শিক্ষানীতিতে প্রতিবন্ধিতাকে কতটুকু বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে

প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে বিবেচনায় নিয়ে পাঠদানের পদ্ধতি ও কৌশল কী হতে পারে, শিক্ষক প্রশিক্ষণে তা যুক্ত করা দরকার। এমনকি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর প্রতি তাঁর বা শিক্ষার্থীর সহপাঠীদের আচরণ কেমন হবে, সেটিও প্রশিক্ষণে থাকা দরকার। শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিবন্ধিতাকে কেন বিবেচনায় নেওয়া উচিত তা নিয়ে লিখেছেন তারিক মনজুর

বাংলাদেশের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিবন্ধিতাকে কখনোই গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়নি। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী কোন বিকল্প উপায়ে পাঠ গ্রহণ করবে ও কোন বিকল্প উপায়ে তা প্রকাশ করবে, তার কোনো দিকনির্দেশনা শিক্ষক-সহায়িকাতেও থাকে না। নতুন শিক্ষাক্রমে একীভূত শিক্ষা নামে সব ধরনের প্রতিবন্ধিতাকে বিবেচনায় নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল এবং এ ব্যাপারে কিছু প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো যথেষ্ট নয়, এমনকি খুব সুস্পষ্টও নয়।

২০১০ সালের শিক্ষানীতিতেও প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষাপদ্ধতি বা মূল্যায়নপ্রক্রিয়া নিয়ে কোনো প্রস্তাব করা হয়নি; এমনকি প্রতিবন্ধিতার কোনো সংজ্ঞায়ন করা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, বিদ্যালয়গুলোয় শৌচাগার ব্যবহার ও চলাফেরার সুবিধার জন্য প্রতিবন্ধীবান্ধব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। বাস্তব ক্ষেত্রে তাদের জন্য এই ন্যূনতম অধিকারও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।

মোটাদাগে বলা যায়, প্রত্যেক মানুষই কোনো না কোনো ধরনের প্রতিবন্ধিতাকে ধারণ করে। যেমন কিছু মানুষ অন্যের সঙ্গে মিশতে পারে না বা কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করে। আবার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুরা বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ভাষিক যোগাযোগে সংকট অনুভব করে। তবে আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী বলতে মূলত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, শ্রবণপ্রতিবন্ধী, শারীরিক প্রতিবন্ধী ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বোঝানো হয়ে থাকে। প্রত্যেকের প্রতিবন্ধিতার ধরন ও মাত্রা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন হয়।

যে শিক্ষার্থী কানে শুনতে পায় না, তার পক্ষে বিদ্যালয়ের সাধারণ পাঠদান শুনে বোঝা সম্ভব হয় না। তার বোঝার উপযোগী ইশারা ভাষা বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও অজানা। আবার যে শিক্ষার্থী চোখে দেখতে পায় না, তার পক্ষে লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অথচ এ ধরনের শিক্ষার্থীকেও খাতায় উত্তর লিখে নম্বর পেতে হয়। বোর্ডের পরীক্ষায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বা লিখতে অক্ষম শিক্ষার্থীর জন্য শ্রুতলেখক নিয়োগের সুযোগ থাকে। কিন্তু বাস্তবে এভাবে শিক্ষার্থীর যথাযথ মূল্যায়ন সম্ভব হয় না।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ২০১৭ সালে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রথমবারের মতো ব্রেইল বই ছাপায়। এর আগে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে কিছু ব্রেইল বই দেওয়া হতো। এ ছাড়া এনসিটিবির ওয়েবসাইটে রয়েছে প্রতিটি শ্রেণির মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক। এসব বই কানে শুনে বা চোখে দেখে পড়া যায়। কিন্তু শ্রেণি কার্যক্রমে শিক্ষকদের এসব বই ব্যবহার করতে দেখা যায় না। তা ছাড়া বোর্ডে লেখার ক্ষেত্রে কিংবা পড়া বোঝানোর ক্ষেত্রে শিক্ষকেরা কোনো ধরনের প্রতিবন্ধিতাকে বিবেচনায় নেন না।

প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে বিবেচনায় নিয়ে পাঠদানের পদ্ধতি ও কৌশল কী হতে পারে, শিক্ষক প্রশিক্ষণে তা যুক্ত করা দরকার। এমনকি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর প্রতি তাঁর বা শিক্ষার্থীর সহপাঠীদের আচরণ কেমন হবে, সেটিও প্রশিক্ষণে থাকা দরকার। পাঠ গ্রহণ ও প্রকাশের সুবিধা বাড়াতে তো হবেই, এমনকি এ ধরনের শিক্ষার্থীকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধিতা অনুযায়ী বিকল্প মাধ্যম ব্যবহারের সুযোগ রাখতে হবে। মনে রাখা দরকার, কোনো শিক্ষার্থীকেই সমাজের বাইরে রেখে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের কীভাবে সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করা যায়, সে ধারণা শিক্ষকদের আসলে থাকেই না। এ বিষয়ে তাঁরা প্রশিক্ষণও পান না। এমনকি শিক্ষক-সহায়িকাতেও এ–সম্পর্কিত ধারণা নেই। ফলে শ্রেণিকক্ষে প্রতিবন্ধী কোনো শিক্ষার্থী থাকলেও শিক্ষক তাঁর নিজস্ব পদ্ধতিতেই পড়ানো শেষ করেন। অথচ বলার সঙ্গে সঙ্গে যদি মূল অংশ লিখে দেখান, কিংবা লেখা ও আঁকার সঙ্গে সঙ্গে তিনি যদি মুখেও বলে দেন, তবে সব শিক্ষার্থীর কাছেই শ্রেণি কার্যক্রম আরও উপভোগ্য হতে পারে। পাঠ গ্রহণ, প্রকাশ, এমনকি মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও তিনি শিক্ষার্থীদের পরস্পরের সহযোগিতা নেওয়ার সুযোগ করে দিতে পারেন।

ব্রেইলে লেখা পাঠ্যপুস্তকেও সমস্যা আছে। এসব বইয়ে হয়তো কোষের গঠন বা পরমাণুর মডেল দেওয়া আছে। কিন্তু বোঝার সুবিধার জন্য ছবির বিবরণ দেওয়া নেই। ফলে শিক্ষার্থীর কাছে চিত্রের ধারণা অস্পষ্ট থেকে যায়। বইয়ে এসব ছবির বিস্তৃত বিবরণ কিংবা আঙুলের স্পর্শ-উপযোগী চিত্র থাকা দরকার। ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা গণিত বইও গাণিতিক চিহ্ন ও অন্যান্য জটিলতায় দুর্বোধ্য হয়ে রয়েছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর পক্ষে সেগুলো পড়ে বোঝা সহজ হয় না। তথ্যপ্রযুক্তি বইয়ে কম্পিউটার শিক্ষায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের উপযোগী করে কি–বোর্ডের ব্যবহার শেখানো হয়নি। এটি করা হলে সাধারণ শিক্ষার্থীও কম্পিউটার ব্যবহারে বাড়তি সুবিধা পেত।

মাসে মাসে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু টাকার অঙ্ক মোটেও উল্লেখ করার মতো নয়। এ ছাড়া খুব সীমিতসংখ্যক শিক্ষার্থী এই উপবৃত্তির আওতায় এসেছে। প্রতিবন্ধীদের জন্য সেবামূলক কার্যক্রম মূলত সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। এ ধরনের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপরিকল্পনা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন নেওয়া গেলে আরও বেশিসংখ্যক প্রতিবন্ধীকে শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত করা সম্ভব হতে পারে।

সারা দেশে বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য আটটি এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য পাঁচটি সরকারি বিদ্যালয় আছে। এসব বিদ্যালয়ে কেবল নির্দিষ্ট ধরনের প্রতিবন্ধীরা পড়ালেখা করার ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু এই বিদ্যালয়গুলো সমাজের অন্তর্ভুক্তিমূলক ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কেননা, সব শিশুই সমাজের অন্তর্ভুক্ত এবং সমাজে সবার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত থেকেই তাকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবন কাটাতে হয়। প্রতিবন্ধীসহ সব ধরনের শিক্ষার্থীকেই তাই সাধারণ বিদ্যায়তনে একসঙ্গে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া উচিত। এর মাধ্যমে সবাই পরস্পরকে সহযোগিতা করতে শিখবে এবং সমাজে একসঙ্গে চলতে শিখবে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল অনলাইনে ‘ব্রেইল কনভার্টর’ উন্মুক্ত করতে যাচ্ছে। এর ফলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পক্ষে যেকোনো টেক্সট ব্রেইলে রূপান্তর করে পড়া সম্ভব হবে। এ ছাড়া বাংলা লেখাকে কানে শোনার উপযোগী করা এবং মুখে বলা কথাকে লেখায় রূপান্তর করার সফটওয়্যার আছে। সরকারি উদ্যোগে ইশারা ভাষাও প্রমিত করা হয়েছে। শারীরিকভাবে লিখতে অক্ষম বা চলতে অক্ষম, কিংবা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্যও আশা করা যায় নতুন নতুন সুবিধা বাড়ানো সম্ভব হবে।

প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে বিবেচনায় নিয়ে পাঠদানের পদ্ধতি ও কৌশল কী হতে পারে, শিক্ষক প্রশিক্ষণে তা যুক্ত করা দরকার। এমনকি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর প্রতি তাঁর বা শিক্ষার্থীর সহপাঠীদের আচরণ কেমন হবে, সেটিও প্রশিক্ষণে থাকা দরকার। পাঠ গ্রহণ ও প্রকাশের সুবিধা বাড়াতে তো হবেই, এমনকি এ ধরনের শিক্ষার্থীকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধিতা অনুযায়ী বিকল্প মাধ্যম ব্যবহারের সুযোগ রাখতে হবে। মনে রাখা দরকার, কোনো শিক্ষার্থীকেই সমাজের বাইরে রেখে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

  • তারিক মনজুর  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক