উদ্ভিদনৈরাজ্য নয়, পরিকল্পিত বৃক্ষায়ণ চাই

ঢাকার একটি সবুজ অঞ্চল ধানমন্ডি লেকছবি: প্রথম আলো

রাজধানী শহর হিসেবে ঢাকা একটি পরিকল্পিত পুষ্প-বৃক্ষের শহর হবে। তাতে ছয় ঋতুর মনোমুগ্ধকর উপস্থাপনা থাকবে। এই প্রত্যাশা আমাদের দীর্ঘদিনের। অনেকটা দেরিতে হলেও পরিকল্পনা করেই কাজটি শুরু করেছিলেন উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আনিসুল হক। কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে কাজটি হঠাৎ করেই থেমে যায়। তবু আমরা আশা হারাই না। সংবাদমাধ্যমে লিখে, বলে সিটি করপোরেশনের কাছে আমাদের প্রত্যাশা জিইয়ে রাখি।

২০২৩ সালে অনেকটা আকস্মিকভাবেই উত্তর সিটি করপোরেশন বিভিন্ন সড়কে বৃক্ষরোপণ শুরু করল। কিছুদিন পর কয়েকটি সড়কে গভীরভাবে মনোনিবেশ করে রীতিমতো বিপন্ন বোধ করি! নিশ্চিত হই যে এমন একটি বিশেষায়িত কাজের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কেউ জড়িত নেই। 

এই বৃক্ষরোপণ এতটাই বিশৃঙ্খল, বিক্ষিপ্ত ও অপরিকল্পিত যে এক সময় এসব উদ্ভিদ নগরবাসীর জন্য আশীর্বাদ না হয়ে বরং অভিশাপ হয়ে উঠবে। কারণ, বৃক্ষরোপণে এখানে বিশেষায়িত কোনো জ্ঞান কাজে লাগানো হয়নি। বড় গাছের সঙ্গে লাগানো হয়েছে মাঝারি বা ছোট গাছ, কোথাও কোথাও গুল্ম।

প্রজাতি নির্বাচনে ছয় ঋতুর কোনো বিন্যাস নেই। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদবৈচিত্র্যসম্পন্ন একটি দেশে এমনটা না থাকা রীতিমতো অপরাধ। প্রধান সড়কগুলোয় প্রজাতিগত ইউনিফর্ম রাখা হয়নি। পলাশের সঙ্গে কাঠবাদাম, ছাতিমের পাশে বকুল, টগরের পাশে শিমুল—এমনই বেহাল করা হয়েছে সড়কগুলোয়। একটি ছাতিমগাছ কতটা উঁচু ও চওড়া হতে পারে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই তাদের? সরু ফুটপাতে হাজার হাজার ছাতিম আর কাঠবাদাম লাগানো হয়েছে।

অধিকাংশ গাছের ওপরেই বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। ডালগুলো ইতিমধ্যে সড়কের ওপর চলে এসেছে। তাতে গাড়ি চলাচল কি স্বাভাবিক থাকবে? আবার কোথাও কোথাও না বুঝেই লাগানো হয়েছে রসকাউগাছ। এটা নাকি ফলের গাছ! বোঝা গেল, কাউফল আর রসকাউ নিয়ে মহা তালগোল পাকিয়েছেন তাঁরা! কত বড় সব পণ্ডিত!

বিক্ষিপ্ত মনে প্রশ্ন জাগল, কারা এই আজগুবি বৃক্ষায়ণের মহাপরিকল্পক! আবার বাস্তবায়নই বা করছে কারা? নিজ তাগিদে বিষয়টি অনুসন্ধান করি। একপর্যায়ে উত্তর সিটি করপোরেশনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানালেন, কাজটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বৃক্ষরোপণ–সংক্রান্ত একটি হ্যান্ডবুকের আলোকে। জোগাড় করা হলো সেই হ্যান্ডবুক। হ্যান্ডবুকটি পড়ে খুবই অসহায় বোধ করি। আহা, মস্তিষ্কে কতটা পচন ধরলে একটি রাজধানী শহরের ভাগ্যে এমন অপেশাদার ফালতু একটি নির্দেশিকা জোটে? যার কোনো মাথামুণ্ডু বোঝার উপায় নেই।

হ্যান্ডবুকটিতে কয়েকজন পরামর্শকের নাম এবং ছবি আছে। এমন একটি বৃহৎ কর্মপরিকল্পনায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁরা কতটা উপযুক্ত, কাজের ধরন দেখে সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তা ছাড়া এ ধরনের কর্মযজ্ঞে আরও বিষয়-বিশেষজ্ঞ সম্পৃক্ত থাকা সমীচীন ছিল। নেই কোনো বন্য প্রাণিবিশেষজ্ঞও। কারণ, এটা একক কোনো কাজ নয়, বিষয়-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কেবল এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল অর্জিত হতে পারে। যার কোনো বিকল্পই নেই। এমন একটি বিশেষায়িত কাজের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে রীতিমতো টিমওয়ার্ক প্রয়োজন। এই বৃক্ষায়ণের ক্ষেত্রে যার ছিটেফোঁটাও লক্ষ করা যায়নি।

এই হ্যান্ডবুকটিকে ইতিহাসের খারাপতম একটি নির্দেশিকাপত্র হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। যার পাতায় পাতায় রয়েছে নানান ভুল ও অসংগতি। একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই গোটা প্রক্রিয়াকে অপেশাদার ও অবৈজ্ঞানিক মনে হবে। তা ছাড়া পুস্তিকা প্রণয়নের আগে মাঠপর্যায়ে এলাকাভিত্তিক কোনো জরিপ করা হয়নি। ছয় ঋতুর বিন্যাস কীভাবে হবে, সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। গাছ রোপণের ক্ষেত্রে ক্যানপি, বিস্তৃতি, পরিমাপ ইত্যাদি হিসাব করা হয়নি। গাছ নির্বাচনেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বড় ধরনের অসংগতি লক্ষ করা যায়। যেমন রসকাউ আর কাউফল এক নয়। তুলসী, গাঁদা, নয়নতারা, কালোমেঘ বর্ষজীবী বীরুৎ—এ গাছগুলো প্রতিবছরই নতুন করে লাগাতে হবে। পুত্রঞ্জীব সড়ক বিভাজকের জন্য মোটেও আদর্শ নয়। 

বিদেশি বৃক্ষ অ্যাকাশিয়া বা সোনাঝুরি কোনোভাবেই নগর বৃক্ষায়ণের জন্য বিবেচিত হতে পারে না। এই ফুলের পরাগরেণু অ্যাজমা রোগীদের শ্বাসকষ্ট বাড়ায়। সাদা গজারি মানে কী গাছ? কোথায় পাওয়া যাবে এই গাছের চারা? কেন এই গাছ নগরে লাগানো প্রয়োজন?

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ২০২৩ সালের শুরুতে ডিএনসিসির ১৯তম বোর্ড সভা বৃক্ষরোপণের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটি চুক্তি অনুমোদন করে। ওই চুক্তির আওতায় উত্তর সিটিতে সবুজায়ন এবং পরিবেশ উন্নয়নে নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে প্রতিষ্ঠানটি। পরে সবুজায়ন–সংক্রান্ত আরও একটি প্রকল্প দেওয়া হয় শক্তি প্রতিষ্ঠানটিকে। এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী পরিচালক সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের আত্মীয়। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত আছেন তাঁর আরও ঘনিষ্ঠ কয়েকজন আত্মীয়। যাকে রীতিমতো সংঘবদ্ধ পারিবারিক দুর্নীতি বলা যেতে পারে! সবুজায়নের নামে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ এমনভাবে লোপাট করে নাগরিকদের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করা যায়? 

একটি রাজধানী শহরে এমন বাস্তবতাবিবর্জিত, প্রহসনমূলক ও লুটপাটসর্বস্ব বৃক্ষায়ণের নেপথ্য কুশীলবদের নাম এখন সবারই জানা। তাঁদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনা দরকার। শাস্তিটা এমন হওয়া উচিত, যা ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। অবিলম্বে এই নৈরাজ্যমূলক, অপরিকল্পিত ও লোকদেখানো বৃক্ষায়ণ বন্ধ করা উচিত। পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে রাজধানীসহ সারা দেশে বৃক্ষায়ণের জন্য একটি সুচিন্তিত বৃহৎ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত, যা আমাদের জন্য কল্যাণকর হবে।

মোকারম হোসেন উদ্ভিদ, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক। সাধারণ সম্পাদক, তরুপল্লব

[email protected]