নয়াদিল্লিতে জি-২০ সম্মেলনের পর ভিয়েতনামের হ্যানয়ে সফল সফর শেষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ওয়াশিংটনে ফিরে এসেছেন।
ভিয়েতনামে তাঁর এ সফরের সময় আধা ডজনের মতো বিনিয়োগ চুক্তি হয়েছে। এতে দুই পক্ষই লাভবান হবে। কিন্তু এ সফরে যেটা সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে, তা হলো যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট সরকারের সঙ্গে ‘সমন্বিত কৌশলগত অংশীদারত্বের’ ঘোষণা দিয়েছে। চীন, রাশিয়া, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ভিয়েতনামের কৌশলগত অংশীদারত্ব আগে থেকেই রয়েছে।
ভিয়েতনামের সঙ্গে সম্পর্ক পরবর্তী ধাপে উন্নীত করার ইঙ্গিত দেন বাইডেন। বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-ভিয়েতনামের সম্পর্ক ‘নতুন স্তরে’ প্রবেশ করেছে।
একটি বিষয়ে সন্দেহ নেই, কয়েক দশক আগের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র-ভিয়েতনামের সম্পর্কে অনেক বেশি অগ্রগতি এসেছে। কিন্তু এশিয়ার প্রতি ওয়াশিংটনের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো সেই পুরোনো ফাঁদেই পড়ে রয়েছে।
এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলাফল কী? এই দৃষ্টিভঙ্গি অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর ঝুঁকি তৈরি করছে। যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম ও বিশ্বকে ভুগতে হতে পারে এর জন্য।
৫০ বছর আগে ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের চারজন প্রেসিডেন্ট ভিয়েতনাম সফর করলেন। প্রথমটার ক্ষেত্রে আমি সফরসঙ্গী ছিলাম। যুদ্ধ-পরবর্তী সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পদক্ষেপ হিসেবে ২০০০ সালের নভেম্বরে বিল ক্লিনটন হ্যানয় সফর করেন।
২০ বছরের যুদ্ধে বিধ্বস্ত ভিয়েতনাম থেকে কলঙ্কজনকভাবে সরে আসার পর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল। ক্লিনটনের সফরের মধ্য দিয়ে ২৩ বছর ধরে ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের যে ধারাবাহিকতা, তারই সূত্রপাত করেছিল।
বাইডেন প্রশাসন ২০১৫ সালে প্রণীত ব্ল্যাকওয়েলেরে সেই নীলনকশা বাস্তবায়ন করছে। এ কারণেই কৌশলগত দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভিয়েতনাম গুরুত্বপূর্ণ। ‘কৌশলগত প্রতিযোগিতা’—এ ধরনের শব্দ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ৭০ বছরের আগের সময়ে ফিরে যাচ্ছে। কমিউনিস্টদের অভিলাষ ব্যর্থ করে দিতে গিয়ে ৭০ বছর আগে আনাড়ির মতো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সর্বশেষ সফরটি ছিল এ প্রেক্ষাপট থেকে অনেক বেশি ভিন্ন। এ সফরের উদ্দেশ্য যতটা ভিয়েতনাম, তার চেয়ে অনেক বেশি দেশটির উত্তর দিকের অতিকায় প্রতিবেশী চীন। ব্যাপারটি যদি চীন–সম্পর্কিত না হতো, তাহলে বাইডেন হ্যানয় সফরে যেতেন কি না, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
ভিয়েতনাম ঘিরে আমেরিকার এই সর্বশেষ তৎপরতা দেখে কেউই গত ৭০ বছরের ইতিহাসকে উপেক্ষা করে থাকতে পারে না। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ফ্রান্সের উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ওই অঞ্চলে প্রথম নিজেদের পা রাখে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামে কট্টর কমিউনিস্টবিরোধী সরকারকে নিজেদের পাখার ছায়ায় নিয়ে আসে।
১৯৫০-এর দশকের সেই দিনগুলোতে ‘লাল চীনের হুমকি’, আরও বড় প্রেক্ষাপটে কমিউনিস্ট–ভীতি থেকে উদ্দীপনা খুঁজে পেত যুক্তরাষ্ট্র। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা জোসেফ স্তালিন সবে তখন মারা (১৯৫৩ সাল) গেছেন। বেইজিংয়ে মাও সে–তুংয়ের রাজত্ব চার বছরে পড়েছে। মাও সে–তুং ‘লাল প্রাচ্যের’ ঘোষণা দিয়েছেন।
ভবিষ্যৎটা ছিল অনিশ্চিত। কমিউনিজমের অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল। বলা হচ্ছিল, হ্যানয় থেকে জাকার্তা—দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কমিউনিজমের বৃত্তে ঢুকে পড়বে। এই পরিবর্তনকে কেবল ঠেকাতে পারে ‘মুক্ত বিশ্বের’ ‘অগ্রসর শক্তি’।
সাত দশক পর বিশ্বের অগ্রসর শক্তি আমেরিকা এশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধ করছে না? কিন্তু সেই একই ধরনের ভাষা ব্যবহারের ঘটনা এখন মার্কিন কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। এটিকে তারা বলছেন, নতুন শীতল যুদ্ধ।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) ওপর গঠিত মার্কিন আইনসভার একটি বাছাই কমিটি বলেছে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি একুশ শতকে ‘মৌলিক স্বাধীনতার’ ওপর যে ‘অস্তিত্বগত’ হুমকি তৈরি করেছে, সেটা অনুসন্ধানে কঠোর পরিশ্রম করছে তারা।
এ ধরনের বিপজ্জনক ভাষা ব্যবহারের প্রকৃত মানে কী? বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান, তাতে কি হুমকি তৈরি করছে চীন? এর মানে কি বিশ্বে কেবল একটাই পরাশক্তির প্রয়োজন?
২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কূটনীতিক ও হার্ভার্ডের অধ্যাপক রবার্ট ব্ল্যাকওয়েল একটি নীতিপত্র লেখেন। এখন এশিয়ায় আমেরিকানরা যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার ভিত্তি সেই লেখা।
লেখাটির শুরু হয়েছে এই প্রস্তাবনা দিয়ে, ‘যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই অব্যাহতভাবে মহাকৌশল অনুসরণ করে যেতে হবে, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর আধিপত্য অর্জন এবং সেটা ধরে রাখার ব্যাপারে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে হবে। প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী উত্তর আমেরিকা মহাদেশ, এরপর পশ্চিমা পরিসর ও শেষে বৈশ্বিক পরিসর।’
ব্ল্যাকওয়েলের নীতিপত্রটিতে এ যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই তার ‘পদ্ধতিগত শ্রেষ্ঠত্ব’ সুরক্ষিত রাখতে হবে এবং এশিয়ায় তারা সেটা কীভাবে করবে, তা নির্ধারণ করতে হবে।
এই নীতিপত্রে এ ধারণা বজায় রাখা হয়েছে যে চীন ‘দায়িত্বশীল অংশীজন’ বলে বিবেচিত হতে পারে না। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তাদের নিজেদের মহাকৌশলে চীনা সমাজ ও তাদের সীমানার বাইরেও চীন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর পথ খুঁজছে। প্রান্তের দেশগুলোকে বশ্যতা মানাতে , আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রকে এটা অবশ্যই নিশ্চিতভাবে জানিয়ে দিতে হবে যে এশিয়ায় চীন মুক্তভাবে রাজত্ব করতে পারে না।
বাইডেন প্রশাসন ২০১৫ সালে প্রণীত ব্ল্যাকওয়েলেরে সেই নীলনকশা বাস্তবায়ন করছে। এ কারণেই কৌশলগত দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভিয়েতনাম গুরুত্বপূর্ণ। ‘কৌশলগত প্রতিযোগিতা’—এ ধরনের শব্দ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ৭০ বছরের আগের সময়ে ফিরে যাচ্ছে। কমিউনিস্টদের অভিলাষ ব্যর্থ করে দিতে গিয়ে ৭০ বছর আগে আনাড়ির মতো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
ওয়াশিংটন কিছু প্রশ্ন নিজেদের খুব কম ক্ষেত্রেই করে। কেন যুক্তরাষ্ট্রকে একমাত্র পরাশক্তি হতে হবে? চীনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করার কাজ তাদের কে দিয়েছে? যুক্তরাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা কি বাস্তবসম্মত? বিশ্বের কতটা অংশ যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য দেখতে চায়? আন্তর্জাতিক ইস্যুতে বহুপক্ষীয় অবস্থান এবং বহুমেরুর বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা কি বৃহত্তর অর্থে শান্তি ও স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা দেয় না?
আবারও ভিয়েতনাম ও অন্যান্য দেশকে আমেরিকা পরাশক্তির রাজনীতির মধ্যে টেনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। কিন্তু ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে ভালো সংবাদটা হলো তারা এখন অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই শক্তিশালী। দুই পক্ষের টানাটানির মধ্যে নিজেদের নিজেরাই সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম।
জিম লরি লেখক ও সম্প্রচারকর্মী
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত