আওয়ামী লীগ সরকার পূজার সময় ভারতে ইলিশ রপ্তানি করেছিল বলে প্রচুর সমালোচনা হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো উপদেষ্টা ইলিশ রপ্তানি করা যাবে না বলে ঘোষণা দেওয়ায় অনেকেই ভাবছিলেন, সরকারের ভারত নীতি পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার দিল্লিকে খেপাতে চায়নি। ভারতে আগের মতোই ইলিশ গেল। এই ইলিশ থেকে কত টাকা পাওয়া যাবে, তারও হিসাব দিয়েছেন সরকারের কোনো কোনো নীতিনির্ধারক। ইঙ্গিতটা এমন যে আগের সরকারের আমলে ইলিশ রপ্তানি করে কোনো টাকা পাওয়া যায়নি।
ভারতের সঙ্গে যখন ইলিশ কূটনীতি বেশ সরগরম, তখনই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বরফ গলার বিষয়টি সামনে আনলেন। ভারতের সংবাদ সংস্থা এএনআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কে ‘বরফ গলতে শুরু করেছে’। এর অর্থ, আওয়ামী লীগই বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের বড় বাধা ছিল।
বৃহস্পতিবার এএনআই প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগে দুই দফায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি শেখ হাসিনার আমলে গত ১৫ বছরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের হওয়া কিছু উদ্যোগ ও চুক্তির বিষয়ে সমালোচনা করে আসছে। সাম্প্রতিক কালে বিএনপির নেতাদের কণ্ঠে চুক্তির সমালোচনা শোনা যায় না।
সম্প্রতি ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের বিষয়ে দলটির কার্যালয়ে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ও ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন।
মির্জা ফখরুলের ভাষ্য, ‘বাংলাদেশে গত নির্বাচনের পর থেকে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে একটি প্রশ্ন ছিল। তবে এবার হাইকমিশনারের আমাদের কার্যালয়ে আসাটা অবশ্যই পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটিয়েছে। বরফ গলতে শুরু করেছে।’
মির্জা ফখরুল ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বরফ গলার কথা বলেছেন। বরফ গলার আগে বরফটি জমাট বঁাধার কারণগুলোও চিহ্নিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোন পক্ষের কী ঘাটতি আছে, সেগুলো যত দ্রুত সম্ভব পূরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভারতের যেমন দায় আছে, তেমনি আছে ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিএনপির নেতৃত্বেরও।
বিএনপিসহ ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো মনে করে, ভারত সমর্থন না করলে আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করতে পারত না। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব চেয়েছিল, সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। ওই নির্বাচনকে চীনও সমর্থন করেছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চীন ও ভারত উভয়ই বিএনপির সঙ্গে সদ্ভাব গড়ে তুলে চলার পক্ষপাতী।
তারা মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুত সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হলে বিএনপিরই ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা বেশি। সে ক্ষেত্রে অতীতের তিক্ততা ভুলে কীভাবে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যায়, সেই চেষ্টা চালাচ্ছে পক্ষগুলো। বিএনপির নেতাদের সঙ্গে এর আগে চীনের রাষ্ট্রদূত বাও ওয়াংও বৈঠক করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও সামনে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেন।
বিএনপির মহাসচিব এএনআইকে বলেছেন, তাঁর দল ভারতকে আশ্বস্ত করেছে যে তারা ক্ষমতায় এলে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোকে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করার সুযোগ দেবে না। অতীতে উত্তর–পূর্ব ভারতের সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার খবর প্রকাশ হয়েছে। যদিও শেখ হাসিনার আমলে সেটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার সঙ্গে বৈঠক নিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা পানি বণ্টন, সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্য ঘাটতি—এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। একই সঙ্গে ভারতের প্রধান বিষয় হলো নিরাপত্তা সমস্যা। আমরা আশ্বস্ত করেছি যে আমরা যদি ক্ষমতায় থাকি, তাহলে আমরা এটা নিশ্চিত করব যে এ দেশের মাটি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা ব্যবহৃত হবে না।’ যাঁরা উত্তর–পূর্ব ভারতে অন্য কিছু দেখার স্বপ্ন দেখেছিলেন, বিএনপির মহাসচিবের এই অভয়বাণী তাঁদের হতাশ করবে।
মির্জা ফখরুল এএনআইকে বলেন, ‘কিন্তু বিএনপি ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে কিছু ভুল–বোঝাবুঝি ছিল। আমি মনে করি, বরফ গলতে শুরু করেছে। আমি আশা করি, এবার এটা (সম্পর্ক) আরও ভালো হবে। তারা (ভারত) আমাদের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করবে। আমরা এটা বিশেষ করে আবারও বলেছি যে ভারতের এ দেশের মানুষের মানসিকতা বোঝার চেষ্টা করা উচিত। তাদের “সব ডিম এক ঝুড়িতে’ রাখা উচিত নয়। তাদের উচিত জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক উন্নয়ন করা।’
নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের বৈঠক হয়। গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে ছাত্র গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের পর দুই দেশের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ে এটাই প্রথম বৈঠক।
এর আগে ভারতের হাইকমিশনার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস টেলিফোনে কথা বলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও। সেই ফোনালাপে যে বরফ গলেনি, সেটা স্পষ্ট। মোদি নিজের টুইটে ফোনালাপের সূত্র ধরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ চেয়েছিল জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে দুই দেশের শীর্ষ নেতার মধ্যে একটি বৈঠক হোক। দিল্লি এ বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি।
এর আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ভারতের সাংবাদিক মহুয়া চৌধুরীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দেওয়ায় বিএনপি অসন্তুষ্ট। বিএনপিকে জাতীয়তাবাদী দল দাবি করে এই নেতা বলেন, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাঁদের কৌশলগত যে সম্পর্ক ছিল, সেটা আর এখন নেই। ২০১৮–এর পর জামায়াত বিএনপির জোটে নেই। বরং বামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ কিছু দলকে নিয়ে তাঁরা জোট করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। অন্যদিকে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগই জামায়াতের সঙ্গে জোট করে তাঁদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে।
বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কল্যাণে বিএনপি সরকার কী কী করেছে, তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন গয়েশ্বর রায়। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। তাঁর বরাত দিয়ে যখন টাইমস অব ইন্ডিয়া শিরোনাম করল, ‘আমাদের শত্রু শেখ হাসিনাকে সহায়তা করলে ভারতকে সহযোগিতা করা কঠিন হবে।’ আমরা জানি না, গয়েশ্বর রায় ঠিক কী বলেছেন। তিনি শেখ হাসিনাকে পলাতক আসামি বলতে পারেন। তাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যাসহ যেসব অভিযোগ আছে, সেগুলোর বিচারের কথা বলতে পারেন। কিন্তু তিনি শেখ হাসিনাকে ‘আমাদের শত্রু’ বলতে পারেন না।
একই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বিএনপির মহাসচিব ভিন্ন কথা বলেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমি জানি না, এখনো সরকার তাঁকে (শেখ হাসিনা) বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করেছে কি না। তবে আমি মনে করি, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ, সেগুলোর মুখোমুখি হতে ফেরত আসা উচিত এবং তাঁর জবাবদিহির আওতায় আসা উচিত।’
মির্জা ফখরুল ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বরফ গলার কথা বলেছেন। বরফ গলার আগে বরফটি জমাট বঁাধার কারণগুলোও চিহ্নিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোন পক্ষের কী ঘাটতি আছে, সেগুলো যত দ্রুত সম্ভব পূরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভারতের যেমন দায় আছে, তেমনি আছে ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিএনপির নেতৃত্বেরও।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি