শিবরাম চক্রবর্তীর উক্তিটি বহুল উদ্ধৃত—‘বহু বছরের কঠিন পরিশ্রমের পর আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, “নতুন বছর নতুন বছর” বলে খুব হইচই করার কিস্যু নেই। যখনই কোনো নতুন বছর এসেছে, এক বছরের বেশি টেকেনি...।’ এর সরল-সিধা একটা ব্যাখ্যা হতে পারে এ রকম—নববর্ষ ঘিরে উন্মাদনা অর্থহীন। কিংবা একটু ঘুরিয়ে এভাবেও বলা যায়: নতুন বছর নিয়ে মাতামাতির অন্তঃসারশূন্যতা শিবরামের মতো আর কে কবে উপলব্ধি করেছেন!
ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যতভাবেই করা হোক না কেন, বছরের ৩৬৫ দিনই যাঁদের ‘শ্রমের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি’, তাঁদের কাছে নতুন-পুরোনোর ফারাক দেয়ালের পুরোনো ক্যালেন্ডারটি নামিয়ে নতুনটি ঝোলানোমাত্র। অবশ্য তাঁদের সবার মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে, অর্থাৎ খোলা আকাশের নিচে থাকতে হয় না, মানে ঘর আছে এবং সেই ঘরের দেয়াল বা বেড়ায় ক্যালেন্ডার ঝোলানো থাকে, তারই–বা নিশ্চয়তা কে কবে কোথায় দিয়েছে?
জেলায় জেলায় অনেকেই সরকারের তৈরি করে দেওয়া ঘর পাচ্ছেন বটে, কিন্তু গৃহহীন মানুষের তালিকায় আর কেউ অবশিষ্ট নেই, তা তো নয়।
এক রাজধানীতেই ফুটপাতে গোটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া মানুষের সংখ্যাও তো নেহাত কম নয়। সুতরাং এসব গৃহহীন মানুষের সংসারের কথা ভাবলে প্রথমেই মনে আসে ‘সংসার’ শব্দের মধ্যে ‘সং’ কথাটি আছে। তাঁরাও যেন সমাজের অন্যদের চোখে ‘সং’ই—কী পোশাক–আশাকে, কী ভাবভঙ্গিতে। সবকিছুতেই তাঁরা বড্ড বেমানান!
২০২২ সালের খানার আয় ও ব্যয় জরিপের ভিত্তিতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি পরিবারের সংসার খরচের গড় একটা হিসাব দিয়েছে। সে অনুযায়ী পরিবারপ্রতি গড় মাসিক আয় ৩২ হাজার ৪২২ টাকা। এ আয়ের ৪২ শতাংশ ব্যয় হয় খাবারের পেছনে। আগে প্রতি পরিবারের মোট খরচের অর্ধেকের বেশি চলে যেত খাবারের পেছনে, সে তুলনায় অবস্থা এখন ‘ভালো’। যদিও এখনো খাবার কিনতেই সবচেয়ে বেশি খরচ করতে হচ্ছে।
খানার এক অর্থ খাদ্যও। যাঁদের ‘খানা’ অর্থাৎ গৃহ নেই, তাঁদের ‘খানা’ অর্থাৎ খাবার খরচের হিসাব কী? আর যাঁদের খানা আছে, তাঁদের আয়ের যদি ৪২ শতাংশই খাবারের পেছনে ব্যয় করতে হয়, তাহলে অন্যান্য খাতের ব্যয় মেটান তাঁরা কীভাবে?
সংসারের খরচের ফর্দে আবশ্যিকভাবে খাবার ছাড়াও থাকে চিকিৎসা, শিক্ষা, জামাকাপড়, যাতায়াত, বাসাভাড়া, বিনোদন...সব মিলিয়ে ১৩টি খাতের কথা বলেছে বিবিএস। আয় যাঁদের বাঁধাধরা, সীমিত, তাঁরা সব খাতের খরচ মিটিয়ে সংসার চালান কোন ‘জাদুবলে’? সবকিছুর দাম এতটাই বাড়তি যে বাজারে গেলে গায়ে যেন হলকা লাগার অনুভূতি হয়!
বিবিএস বলছে, তাদের হিসাবটা গড়। স্বাভাবিকভাবেই ধনী পরিবারগুলোতে খরচ বেশি আর গরিব পরিবারে কম। কিন্তু এ দুই ধরনের পরিবারের আয়ের ফারাক আসমান ও জমিনের মতো কি না, সেটাও তো একটা প্রশ্ন।
এ প্রসঙ্গে গত কয়েক দিনের মধ্যে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) দেওয়া দুটি হিসাবের উল্লেখ করা যেতে পারে। এক. ২০০৮ থেকে ২০২৩—এই দেড় দশকে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। দুই. এক মন্ত্রীর বিদেশে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকার ব্যবসা রয়েছে। যদিও তিনি এ তথ্য নির্বাচনী হলফনামায় দেননি। এর আগে দেশি-বিদেশি নানা গবেষণা সংস্থা বা নজরদারি প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার কোটি টাকা তছরুপ বা পাচারের তথ্য নাহয় অনুল্লেখই থাকুক।
ধনী ও গরিবের মধ্যে আয়বৈষম্যের পারদও বাড়ছে চড়চড়িয়ে। অক্সফামের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ মানুষ জাতীয় সম্পদের ১৬ দশমিক ৩ শতাংশের মালিক ছিলেন। আর সবচেয়ে দরিদ্র ৫০ শতাংশ মানুষের মালিকানা ছিল মাত্র ৮ দশমিক ৬ শতাংশে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক বিনায়ক সেন আয়ের জিনি সহগ (আয়বৈষম্যের একটি পরিমাপ) ও অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলেন, দেশে এখন উচ্চ অসমতা বিরাজ করছে। এটা উদ্বেগের। তাঁর কথায়, এ পরিস্থিতিতে দেশে বর্তমানে যে সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে, তা ঠিক এই অসমতা মোকাবিলা করার মতো নয়।
‘মনেরে আজ কহ যে,/ ভালো মন্দ যাহাই আসুক/ সত্যেরে লও সহজে’—রবীন্দ্রনাথের এ কথা যত সহজে উচ্চারণ করা যায়, তত সহজে কি মেনে নেওয়া যায়? নাকি মেনে নেওয়া উচিত, যখন জানি সবই ‘নিয়তিনির্দিষ্ট’ নয়।
নতুন বছরের আগমন নিয়ে উচ্ছ্বাস বা পুরোনো বছরের বিদায় নিয়ে হতাশা—এ দুইয়ের যা-ই অনুরণন তুলুক আপনার-আমার মনে, দুই অর্থেই ‘খানা’হীন মানুষের ‘বৎসরের আবর্জনা’ দূর হওয়ার কোনো ছবি কি কষ্টকল্পনাতেও ফুটে ওঠে?
কোনো ‘জাদুবলে’ নয়, নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও কিছু মানুষ বেঁচে থাকেন ‘মনোবলে’। ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা’—এ শুভকামনায় নতুন বছরের বরণডালা ভরে উঠুক; সে ডালায় মনোবলে বলীয়ান এই মানুষদের কুর্নিশ জানানোর জন্য অন্তত একটা ফুলও থাকুক।
হাসান ইমাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]