হামাস ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে অনেক নতুন হিসাব-নিকাশ সামনে নিয়ে এসেছে। এবারই প্রথম আক্রমণ করেছে হামাস। এর আগে কোনো না কোনো ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় হামলা চালিয়েছিল। সন্দেহ নেই, হামাস কৌশলগত ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। হামাসের এ দক্ষতা ছিল ধারণারও বাইরে। হামাসের হঠাৎ উত্থান নিয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ হচ্ছে।
চলমান যুদ্ধ দিয়ে ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলন বা প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্ব এখন হামাসের হাতে। ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) বা ফাতাহ আন্দোলনসহ অন্যান্য সংগঠনকে পেছনে ফেলে হামাস ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তকমা পাওয়া, বিভিন্ন দেশে ব্যাংক হিসাব জব্দ হয়ে যাওয়া, গাজা অবরুদ্ধ করে রাখা, ইসরায়েলের হামলা, গুপ্তহত্যা—কোনো কিছুই হামাসকে আটকে রাখতে পারেনি।
হামাসের সাম্প্রতিক সফলতা ও উত্থান ফাতাহ আন্দোলন এবং পিএলওর অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। চলমান যুদ্ধে ফাতাহর কোনো ভূমিকা নেই। একরকম অনুপস্থিতই বলা যায়। হামাসের আক্রমণ বা ইসরায়েলের পাল্টা হামলার পর ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এক বিবৃতিতে বলেছেন, আত্মরক্ষার অধিকার ফিলিস্তিনিদের আছে।
পিএলও বলেছে, হামাসের হামলা হচ্ছে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া। পিএ বা পিএলওর পক্ষ থেকে এর বেশি কিছু শোনা যায়নি। যদিও মনে হতে পারে, চলমান যুদ্ধ হামাস ও ফাতাহের মধ্য ঐক্য স্থাপন করতে পারে। কিন্তু হামাসের সাফল্য ফাতাহ বা পিএলও নেতাদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
সম্প্রতি ফিলিস্তিনিদের মধ্যে হামাসের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্যালেস্টাইন সেন্টার ফর পলিসি অ্যান্ড সার্ভে সেপ্টেম্বরে জনমত জরিপ করেছে। এতে দেখা যায়, ৫৩ শতাংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই ফিলিস্তিনের মুক্তি অর্জন করা সম্ভব। কারণ, পিএলও আলোচনার মাধ্যমে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে পারেনি। ফলে ফিলিস্তিনিরা স্বভাবতই যুদ্ধের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন এবং ফাতাহকে পরিত্যাগ করছেন।
এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে গাজা ও পশ্চিম তীর উভয় জায়গাতেই ইসমাইল হানিয়া বেশি ভোট পাবেন মাহমুদ আব্বাসের থেকে। পশ্চিম তীরে হামাসের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। হামাসের গত শনিবারের হামলা পশ্চিম তীরের মানুষদের আরও উজ্জীবিত করবে। পশ্চিম তীরের বিভিন্ন শহরে হামাসের পক্ষে মিছিল হয়েছে। পশ্চিম তীরের অধিবাসীরা হামাসকে সমর্থন দিয়েছে।
পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, পশ্চিম তীরে পিএলও নিয়ন্ত্রণ হারাবে। কারণ, ফাতাহ বা পিএলও চলমান যুদ্ধের পক্ষে শক্তিশালী অবস্থান নেয়নি। তাদের পক্ষে এ যুদ্ধে যোগ দেওয়া সম্ভবও নয়। ইসরায়েলের সঙ্গে নানাবিধ সুবিধার বিনিময়ে চুক্তি করে ফাহাত বা পিএলও তাদের শক্তি, গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা—সবই হারিয়ে এখন ধুঁকছে।
প্রকৃতি শূন্যতা মেনে নেয় না। কেউ কার্যকারিতা হারালে বা ব্যর্থ হলে অন্য কেউ এসে শূন্যতা পূরণ করে। ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনে একসময় পিএলও সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছে। এই পিএলও ইয়াসির আরাফাতকে সারা বিশ্বে পরিচিতি দিয়েছে। পিএলওর ডাকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক তরুণ যুবকেরা সাড়া দিয়ে ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনে যোগ দিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। আমাদের দেশ থেকেও অনেকেই ফিলিস্তিনে গিয়ে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পিএলও নিজেদের আপসহীন চরিত্র বজায় রাখতে পারেনি।
ইউরোপ-আমেরিকার মধ্যস্থতায় ইয়াসির আরাফাত ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পন্ন করেছেন। এসব শান্তিচুক্তি সম্পাদনে কতটা পশ্চিমাদের চাপ ছিল, আর কতটা ইয়াসির আরাফাতদের সমঝোতা ছিল, তা নিয়ে দীর্ঘ তর্ক হতে পারে। কিন্তু তথাকথিত এসব শান্তিচুক্তি ফিলিস্তিনের জন্য শান্তি আনতে পারেনি; যদিও ইয়াসির আরাফাত শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন ইসরায়েলের সিমন পেরেজ ও আইজাক রবিনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে। ওই শান্তিচুক্তির পরও পদে পদে ফিলিস্তিনিরা নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয়েছেন।
পবিত্র আল-আকসা মসজিদে ঢুকে ইসরায়েলিরা হামলা করেছেন। দিন দিন বসতির সংখ্যা বাড়িয়েছেন। ফিলিস্তিনের ঘর-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছেন।
মূলত পিএলওর অবস্থান পরিবর্তন ও ব্যর্থতাই হামাসের পথ করে দিয়েছে। হামাসের সঙ্গে ফাতাহ ও পিএলওর সম্পর্ক কখনোই ভালো ছিল না। পিএলও নিজেদের উদারপন্থী বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। অপর দিক হামাস ইসলামপন্থী সংগঠন। কিন্তু পিএলও যেখানে ইসরায়েলিদের সঙ্গে সমঝোতা করেছে, সেখানে হামাস লক্ষ্যে অবিচল ছিল।
এসব কারণে পিএলওর সঙ্গে কখনোই হামাসের সম্পর্ক উষ্ণ সম্পর্কে গড়ে ওঠেনি। বরং পিএলও বা ফাতাহ নানাভাবে হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছে। ১৯৯৩ সালে অসলো শান্তিচুক্তির পর ফাতাহ হামাসের ওপর দমন নির্যাতন শুরু করে। এমনকি হামাসের সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলোর পিএলও বন্ধ করে দেয়। ফাতাহ অভিযোগ করেছিল, হামাসের সশস্ত্র আন্দোলন শান্তি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে। তাই ফাতাহ ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের সহায়তা নিয়ে হামাসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
কিন্তু ২০০০ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হলে হামাস আবারও আলোচনায় চলে আসে। ওই সময় ইসরায়েল আল-আকসা মসজিদে অভিযান পরিচালনা করে। হামাস এই অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ঘোষণা দিলে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই জনপ্রিয়তার ওপর নির্ভর ২০০৬ সালের সংসদ নির্বাচনে হামাস অংশ নেয়। কিন্তু হামাসের সম্ভাব্য বিজয় ঠেকাতে, ফাতাহ, পিএলওর সব কটি সংগঠন, ইসলামিক জিহাদসহ অন্য সংগঠনগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়নি। কারণ, তারা নির্বাচনে অংশ নিয়ে হামাসের বিজয়কে স্বীকৃতি দিতে চায়নি।
কিন্তু হামাস নির্বাচন জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের পর হামাসকে একই সঙ্গে ইসরায়েল ও ফাতাহর সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। হামাসের লড়াইটা ঘরে-বাইরে দুই জায়গাতেই ছিল। ফাতাহ চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি হামাসকে ক্ষমতা থেকে ফেলে দিতে। অবশেষে হামাসকে পশ্চিম তীর থেকে অপসারণ করতে সমর্থ হয়।
এর পর থেকে হামাস গাজা ও পিএলও পশ্চিম তীর নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে এখন মনে হয়, পিএলও বা ফাতাহ পশ্চিম তীর আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এই লড়াইয়ের পরিণতি যা-ই হোক, পশ্চিম তীর থেকে পিএলওকে পিছু হটতে হবে। এতে করে ক্ষতি হবে ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের। তারা ফিলিস্তিনে এক ঘনিষ্ঠ মিত্রকে হারাবে।
আরেকটি দিক হচ্ছে, এ যুদ্ধ মুসলিম বিশ্বে শিয়া-সুন্নির বিভাজনরেখা মুছে দিতে সহায়তা করতে পারে। সুন্নি হামাসের সবচেয়ে বড় মিত্র হচ্ছে শিয়ারা। সুন্নিদের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা কমই পাচ্ছে। হামাস বেশি সমর্থন পাচ্ছে শিয়া-অধ্যুষিত ইরান ও লেবাননের হিজবুল্লাহের থেকে। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, ‘হামাসের সেই সাহসী বীরদের হাতে চুম্বন করতে চাই, যাঁরা ইসরায়েলে হামলা করেছেন।’
অনেকেই সন্দেহ করছেন হামাসের হুট করেই প্রযুক্তির দিক থেকে শক্তিশালী হয়ে ওঠার পেছনে ইরানের বড় ভূমিকা থাকতে পারে। যদিও ইরান বারবার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। কিন্তু ইরান ও হিজবুল্লাহের সঙ্গে হামাসের সখ্যের বিষয়টি কারও অজানা নয়। সন্ত্রাসী বলে হামাস যখন সারা বিশ্বেই অপাঙ্ক্তেয়, তখন প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও সমর্থন ইরান থেকেই পেয়েছে।
মুসলিম বিশ্বের নেতা হতে চাওয়া সৌদি আরব ও তুরস্ক সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তাদের অবস্থা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো। সব পক্ষকেই খুশি রেখে চলতে চাইছে তারা। ফিলিস্তিনিদের জনসাধারণকে সান্ত্বনা দেওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে খ্যাপাতে চাইছে না।
এ অবস্থায় ইরানের সর্বতোভাবে হামাসের প্রতি সমর্থন মুসলিম বিশ্বের রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে। মুসলিম বিশ্বকে শিয়া-সুন্নির বিভাজনের আড়ালে ঢেকে রাখার রাজনীতি মুছে যেতে পারে। সহসাই হয়তো মুছে যাবে না, কিন্তু রাজনৈতিক গতিবিধি এ যুদ্ধ দ্বারা প্রভাবিত হবে।
বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের রাজনীতির কাঠামো বদলে যেতে পারে, যদি শেষ পর্যন্ত হামাস এ যুদ্ধে জিতে যায়। আপাতত এ যুদ্ধেও অনেকগুলো দিকের দুটি দিক হচ্ছে, একদিকে পিএলও, ফাতাহসহ অন্য সংগঠনগুলো প্রাসঙ্গিকতা হারাবে ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনে। আরেক দিকে ইরান মুসলিম বিশ্বের রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান আরও শক্ত করে নেতৃত্বে চলে আসবে।
ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক