সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল এক ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, আদালতের মধ্যেই কয়েকজন আইনজীবী একজন বিচারককে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছেন এবং তাঁকে এজলাস থেকে নেমে যাওয়ার জন্য বলছেন। আদালতের এজলাসে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, ভিডিও ফুটেজটি না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এ ঘটনাকে শুধু কয়েকজন আইনজীবী এবং বিচারকের মধ্যে বিরোধ বা ‘ভুল-বোঝাবুঝি’ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি সার্বিকভাবে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করেছে।
ঘটনাটি ঘটেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জজ আদালতে এবং এর সূত্রপাত গত ১ ডিসেম্বর। শীতকালীন ছুটির আগে সেদিন ছিল আদালতের শেষ কার্যদিবস। ওই দিন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মোহাম্মদ ফারুকের আদালতে কয়েকজন আইনজীবী বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কয়েকটি মামলা দাখিল করেন। কিন্তু দাখিলে বিলম্ব হওয়ার কারণে ওই আদালতের বিচারক মামলাগুলো গ্রহণ করেননি। আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মামলাগুলো নেওয়ার অনুরোধ করলেও বিচারক তা শোনেননি। পরে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বিচারককে মামলা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তখন বিচারক তাঁদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও আইনজীবীদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
আদালতে মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে কখনো কখনো আইনজীবীদের সঙ্গে বিচারকের ‘মতভিন্নতা’ হতেই পারে। তাই বলে কোনো বিচারক আইনজীবীদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করতে পারেন না।
২৬ ডিসেম্বর জেলা আইনজীবী সমিতির কার্যকরী পরিষদের সভা হয়। সভায় ১ জানুয়ারি থেকে মোহাম্মদ ফারুকের আদালত বর্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর ২ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর এজলাসে ওই গালাগালি ও অশালীন আচরণের ঘটনা ঘটে। ৪ জানুয়ারি আইনজীবী ও বিচার বিভাগীয় কর্মচারীদের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে স্থবির হয়ে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জজ আদালত। বিচারকের সঙ্গে আইনজীবীদের অসৌজন্যমূলক আচরণ, বিচারিক কাজে হস্তক্ষেপ, কর্মচারীদের মারধর, মুঠোফোন ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগে আদালতের কর্মচারীরা কর্মবিরতি পালন করেন। কর্মবিরতির প্রতিবাদে জেলা আইনজীবী সমিতির নেতা ও সদস্যরা আদালত চত্বরে মিছিল করেন। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির কারণে ওই দিন দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কোনো আদালতেই বিচারিক কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়নি। এতে ১০ থেকে ১৫ হাজার বিচারপ্রার্থী সেবা বঞ্চিত হন।
গালাগালি ও অশালীন আচরণের ঘটনায় আইনজীবীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন বিচারক মোহাম্মদ ফারুক। ৫ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি, সম্পাদকসহ তিন আইনজীবীর প্রতি আদালত অবমাননার রুল দেন হাইকোর্ট। রুলে তিন আইনজীবীর বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননার কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। একই সঙ্গে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে তিন আইনজীবীকে ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্টে হাজির হতে বলা হয়েছে।
হাইকোর্টের তলব পাওয়ার পর আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর ভূঁইয়া বলেন, তিনি বিচারককে গালিগালাজ করেননি। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি সম্পাদনা করা হয়েছে। অপর দিকে বিচারক মোহাম্মদ ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, এজলাসে অকথ্য গালিগালাজের ঘটনায় তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও মর্মাহত। বিচারককে এজলাস থেকে নামতে বাধ্য করা সংবিধান ও আইনের লঙ্ঘন। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, হাইকোর্ট থেকে তলব পাওয়ার আগপর্যন্ত গালিগালাজের বিষয়টি অস্বীকার করেননি তানভীর ভূঁইয়া।
আদালতে মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে কখনো কখনো আইনজীবীদের সঙ্গে বিচারকের ‘মতভিন্নতা’ হতেই পারে। তাই বলে কোনো বিচারক আইনজীবীদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করতে পারেন না। ওই বিচারক তেমন কিছু করে থাকলে বিচার বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তা আমলে নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আদালতের ভেতরে আইনজীবীরা যেভাবে বিচারককে গালিগালাজ ও তাঁর সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করলেন, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আইনজীবী সমিতির সভাপতি, যিনি আবার ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতাও বটে, ভিডিও ফুটেজে তাঁর আচরণ ও কথাবার্তা দেখে মনে হতে পারে, ‘জোর যার মুল্লুক তার’।
আমরা আরও অবাক হই, এজলাসের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। তাঁরা গোটা বিষয়টি চেয়ে চেয়ে দেখছিলেন। পুলিশের কাছে বিচারক সহায়তা চেয়েও পাননি। তাহলে এখানে বিচারকের নিরাপত্তা কোথায়?
নানা কারণে বিচার বিভাগ ও আদালতের প্রতি দেশের মানুষের আস্থা ও ভরসা দিন দিন কমছে। এই আস্থা ও ভরসা ফিরিয়ে আনতে বিচারক ও আইনজীবীদের ইতিবাচক ভূমিকা রাখা উচিত। কিন্তু বিচারক ও আইনজীবীরা যদি নিজেরাই বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন, সে আশার গুড়ে বালি। সারা দেশের মতো আদালতও যদি ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে চলে, সেটা বিচার বিভাগের ভাবমূর্তির জন্য খুবই আশঙ্কার বিষয়।
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক