বাংলাদেশে নানা সময়ে নানা কায়দায় সরকার বদল হয়েছে। তবে এবারের মতো প্রতিক্রিয়া ভারত আগে কখনো দেখায়নি। বিশ্লেষকদের আলোচনা ও লেখায় তাই বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে ভারত মেনে নিতে পারেনি।
শেখ হাসিনার পতন ভারতের ভালো লাগেনি, এটাই স্বাভাবিক। শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের বিশেষ স্বার্থের সম্পর্কটি লুকোছাপার কোনো বিষয় ছিল না। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মধ্যে কিছু উদ্বেগের দিক আছে, কিছু চাওয়া-পাওয়ার বিষয় রয়েছে। শেখ হাসিনা ভারতের উদ্বেগগুলো দূর করেছেন, সেই সঙ্গে পূরণ করেছেন অনেক চাওয়া। বিনিময়ে ভারত পূরণ করেছে শেখ হাসিনার চাওয়া, নিশ্চিত করেছে তাঁর ক্ষমতায় থাকা। বাংলাদেশের তিন তিনটি একতরফা নির্বাচনের পেছনে ছিল ভারতের খোলাখুলি সমর্থন। বাংলাদেশের মানুষ এটা বিশ্বাস করে যে ভারতের কারণেই শেখ হাসিনা এত দিন জবরদস্তিমূলক শাসন চালিয়ে যেতে পেরেছেন।
শেখ হাসিনার পতন ভারতের জন্য এক বড় ধাক্কা। এতে ভারত ভেতরে-ভেতরে রুষ্টও হতে পারে। কিন্তু দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু রীতি নীতি থাকে, যা মেনে চলতে হয়। বাংলাদেশে একটি বড় পরিবর্তন হয়েছে। ছাত্র-জনতা এক হয়ে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছে। এই পরিবর্তনকে মেনে না নেওয়ার কোনো সুযোগ ভারতের আছে কি?
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছিল, তা ভারতের ভালো লাগার কথা নয়। তখন বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন সমর সেন। ঘটনার দিন তিনি ছিলেন দিল্লিতে। পরদিনই তিনি ঢাকা ফিরে আসেন। ১৮ আগস্ট বঙ্গভবনে তিনি নতুন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে দেখা করেন। ভারত সরকারের একটি কূটনৈতিক নোট তিনি মোশতাককে পড়ে শোনান। ১৫ আগস্টের ঘটনা ভারতকে যত ব্যথিতই করুক না কেন, বাংলাদেশের বাস্তবতা তারা তখন মেনে নিয়েছিল। উষ্ণ না হলেও একটি ওয়ার্কিং রিলেশন তারা শুরু থেকেই বজায় রাখার চেষ্টা করেছে।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে, এটাই ভারতসহ অনেকে ধরে নিয়েছিল। নির্বাচনের ফলাফল তাদের বিস্মিত করেছে। হয়তো আহতও করেছে। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সম্পর্ক উন্নয়নে ভারত সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মুচকুন্দ দুবেকে বিশেষ দূত করে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল। তিনি বাংলাদেশে এসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। আবার ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটলে ভারত নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্রকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল।
বাংলাদেশের মানুষ এখন এটা বুঝতে পারছে না যে হাসিনার পতনের পর ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে এবার এমন আচরণ করছে কেন?
ভারতীয় বন্ধুদের কেউ কেউ এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, ’৭৫, ’৯১ বা ২০০১ সালের ভারত আর ২০২৪ সালের ভারত এক নয়। ভারত আর আগের ভারত নেই—আমরা ধরে নিতে পারি যে এর অর্থ ভারত আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী হয়েছে। ভারত এখন একটি বড় অর্থনৈতিক শক্তি এবং আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতিতেও দেশটির প্রভাব অনেক বেড়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির কি কোনো মৌলিক বদল হয়েছে? ভারতের এই বদলের অর্থ কি প্রতিবেশী দেশের ওপর নিজের আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করা? আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, এর মধ্য দিয়ে ভারত আসলে কী পেয়েছে? প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক শুধু খারাপ নয়, বরং তিক্ত হয়েছে। শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে শুধু বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে (জনগণের সঙ্গে নয়) ভারত যে সম্পর্ক বজায় রেখেছিল, ৫ আগস্টের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তারও ক্ষতি করেছে ভারত।
এর প্রায় চার মাস পর ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রির বাংলাদেশের সফরকে পর্যবেক্ষকেরা ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চাইছেন। এই সফরে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এর লক্ষ্য ছিল দুই দেশের মধ্যে ৫ আগস্ট–পরবর্তী উত্তেজনা কমানো ও সম্পর্ক স্বাভাবিক করা।
দেশে ফিরে গিয়ে তিনি ভারতের পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে বলেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারত কাজ করবে বলে তিনি বাংলাদেশকে জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কোনো একক রাজনৈতিক দল বা একটি সরকারের সঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়। ভারত বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়।
কূটনীতিকেরা কূটনৈতিক বক্তব্য দেন। সেই দিক থেকে এই সফর ও তাঁর বক্তব্যকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করার কারণ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ভারতের অবস্থান বদলের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে কি? ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক হামলা ও সংঘাতের কিছু ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনও পড়েছে।
এসব ঘটনা দুঃখজনক এবং রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে তা মোকাবিলার তাৎক্ষণিক চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এসব ঘটনার মাত্রা ছাড়া অতিরঞ্জন এবং ভুয়া ও অপতথ্য ছাড়িয়ে ভারত সরকার ও ভারতের সংবাদমাধ্যম যে উসকানি দিয়ে গেছে, সেই অবস্থান থেকে ভারত সরে এসেছে বলে মনে হয় না।
এখানে বলে রাখা ভালো যে কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও বিদেশনীতি প্রশ্নে ভারতের সব রাজনৈতিক দল, সংবাদমাধ্যম, এমনকি ইন্টেলিজেন্সিয়া—সবাই প্রায় এক সুরে কথা বলে। কোনো কিছুকে তারা ক্রিটিক্যালি দেখতে পারে না।
ঢাকায় এসেও বিক্রম মিশ্রি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ব্যাপারে ভারতের উদ্বেগের কথা বলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, যে ভারত বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে এত উদ্বিগ্ন, সেই ভারতে সংখ্যালঘুরা কীভাবে দিন পার করেন? এই প্রশ্ন কি বাংলাদেশ তুলেছে কখনো? নাকি শুধু ভারতই একতরফাভাবে এই প্রশ্ন তোলার অধিকার রাখে?
আমাদের মনে আছে, ২০২১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্গাপূজার সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর হামলা ও সহিংসতার দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের হিসাবে তখন দেশের ২৭টি জেলায় ১১৭টি মন্দির-পূজামণ্ডপ ভাঙচুর ঘটে এবং ৯ জন প্রাণ হারায়। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ব্যাপারে ভারত এখন যে মাত্রার প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, ২০২১ সালে তেমন কিছু দেখা যায়নি। ভারতের কাছে বিষয়টি কি এমন যে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে দেশে হিন্দু সম্প্রদায় আক্রান্ত হলে তেমন কোনো সমস্যা নেই!
ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম (ইউএসসিআইআরএফ) নিয়মিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সর্বশেষটা বের হয়েছে গত ১ মে। বিশ্বের সবচেয়ে গুরুতর ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনকারী দেশের তালিকায় শুরুর দিকেই আছে ভারত।
প্রতিবেদনে ভারত প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের আমলে সেখানে ধর্মীয় স্বাধীনতার অবনতি হচ্ছে। দেশটির সংবিধান সবার বিশ্বাস চর্চার অধিকার দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ধর্মান্তরবিরোধী আইনেরও ব্যাপক প্রয়োগ হচ্ছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৩ সালে হাজার হাজার খ্রিষ্টান ও মুসলমান হামলার শিকার হয়েছেন। নানাভাবে তাঁদের ভয়ভীতিও দেখানো হয়। এই সময়ে শত শত গির্জা ও মসজিদ ধ্বংস করা হয়।
২ অক্টোবর সেই প্রতিবেদন হালনাগাদ করা হয়েছে (ইন্ডিয়া কান্ট্রি আপডেট)। সেখানে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালজুড়ে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর হাতে সংখ্যালঘুরা হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, ধর্মীয় নেতারা গ্রেপ্তার হয়েছেন নির্বিচার এবং তঁাদের বাড়িঘর ও উপাসনালয় ভাঙা হয়েছে। এসব ঘটনার পেছনে রয়েছে সরকারি লোকজনের মদদ। উসকানিমূলক বক্তব্য, ভুয়া তথ্য ও অপতথ্যকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা এসব করেছেন।
তবে ভারতে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন বা চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে—এটা বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো ধরনের হামলা বা নির্যাতনের ঘটনাকে জায়েজ করে না। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা অগ্রহণযোগ্য এবং নিন্দনীয়। ৫ আগস্টের পর এ ধরনের যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে এ পর্যন্ত ৮৮ জনকে গ্রেপ্তারের কথা বলেছে সরকার। এখন তাদের দায়িত্ব প্রতিটি ঘটনার বিচার নিশ্চিত করা।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন—এমন অভিযোগ এনে সমাবেশ ও বিক্ষোভ করেই যাচ্ছে। দিল্লিতে আরএসএস বাংলাদেশ হাইকমিশন ঘেরাওয়ের কর্মসূচি পালন করেছে। এর আগে কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলার ঘটনা ঘটেছে।
এই তো দুই দিন আগে, ১৭ ডিসেম্বর কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী পার্লামেন্ট ভবনে দলের সদস্যদের নিয়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন। এ সময় তাঁদের কাঁধের ঝোলানো ব্যাগে ইংরেজিতে লেখা ছিল, ‘বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের পাশে আছি’। আর হিন্দিতে লেখা ‘বাংলাদেশের হিন্দু ও খ্রিষ্টানদের পাশে দাঁড়িয়ে আছি’।
বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর যেকোনো দেশের সংখ্যালঘুদের পক্ষে অবস্থান নেওয়া বা তাদের পাশে দাঁড়ানো একজন বিবেকবান মানুষের কর্তব্য। কিন্তু ভারতের সংখ্যালঘুদের পক্ষে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর অবস্থান কী?
গত ২৮ নভেম্বর আসাম খ্রিষ্টিয়ান ফোরাম (এসিএফ) যে বিবৃতি দিয়েছে, তা কি তাঁর চোখ এড়িয়ে গেছে? বিবৃতিতে কয়েক বছর ধরে সেখানে সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর ধারাবাহিক আক্রমণের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তারা বলেছে, কিছু লোক খ্রিষ্টান প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ করছেন। খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীরা যে মূর্তি বা ছবিতে বিশ্বাসী, তা সরানোর দাবি তুলেছেন। খোলাখুলিভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ভিন্নমত আক্রমণের শিকার হচ্ছে।
প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে বলি, আপনি বাংলাদেশের হিন্দু ও খ্রিষ্টানদের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, ভালো কথা, দাঁড়িয়ে থাকুন। কিন্তু ভারতের খ্রিষ্টানদের পাশেও একটু দাঁড়ান প্লিজ!
বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ কতটা আন্তরিক আর কতটা খবরদারিমূলক, সেই প্রশ্ন বাংলাদেশের মানুষের মনে রয়েছে। ভারতের বর্তমান আচরণকে উদ্দেশ্যমূলক মনে করারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
আমাদের মনে আছে, ২০২১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্গাপূজার সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর হামলা ও সহিংসতার দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের হিসাবে তখন দেশের ২৭টি জেলায় ১১৭টি মন্দির-পূজামণ্ডপ ভাঙচুর ঘটে এবং ৯ জন প্রাণ হারায়। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ব্যাপারে ভারত এখন যে মাত্রার প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, ২০২১ সালে তেমন কিছু দেখা যায়নি। ভারতের কাছে বিষয়টি কি এমন যে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে দেশে হিন্দু সম্প্রদায় আক্রান্ত হলে তেমন কোনো সমস্যা নেই!
ভারত একটি আঞ্চলিক শক্তি, বৈশ্বিক শক্তি হওয়ার আকাঙ্ক্ষাও দেশটির রয়েছে। ভারতের এই চাওয়ার মধ্যে কোনো দোষ নেই। কিন্তু যে দেশ বড় হতে চায়, তার আচরণও বড় দেশের মতো হতে হয়। ভারতের বিদেশনীতিতে তার কোনো প্রতিফলন আছে বলে মনে হয় না। ৫ আগস্ট বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনের পর ভারতের আচরণ আর যা–ই হোক কোনো বড় দেশের লক্ষণকে তুলে ধরে না। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলে গেলেন, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয় তারা। এটা বলার নয়, প্রমাণ করার বিষয়।
চার মাস ধরে বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে ভারত। এখানকার মানুষ ভারত যায় ব্যবসা, ঘোরাঘুরি, কেনাকাটা, পড়াশোনা ও চিকিৎসার কাজে। সীমিত চিকিৎসা ভিসা অবশ্য দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ভিসা বন্ধ রেখে কি কোনো দেশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখা যায়? বাংলাদেশের যাঁরা ভারতে চিকিৎসার জন্য যান, তঁারা বিপদে পড়েছেন। কিন্তু সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে মানুষ বিকল্প খুঁজে নেয়। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের মানুষ তার ভ্রমণ পরিকল্পনায়ও আর ভারতকে রাখবে না। দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিটা কার হবে?
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বা বাংলাদেশের বিজয়কে ভারত কীভাবে দেখে, তা প্রধানমন্ত্রী মোদির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যেই পরিষ্কার। তিনি লিখেছেন, ‘আজ, বিজয় দিবসে, ১৯৭১ সালে ভারতের ঐতিহাসিক বিজয়ে অবদান রাখা সাহসী সেনাদের সাহস ও আত্মত্যাগকে আমরা সম্মান জানাই। তাঁদের নিঃস্বার্থ আত্মোৎসর্গ ও অটল সংকল্প আমাদের জাতিকে রক্ষা করেছে এবং আমাদের গৌরব এনে দিয়েছে। এই দিনটি তাঁদের অসাধারণ বীরত্ব ও অদম্য চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁদের আত্মত্যাগ চিরকাল প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে এবং আমাদের জাতির ইতিহাসে গভীরভাবে গেঁথে থাকবে।’
মোদির এই বক্তব্য কী প্রমাণ করে? ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়কে তিনি শুধু ‘ভারতের বিজয়’ বলে দাবি করেছেন। কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কাও প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন। বাংলাদেশের জনগণ এসব বক্তব্যকে ভালোভাবে নেয় না। বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ককে ভারত গুরুত্ব দেয়—এর কোনো প্রমাণ তো পাওয়া যাচ্ছে না।
● এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক
akmzakaria@gmail.com