ার মতো কিছু। এমন ভাবনা থেকেই বার্নি স্যান্ডার্সের প্রচারণা এবং ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারের পরে এক নতুন অনুপ্রেরণা জেগে উঠেছিল। উদারপন্থীদের যতটা ক্ষয় হয়েছে, ডানপন্থীদের বিস্তারও ঘটেছে সেই অনুপাতেই।
রিচার্ড সেমুর, লেখক এবং সালভেজের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন