আওয়ামী লীগের নেই অনুশোচনা, ষড়যন্ত্র তত্ত্বে ভরসা

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের চিন্তায়–কাজে কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে নাছবি: প্রথম আলো

আওয়ামী লীগের শাসনের পতন ও তাদের পরিণতির ধরনটা এবার ভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া ৭৫ বছর বয়সী দলটির জুটেছে ফ্যাসিবাদের তকমা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে। প্রশ্ন হচ্ছে কেন আওয়ামী লীগের এই পরিণতি, এর কারণ বা বাস্তবতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করছে তারা। 

শেখ হাসিনার সরকারের পতনের তিন মাস পার হয়েছে। এখন পর্যন্ত দলটির নেতা-কর্মীদের চিন্তায় বা কথায় কিন্তু কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে না। অনুশোচনা প্রকাশের কোনো ইঙ্গিতও নেই। এমনকি দলটির নেতৃত্বের প্রতি মানুষের আস্থার যে সংকট তৈরি হয়েছে, সে ব্যাপারেও তাদের কোনো বিকল্প চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ গণ-অভ্যুত্থান ও তাদের সরকারের পতনকে এখনো একটি ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখছে। 

এরই মধ্যে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া দলটির কোনো কোনো নেতা অডিও-ভিডিও বক্তব্য ছেড়েছেন সামাজিক যোগাযোগামাধ্যমে; কেউ কেউ বিবৃতি দিয়েছেন। দেশি-বিদেশি পরিকল্পনায় ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে—এটাই আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্যের মূল বিষয়। 

তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনার কয়েকটি ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হয়েছে। এই ফোনালাপগুলো যদি আসল হয়ে থাকে, তাহলে আমরা দেখব তাঁর কথাবার্তা সেই আগের মতোই রয়ে গেছে, কোনো পরিবর্তন নেই। এসব ফোনালাপে ক্ষোভ ও ক্রোধেরই প্রকাশ ঘটেছে।

ফাঁস হওয়া ফোনালাপের বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন শেখ হাসিনা। তৃণমূলের এমন দুজন নেতার সঙ্গে কথা হয়েছে আমাদের। তাঁরা বলেছেন, শেখ হাসিনা তাঁদেরকে মনোবল শক্ত রাখতে বলেছেন এবং কথাবার্তায় তিনি আগের মতোই আছেন। 

তবে দলটি যে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার নজিরও সৃষ্টি হয়েছে এবার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে চলে যান এবং এর মধ্য দিয়ে তাঁর টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের পতন হয় ৫ আগস্ট। দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে কোনো নির্দেশনাও দিয়ে যাননি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে। তাঁরা সরকার পতনের খবরে হতবাক ও দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন। 

আরও পড়ুন

গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতনের সেই পরিস্থিতিতে সারা দেশে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের কাছে তখন জীবন বাঁচানোই প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সেই পরিস্থিতিতে কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় দলের নেতৃত্বের প্রতি তৃণমূলের অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, যা সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে।

প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য বা দলটির নেতৃত্বের একটা বড় অংশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যান। তাঁদের কেউ কেউ পালানোর সময় আটকও হন। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বেশির ভাগ দেশের ভেতরেই আত্মগোপনে আছেন। গণহত্যা, হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেপ্তার রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের একটা অংশ। 

দেশে ও বিদেশে পালিয়ে থাকা দলটির নেতাদের মধ্যে গত এক মাসে বলা যায় একটা যোগাযোগের নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ও এক্স হ্যান্ডলে এখন তাঁদের বক্তব্য-বিবৃতি প্রকাশিত হচ্ছে। এসব ঘটনায় তাঁদের সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা দৃশ্যমান হচ্ছে। 

আগস্টের মাঝামাঝি ও শেষ দিকে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন, দলের এমন একাধিক নেতা বলেছেন, মূলত দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়া সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা এই উদ্যোগ নিয়েছেন এবং চেষ্টা করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনার বিকল্প কোনো নেতা তৈরির চিন্তা তাঁদের এখনো নেই। ফলে দলটির অনেক বক্তব্য–বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার নামে।

ছাত্র আন্দোলন সামলাতে শুরু থেকে একের পর এক সরকার যা করেছে, যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তার সবই ছিল ভুল। আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে এখন তা মনে করেন। দলটি কতটা হালে পানি পাবে বা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, সে ব্যাপারেও নিশ্চিত নন দলের অনেক নেতা। এ ছাড়া দলটি প্রাণহানি বা হতাহতের ঘটনার দায়ভার নিতে রাজি নয়। আওয়ামী লীগ এখনো ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব সামনে রেখে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার কথা বলছে। কিন্তু তাঁদের এই কৌশলে যে মানুষের মধ্যে আস্থা ফেরানো যাবে না, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। 

তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে অন্যদের কোনো যোগাযোগ নেই। দলটিও এ মুহূর্তে তাঁকে এড়িয়ে চলতে চাইছে। ফলে যিনি তাঁদের সরকার পতনের আগে প্রতিদিনই সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিয়ে নানা বিতর্কের জন্ম দিতেন, এখন তাঁর নামে কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না দলটি। 

দেশের বাইরে থেকে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার চেষ্টা কতটা কাজে দেবে, সেই প্রশ্নও তাঁদের মধ্যে রয়েছে। আবার বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে বিকল্প নেতৃত্ব দিয়ে দেশের ভেতরে আস্থার সংকট কাটানোর চেষ্টা কতটুকু কাজে দেবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। কিন্তু দলটির মধ্যে এখনো বিকল্প চিন্তারও কোনো ইঙ্গিত নেই।

পতনের তিন মাস পর আওয়ামী লীগ এই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবসে ঢাকার গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টসহ দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি নিয়েছিল। অগণতান্ত্রিক শক্তির অপসারণ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবির কথা বলেছে দলটি। আওয়ামী লীগবিরোধী বিভিন্ন দল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিরোধ এবং সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে তা সফল হয়নি। 

গতকালের এই কর্মসূচি বিষয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে মনে হয়েছে, প্রথমত এ কর্মসূচি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দল এবং জনগণ কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, তারা সেটি বুঝতে চেয়েছে। রাজনীতিতে ও সংবাদমাধ্যমে আলোচনায় থাকাও ছিল তাদের এই কর্মসূচির অন্যতম একটি লক্ষ্য। অস্তিত্বের সংকট থেকে আওয়ামী লীগকে বের করে আনতে ও দলকে সংগঠিত করার চেষ্টায় সামনে আরও কর্মসূচি নেওয়ার চিন্তাও আছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও তারা জুলাই–আগস্টের পরিস্থিতির দায় এড়িয়ে এগোতে চায়। 

বিদেশে পালিয়ে যাওয়া নেতারা দেশের বাস্তবতা কতটা বিবেচনায় নিয়ে কর্মসূচি দিচ্ছেন—সেই প্রশ্নও তুলেছেন দেশে পালিয়ে থাকা নেতাদের কেউ কেউ। তাঁরা মনে করেন, এ ধরনের কর্মসূচি দেওয়া অব্যাহত থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে আরও মামলা হবে এবং তাঁদের ধরতে অভিযান শুরু হবে। তবে একই সঙ্গে এই নেতারা ঘুরে দাঁড়াতেও চান। কিন্তু তার পথ কী, তা তাঁরা জানেন না। 

আওয়ামী লীগের শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আট শর বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২১ হাজারের বেশি, যাঁদের মধ্যে অনেকে চোখ হারিয়েছেন, অনেকে পা হারিয়েছেন, পঙ্গু হয়ে গেছেন কেউ কেউ। স্বাধীন বাংলাদেশে আর কোনো আন্দোলনে এত হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। আওয়ামী লীগ ও এর নেতৃত্বের প্রতি মানুষের আস্থার সংকটের পেছনে এটাই বড় কারণ। 

দেশ শাসনের সময়টাতে আওয়ামী লীগের দমন-পীড়নে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ও ভিন্নমত দাঁড়াতে পারেনি। নির্বাচন ও নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানকে দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিল। তাদের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগ দেশ চালাত। আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোও সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল; ভিড় জমেছিল সুবিধাবাদীদের। সরকার পতনের পর একসময় ছাত্রলীগ করা অনেকেই যখন নিজেদের ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা হিসেবে ঘোষণা করেন, তখন ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। 

ছাত্র আন্দোলন সামলাতে শুরু থেকে একের পর এক সরকার যা করেছে, যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তার সবই ছিল ভুল। আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে এখন তা মনে করেন। দলটি কতটা হালে পানি পাবে বা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, সে ব্যাপারেও নিশ্চিত নন দলের অনেক নেতা। এ ছাড়া দলটি প্রাণহানি বা হতাহতের ঘটনার দায়ভার নিতে রাজি নয়। আওয়ামী লীগ এখনো ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব সামনে রেখে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার কথা বলছে। কিন্তু তাঁদের এই কৌশলে যে মানুষের মধ্যে আস্থা ফেরানো যাবে না, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। 

কাদির কল্লোল রাজনীতিবিষয়ক সম্পাদক, প্রথম আলো