শুক্রবারে একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠে বিছানায় শুয়েই বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের ইংরেজি খবর রেডিওতে শুনছিলাম। খবর থেকে জানলাম, গত রাত তিনটার পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং মির্জা আব্বাসকে তাঁদের বাসা থেকে সাদা পোশাকের পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর আমাদের দেশের টিভি সংবাদেও এই খবর শুনলাম।
সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদের মৌলিক অধিকারে বলা আছে, কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা তাঁর সঙ্গে ‘নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর’ ব্যবহার করা যাইবে না। এই অধিকার নিরঙ্কুশ। অর্থাৎ কোনো আইনের বা বিশেষ অবস্থার যুক্তি দিয়ে যন্ত্রণাদায়ক, নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর ব্যবহার জায়েজ করার কোনো সুযোগ কোনো ব্যক্তি বা বাহিনীর নেই। প্রায় সত্তর বা সত্তরোর্ধ এই দুই নেতাকে রাত তিনটার পর গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাইক্রোবাসে তুলে থানা অথবা ডিবি অফিসে নিয়ে গিয়ে তাঁদের নিশ্চয়ই মশারি খাটিয়ে, লেপ–বালিশ দিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হয়নি।
সেই সঙ্গে তাঁদের সাময়িক অসুবিধার জন্য ক্ষমা চাওয়াও নিশ্চয়ই হয়নি। অতএব, রাত তিনটার পরে তাঁদের ধরে নিয়ে যাওয়া এবং পুলিশি হেফাজতে বসিয়ে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা নিশ্চয়ই সংবিধান অনুয়ায়ী ‘নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর’ ব্যবহার। চোর–ডাকাতদের সঙ্গেও অনুরূপ ব্যবহার করা সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ।
পাঠক হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন এই মর্মে যে মির্জা ফখরুলের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়, কিন্তু তা–ই বলে খুনি ও সন্ত্রাসীদের কি দু-চার ঘা দেওয়া যাবে না? সাংবিধানিক উত্তর হলো, এই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিষ্ঠুর, যন্ত্রণাদায়ক ও অমানুষিক ব্যবহার করতে পারবে না।
সংবিধানের ৩৫(৪) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাইবে না।’ অর্থাৎ, পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে এমন কিছু জিজ্ঞেস করতে পারবে না, যার উত্তর দিলে আমি নিজেই ফেঁসে যাব। যেমন ইয়াবা কারবারি সন্দেহে কোনো ব্যক্তিকে পুলিশ করল, ‘এই ব্যাটা, ইয়াবার ব্যাগ কোথায় রেখেছিস?’ উত্তরে ইয়াবা কারবারি যদি বলেন যে আমার অমুক ঘরে অমুক সোফার কুশনের মধ্যে আছে, তাহলে তো তিনি ফেঁসে গেলেন, অর্থাৎ নিজের বিরুদ্ধে নিজেই সাক্ষ্য দিলেন। পুলিশ তাঁর কথামতো কুশন থেকে ইয়াবা বের করে তাঁর অপরাধ প্রমাণে সেটা সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করবে।
অথচ সংবিধান বলছে, এই রকম প্রশ্ন ইয়াবা কারবারিকে করলেও ইয়াবা কারবারি এর উত্তর দিতে বাধ্য নন। এই মৌলিক অধিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে সেই ১৭৯১ সাল থেকে বহাল আছে। সম্প্রতি দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেলে তিনি অনেকবারই বলেছেন, ‘তোমাদের কোনো প্রশ্নের উত্তর না দেওয়ার অধিকার আমাকে পঞ্চম সংশোধনী দিয়েছে, আমি সেই অধিকার চর্চা করছি এবং কোনো উত্তর দেব না।’
তদন্তকারী কর্মকর্তার জবাব থাকে ‘থ্যাংক ইউ’। এ ধরনের দৃশ্য অর্থাৎ পুলিশ পাকড়াও করে প্রশ্ন করছে আর উত্তরদাতা বলছেন, ‘আমি উত্তর দিতে বাধ্য নই বা উত্তর দেব না,’—সেটা মার্কিন বা ইংরেজি সিনেমায় বা টিভি সিরিয়ালে গত ৪০–৫০ বছরে কতশতবার দেখেছি, তা গুনে বলতে পারব না।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে আইন পড়তাম, তখন ব্যবহারিক ক্লাসের অংশ হিসেবে তদন্তকারী কর্মকর্তা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রশ্ন করছেন, এমন রুমে উপস্থিত থেকেছি। প্রশ্নোত্তর শুনেছি। উভয়ের সৎ ব্যবহার, জোরজবরদস্তির অভাব এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির অভিযোগ অস্বীকার করে কোনো ধরনের চড়–থাপ্পড় না খাওয়ার দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেছি।
সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের রক্ষাকবচগুলো বঙ্গবন্ধুর ১৯৭২ সালের সংবিধানে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। ৫০ বছরেও এই অনুচ্ছেদের কোনো সংশোধন বা কাটাছেঁড়া হয়নি। কিন্তু এই ৫০ বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশোধিত হয়ে গেছে বিকটভাবে। দেশের প্রধান বিরোধী দলের বর্তমান প্রধান নেতার সঙ্গে রাত তিনটার পর অমানবিক ও যন্ত্রণাদায়ক ব্যবহার করতে তারা বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করে না।
অভিযুক্ত ব্যক্তিদের রিমান্ডে এনে ‘ছ্যাঁচা’ দেওয়া আমরা অহরহ প্রত্যাশা করি। পুলিশ ছ্যাঁচা না দিলে আমরা মর্মাহত হই। অবশ্য কারও নিজের বেলায় একই ঘটনা ঘটলে দেশের আইন কোথায়, সংবিধান কোথায়, আদালত কোথায়—মনে মনে এরূপ বিলাপ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। আমরা কেউই এখন আর বঙ্গবন্ধুর সংবিধানের কথা স্মরণে রাখি না।
রাত তিনটার পরে তাঁদের ধরে নিয়ে যাওয়া এবং পুলিশি হেফাজতে বসিয়ে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা নিশ্চয়ই সংবিধান অনুয়ায়ী ‘নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর’ ব্যবহার। চোর–ডাকাতদের সঙ্গেও অনুরূপ ব্যবহার করা সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ।
২.
গত এক দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘মাস শুটিং’ বা নির্বিচার গুলিবর্ষণে নিহত ও আহত মানুষের সংখ্যা ১০ লাখের কাছাকাছি। তাও সেখানে পঞ্চম সংশোধনীর অধিকার মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে। গত এক দশকে বাংলাদেশে খুনের সংখ্যা ৫০ হাজারের কম। অর্থাৎ আমেরিকার তুলনায় নস্যি। আরও বলি, গত দশ বছরে সারা দেশে সম্ভবত দশ-বিশটার বেশি ব্যাংক–ডাকাতির খবর পত্রপত্রিকায় দেখিনি।
অন্যদিকে বড়দিনের এই ডিসেম্বর মাসে নাইজেরিয়ায় ব্যাংক–ডাকাতি হবে কয়েক শত। মোদ্দাকথা, দুর্নীতি, মানি লন্ডারিং, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপরাধের বাইরে আমাদের সহিংস অপরাধের সংখ্যা পৃথিবীর অন্য বহু দেশের তুলনায় বলতে গেলে নগণ্য প্রায়।
অবশ্য এখন মাদক ব্যবসায়ীরা হিংস্র হয়ে উঠছেন। আর আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠছি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংবিধানবহির্ভূত ‘নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর’ আচরণের সঙ্গে। অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের মতো অপরাধের ব্যাপারে।
এখন রাজনীতিবিদদের বক্তব্যের যেসব অংশ টেলিভিশনের খবরে শুনি, তাতে বারবার আঁতকে উঠি। কথা বলতে আর লিখতে গিয়ে বারবার মনে আতঙ্ক জাগে। কারণ, যে রক্ষাকবচ অর্থাৎ সংবিধানের মৌলিক অধিকার ছিল আমাদের নিশ্চয়তা, সেগুলো এখন অনেকাংশে তালাবদ্ধ।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অনেকেই প্রতিনিয়ত জোরেশোরে বারবার দেখেন, আমার দৃষ্টিতে ভাসে স্বপ্নভঙ্গের দৃশ্যগুলো।
ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক।