এক দশকের বেশি সময় ধরে চীন ক্রমবর্ধমান আক্রমণাত্মক হাইব্রিড যুদ্ধের কৌশল ব্যবহার করে দক্ষিণ চীন সাগরে তার ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তার করে আসছে। নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের জন্য এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ‘চীনা স্বপ্ন’ বিশ্ব নেতৃত্বের ওপর আধিপত্য বিস্তারের ওপর নির্ভরশীল। এর জন্য চীনকে দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং ভারতীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী অবস্থানের অবসান ঘটাতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনে চীন বলপ্রয়োগমূলক কৌশল প্রয়োগেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি।
ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামের স্বাধীনতাকে চীন অস্বীকার করে আসছে এবং এই দেশ দুটির নৌযানগুলো চীনা বাধার মুখে পড়ছে। এমনকি চীনা জাহাজ থেকে নৌযানগুলো জলকামান হামলা ও ব্লেড-অস্ত্রের আক্রমণের শিকার হয়েছে।
দেশ দুটি তাদের উপকূলে খনিজ সম্পদ আহরণ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। তাদের কার্যক্রম নিয়মিতভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চীন এই দুটি দেশের জলসীমাকে নিজের বলে দাবি করে থাকে। এ কারণে সেখানে মাছ ধরতে গেলে চীনা হামলার মুখে পড়তে হয়। এই সংঘাত আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়াচ্ছে। প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরের সংযোগকারী গুরুত্বপূর্ণ পথে স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে।
ফিলিপাইনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা চুক্তি আছে। এ কারণে চীনের এই আচরণকে নিয়ন্ত্রণে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। কিন্তু ওবামা, ট্রাম্প এবং জো বাইডেন—এই তিন প্রশাসনই ফিলিপাইনের প্রতি সমর্থনসূচক বিবৃতি দেওয়া ও কিছু প্রতীকী পদক্ষেপ নেওয়ার বাইরে কিছুই করেনি।
২০১২ সালে চীন ফিলিপাইনের কাছ থেকে বিরোধপূর্ণ স্কার্বোরো শোল নামের একটি দ্বীপ দখল করে নিলেও ওবামা চীনকে শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেননি।
ফিলিপাইনের সুরক্ষা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি পূরণে এটিই যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ব্যর্থতা, তা মোটেও নয়।
১৯৯৫ সালে চীনের সেনারা ফিলিপাইনের মিসচিফ রিফ নামের দ্বীপটি দখল করতে গেলে চীনা বাহিনীকে প্রতিহত করতে ফিলিপাইন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সাহায্য চেয়েছিল। কিন্তু সে সময়কার মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ফিলিপাইনে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রাখার অধিকার তিন বছর আগে বাতিল হওয়ায় বিরক্ত হয়ে ফিলিপাইনকে সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানান। বর্তমানে মিসচিফ রিফ একটি গুরুত্বপূর্ণ চীনা সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে।
এভাবে চীন যতই পার পেয়েছে, ততই তার সাহস বেড়েছে। স্কার্বোরো শোল দখলের পর সি চিন পিং ভূমি পুনর্দখলের কার্যক্রম শুরু করেন এবং দক্ষিণ চীন সাগরে ১ হাজার ৩০০ হেক্টর (৩ হাজার ২০০ একর) নতুন ভূমি তৈরি করেন। এই ভূমির মধ্যে সাতটি কৃত্রিম দ্বীপ রয়েছে। দ্বীপগুলো বর্তমানে সামনের সারির ঘাঁটি হিসেবে কাজ করছে।
গত বছরের শেষের দিকে বাইডেন প্রশাসন ঘোষণা করেছিল, দক্ষিণ চীন সাগরের যেকোনো স্থানে ফিলিপাইনের সামরিক বাহিনী, উপকূলরক্ষী, বিমানবাহিনী বা সরকারি জাহাজের বিরুদ্ধে কোনো সশস্ত্র আক্রমণ হলে তা যুক্তরাষ্ট্র-ফিলিপাইন প্রতিরক্ষা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মোকাবিলা করা হবে। কিন্তু বাস্তবে চীন এখনো কোনো শাস্তি পায়নি এবং তার আচরণে কোনো পরিবর্তনও হয়নি।
চীন বিরোধপূর্ণ দ্বীপগুলোতে ২৭টি সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছে। এগুলোর প্রতিটিই স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, নজরদারি সরঞ্জাম, রাডার সিস্টেম এবং লেজার ও জ্যামিং যন্ত্রপাতিতে সজ্জিত। বড় দ্বীপগুলোতে বিমান হ্যাঙ্গার, রানওয়ে এবং গভীর পানির বন্দরও রয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরের ভূরাজনৈতিক মানচিত্র একতরফাভাবে পরিবর্তন করে চীন নিশ্চিত করছে, এই অঞ্চলে ক্ষমতা দেখানোর বিশেষ সুবিধা তার রয়েছে।
চীন ধীরে ধীরে ফিলিপাইনের নিরাপত্তা খর্ব করেছে। এমনকি ফিলিপাইনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (ইইজেড) মধ্যকার জায়গাতেও ফিলিপাইনের নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করেছে। এরপরও যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র ফিলিপাইনকে ‘অটল’ প্রতিরক্ষা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে।
গত বছরের শেষের দিকে বাইডেন প্রশাসন ঘোষণা করেছিল, দক্ষিণ চীন সাগরের যেকোনো স্থানে ফিলিপাইনের সামরিক বাহিনী, উপকূলরক্ষী, বিমানবাহিনী বা সরকারি জাহাজের বিরুদ্ধে কোনো সশস্ত্র আক্রমণ হলে তা যুক্তরাষ্ট্র-ফিলিপাইন প্রতিরক্ষা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মোকাবিলা করা হবে। কিন্তু বাস্তবে চীন এখনো কোনো শাস্তি পায়নি এবং তার আচরণে কোনো পরিবর্তনও হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের কথা ও কাজের মধ্যে এই বড় ফারাকের কারণ কী?
এর কারণ প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র আপাতত চীনের সঙ্গে সংঘাতে যেতে চায় না। বিশেষ করে যখন তাদের সম্পদ ও মনোযোগ ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের মতো বিষয়গুলোতে ব্যস্ত রয়েছে, ঠিক সে সময় চীনের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোকে তারা বাড়তি ঝামেলা মনে করে।
যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগরের সার্বভৌমত্বের বিরোধে হস্তক্ষেপ করতে চায় না। কারণ, সেখানে তার নিজস্ব কোনো ভূখণ্ডগত দাবি নেই। এমনকি জাপানের নিয়ন্ত্রিত সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা চীন দাবি করার পরও চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কোনো কড়া ব্যবস্থা নেয়নি।
তবে যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট করেছে, জাপানের সঙ্গে তাদের নিরাপত্তা চুক্তি সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে এবং তারা ‘জাপানের প্রশাসনকে দুর্বল করবে, এমন কোনো একতরফা পদক্ষেপ’ মেনে নেবে না।
ফিলিপাইনের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের ঘোষণা দেওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের বলা উচিত, ফিলিপাইনের সঙ্গে তাদের নিরাপত্তা চুক্তি সেসব এলাকার প্রযোজ্য হবে, যেগুলো বর্তমানে ফিলিপাইনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এর মধ্যে সেকেন্ড থমাস শোলও অন্তর্ভুক্ত আছে, যেটি কিনা চীন অবরোধ করার চেষ্টা করছে।
যুক্তরাষ্ট্র তার এই অবস্থানের সমর্থনে ২০১৬ সালের আন্তর্জাতিক সালিসি ট্রাইব্যুনালের রায়ের কথা উল্লেখ করতে পারে। সে রায়ে বলা হয়েছিল, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের ভূখণ্ডগত দাবির কোনো আইনি ভিত্তি নেই এবং ফিলিপাইনের ইইজেডের মধ্যে চীনের কর্মকাণ্ড ফিলিপাইনের সার্বভৌমত্বের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তবে চীন ওই রায়কে যেভাবে উপেক্ষা করেছে, তা থেকে বোঝা যায়, আন্তর্জাতিক আইন দিয়ে দক্ষিণ চীন সাগরের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা যাবে না। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে শুধু বক্তৃতাবাজি করলে হবে না। বক্তব্যের সমর্থনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
● ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের প্রফেসর ইমেরিটাস এবং বার্লিনের রবার্ট বোশ একাডেমির ফেলো
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ