স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কেন্দ্রে জোটের নেতৃত্বে থাকা এবং দেশের বৃহত্তম প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া একটি দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্রুতই প্রশ্ন ওঠার কথা নয়। কিন্তু তারপরও নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে নওয়াজ শরিফের দল পিএমএল-এনের বিষয়ে এই প্রশ্ন উঠছে। নিজের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে দলটির ভেতরে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা রয়ে গেছে।
নির্বাচনের ফলাফল নিঃসন্দেহে পিএমএল-এন সমর্থকদের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। দলটি কেন্দ্রে আরামদায়ক অবস্থান অর্জনের আশা করেছিল। কিন্তু তা হয়নি।
ইমরান খানের দল পিটিআইকে সামরিক গোষ্ঠীর দিক থেকে, বিশেষ করে পাঞ্জাবে যেভাবে কোণঠাসা করা হয়েছিল, তার ফায়দা যতটা তোলা যাবে বলে পিএমএল-এন আশা করেছিল, তা তারা তুলতে পারেনি।
পাঞ্জাব পিএমএল-এনের শক্ত ঘাঁটি। এখানে তারা সবচেয়ে বেশি আসন পেলেও আগের বহু আসন এবার পিটিআইয়ের কাছে হাতছাড়া হয়ে গেছে।
কথা ছিল নির্বাচনের পর নওয়াজ শরিফ ফের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিষিক্ত হবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নওয়াজ-শাহবাজের দল পিএমএল-এন, বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট-পাকিস্তানসহ (এমকিউএম-পি) ছোট কয়েকটি রাজনৈতিক দল কেন্দ্রে সরকার গঠনের জন্য জোট গড়েছে। এর ফলে আগের চেয়ে ভঙ্গুর একটি জোট সরকারের নেতৃত্বে এসেছে পিএমএল-এন।
নির্বাচনী পারফরম্যান্সের ময়নাতদন্ত পিএমএল-এনের বিপর্যয়ের অনেক কারণ দেখিয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যে নিশ্চিতভাবে একটি কারণ হলো, গত দুই বছরের সবচেয়ে খারাপ জীবনযাত্রার ব্যয়-সংকটের সুবাদে সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া সরকারবিরোধী মনোভাব। দ্বিতীয় কারণ মূল ভোটারদের (বিশেষ করে পাঞ্জাবের নিম্ন আয়ের লোক ও শহুরে মধ্যবিত্তরা) একটি বড় অংশের ভোট দিতে না আসা। তবে তৃতীয় কারণটিই বড়। সেটি হলো ভোটারদের বঞ্চনাবোধ।
পিএমএল-এনের অনেক নেতা ব্যক্তিগত ও ঘরোয়া পরিসরে স্বীকার করে থাকেন, এবারের নির্বাচনে, বিশেষ করে পাঞ্জাবের ভোটারদের দেওয়ার মতো কোনো কিছু তাঁদের ছিল না।
২০১৮ সালে পিএমএল-এন ভোটারদের কাছে পরিষ্কারভাবে একটি প্রতিষ্ঠানবিরোধী বার্তা পাঠাতে পেরেছিল। এ বিষয়টি তখন দলটির সঙ্গে জনগণের একটি যোগসূত্র তৈরি করেছিল।
সে সময় ভোটের আগে পর্দার আড়ালের ক্ষমতাধরদের হস্তক্ষেপ, পিএমএল-এনকে অযোগ্য ঘোষণা এবং দলটির নেতাদের কারাগারে পাঠানো তাদের ক্ষমতায় ফিরে আসা অসম্ভব করে তুলছিল ঠিকই, কিন্তু দলটির জন্য যে প্রদেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ, সেখানকার ভোটাররা তাদের প্রতি দৃঢ় সমর্থনই বজায় রেখেছিল।
কিন্তু এবার পিএমএলএন তার অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। অতীতে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার ও নিম্ন মূল্যস্ফীতির গল্প এবং ‘নওয়াজ ফিরে এসেছেন, এবার সব ঠিক হয়ে যাবে’—স্লোগান ভোটারদের আকর্ষণ করতে পারেনি। একসময় হয়তো এসব গল্প কাজ করত।
কিন্তু পাকিস্তানের বর্তমান স্থান-কালের পটভূমিতে রাজনীতির ভাষায় নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। ২০২২ সালের মে মাস থেকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নৈতিকতা ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি রাজনীতির ভাষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।
এ ক্ষেত্রে পিটিআই সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। তারা জাতীয় সার্বভৌমত্ব, ভালোর সঙ্গে মন্দের দ্বন্দ্ব, উৎপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মুখে মর্যাদার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার বিষয়কে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে।
আটক হওয়ার আগে ইমরান খানের দেওয়া বক্তৃতায় এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তাঁর হয়ে দেওয়া ভাষণে এ বিষয়গুলোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া টিকটক ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে হাজার হাজার পিটিআই কর্মীদের ছেড়ে দেওয়া কনটেন্টে এসব বিষয়কেই ফোকাস করা হয়েছে।
২০১১ সালে পিটিআইয়ের উঠে দাঁড়ানোর পর থেকে দলটির রাজনীতি সাংস্কৃতিক ও নৈতিক আবেদনের ওপর জোর দিয়ে আসছে। গতানুগতিক সব জনতুষ্টিবাদীর মতো দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব জালিম ও তাদের সমর্থক বনাম তাদের শিকার হওয়া মানুষের কথা সামনে এনেছে। সত্যিকারের দেশপ্রেমিক পাকিস্তানি ও অরাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে আপসকারীদের কথা সামনে এনেছে। তারা বারবার মদিনার খেলাফত থেকে অটোমান সাম্রাজ্যের গৌরবময় ইতিহাস এবং মুসলমানদের প্রতিরোধ ও বিজয়ের ইতিহাস সামনে এনেছে।
সোজা কথায়, ইমরান খান একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে ইতিহাস ও বর্তমান উভয়েরই সংমিশ্রণে একটি তত্ত্ব দিয়েছেন, যা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। এটি ভোটারদের একটি বৃহৎ ও ক্রমবর্ধমান অংশের সঙ্গে অনুরণিত হয়েছে।
কেউ যুক্তি দিতে পারেন, এ ধরনের বিষয় তো পাকিস্তানে নতুন কিছু নয়। ইমরান খান ১৯৯০–এর দশকের মাঝামাঝি থেকে তো একই স্ক্রিপ্ট আউড়ে যাচ্ছেন। তাহলে এখন কেন তাঁর কথা বৃহত্তর অনুরণনের সৃষ্টি করল?
এর জবাবে বলা যায়, সেই সময় ও সেই প্রজন্মের সঙ্গে এখনকার সময় ও এখনকার তথ্য-ভোক্তা ভোটারদের ভিন্নতা একটি প্রধান ব্যাখ্যা। তড়িৎ মুদ্রাস্ফীতি, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, পাকিস্তানের কেন্দ্রস্থলে নিরবচ্ছিন্ন জবরদস্তি প্রতিষ্ঠা, অতীতের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এবং এখনকার ইসরায়েলের আগ্রাসন নতুন প্রজন্মের ভোটারদের পশ্চিমাপন্থীদের ও পর্দার আড়ালে থাকা ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর ওপর ক্ষোভ বাড়িয়েছে।
এই ভোটারদের মনের কথা পিটিআই বলতে পেরেছে। পিএমএল-এনের নেতৃত্বাধীন জোট বলতে পারেনি। বঞ্চনাবোধে ক্ষুব্ধ এসব ভোটারকে সামাল দিয়েই এখন পিএমএল-এনকে সরকার চালাতে হবে। এটি খুব সহজসাধ্য হবে না।
● উমায়ের জাভেদ পাকিস্তানের লেখক ও শিক্ষাবিদ
ডন থেকে নেওয়া; ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত